মঙ্গলবার, ২ মে, ২০১৭

উৎসবে 


১৩ই মে, ১৯৬১
     প্রায় দু'বছর পরে দেশে ফিরলাম। নিজের ঘরে, নিজের টেবিলে বসে পুরোনো বই আর খাতার গন্ধের ভিড়ে আচ্ছন্ন হয়ে পরেছিলাম। একটা পুরোনো ডায়রি পেয়ে তাই লিখতে বসলাম। 

আমার মেজকাকুর ছিল মাছের ব্যাবসা। ছোট কাকু বিয়ের পরে বৌ আর এক কন্যা সন্তান নিয়ে আলাদা হয়ে যান। পরে থাকলাম আমরা। মেজকাকু বিয়ে করেছেন, কিন্তু কোন ছেলেপুলে ছিলনা। কাকিমাও আত্মীয়দের গঞ্জনা সহ্য করতে করতে কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে পরেছিলেন। তখন অত বুঝতাম না, কাকিমা কে খারাপ কথা বলার কারণগুলি। আজ বুঝি, তবে এখন সে'সব অপ্রাসঙ্গিক। মেজকাকিমা শেষে আত্মহত্যা করেছিলেন। বাবা সরকারি চাকরিতে ছিলেন। অর্থাৎ, আমাদের সংসারের এক এবং অদ্বিতীয় সম্পদ। অর্থাভাব লেগেই ছিল পরিবারে। বাবাকে একাই সংসার টেনে নিয়ে যেতে হত। পৈতৃক সম্পত্তি বলতে ছিল এই একফালি ছাদ, আর কিছু জমি। পুকুরটা অবশ্য মেজকাকু ব্যাবসার খাতিরে নিলেও, কোনদিন টাকা নিয়ে আসতে পারতেন না ঘরে। মা আর মেজকাকিমা মিলে কিভাবে যে সংসার চালাতেন, এখনও আমার বোধশক্তির বাইরে। 

বাবা সরকারি চাকুরে হলেও আমাদের যে খুব সুখ-আহল্লাদ ছিল, তা নয়। আমার পড়াশোনা করবার সরঞ্জাম তার সাক্ষ। বাবাদের অফিসের পুরোনো এস্টিমেট বই, টাইপ করা দলিলের কিছু অদরকারি পাতা। এই ছিল আমার অঙ্ক কসবার সরঞ্জাম। কলমের যোগানও বাবার অফিস থেকেই আসত। এখন হাসি পায় বাবার কথা ভাবলে। সরকারি কর্মচারীদের ঘুষ নেওয়ার কথা বাজারে প্রচলিত আছে। আমার বাবা পুরোনো কাগজ আর কিছু কলম ছাড়া অতিরিক্ত কিছুই বাড়িতে আনতে পারেন নি। বাবার এক বন্ধু সমীর কাকু মাঝে মধ্যে আসতেন। বাবার অর্থ সাহায্য প্রয়োজনে যেমন আসতেন, আবার প্রাপ্য টাকার সুদটুকু নিতেও আসতেন। উনি ছিলেন একটি ব্যাংকের ম্যানেজার। টাকার অভাব ওনার সেরকম ছিল না। আবার সুদের ব্যাবসা করে উপরি আয়ও কম ছিল না। ওনার অবদান আমাদের পরিবারে আর কিছু না হোক, আমার জন্যে প্রায়ই ব্যাংকের বাতিল করা  statement আর টাইপ করা নোটিশের কাগজ এনে দিতেন। 

স্কুল ফাইনালের কিছু আগে বাবা অসুস্থ হয়ে পরলেন। চলেও গেলেন হপ্তা কয়েক লড়াই করে। মা-কে অফিস থেকে একটা চাকরি দেওয়া হল। একদিন মা-এর সাথে অফিস গিয়েছিলাম। এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে ফাইল পৌঁছে দেয়া, বড়বাবুদের ঘরে চা পৌঁছে দেওয়া, আর কাউকে তলব থাকলে জানিয়ে আসা। এই ছিল মা-এর সরকারি চাকরি। যদিও আমার বাবা এই কাজে ছিলেন না। কিন্তু মা-এর যোগ্যতা অনুযায়ী এর চেয়ে বেশি কিছু  সম্ভব ছিল না। মা-এর কাজের বরাদ্দ দিনলিপি দেখার পর থেকেই মনে মনে ছক বানিয়ে ফেলি। চিটচিটে কার্বন পেপার এর ছোপ লাগা পুরোনো কাগজে অঙ্ক কষেই হোক, বা ব্যাংকের statement, অফিসের এস্টিমেট পড়েই হোক। লাভ-ক্ষতি আর সুদ-কষার অংক আমার মাথায় যেন ছকের মত সাজানো হয়ে গিয়েছিল। স্কুল ফাইনালের আগেই নেমে পরলাম ব্যাবসায়। 

ধারে ডুবে যাওয়া প্রায় বন্ধ হতে বসা একটা ব্যাবসাকে তিলে তিলে গড়ে তুললাম আমি। প্রথম বছরেই সব দেনার সুদ মিটিয়ে লাভ হল সাতশো আশি টাকা। এই প্রথম মেজকাকু নিজের ব্যাবসায় টাকার মুখ দেখলেন। স্কুল ফাইনালের পরে সেই লাভের অঙ্ক নিয়ে গেলাম পঞ্চাশ হাজারে। আর আজ আমার মেজকাকুর ব্যাবসা এই চত্তরের সবচেয়ে বিত্তবান ব্যাবসা। পঞ্চান্নতে বি.এ. পাশ করে মোট লাভের একটা অংশ নিয়ে আমেরিকা চলে যাই। ব্যাবসা নিয়ে পড়াশোনা করে আরো বড়লোক হব বলে। আর যাই হোক ব্যাবসায় আমার কৃতিত্ব আছে। মা-কেও চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি। পিওনের কাজ করে সামান্য মাইনের চাকরি করবার কোন প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাইনি। ওদেশে একটা চাকরি জোগাড় করে নিজের পড়াশোনা আর থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেশে ফিরেছিলাম একবার। তারপর পড়া শেষ করে আবার এই এলাম। 




                                                                    //১//
এখন:


ডায়রির লেখক স্বর্গীয় বিষ্ণু কিশোর মুখোপাধ্যায়, আমার বাবা। চিলেকোঠার ঘরে বাবার জিনিসপত্র ঘটতে গিয়ে ডায়রিটা পেয়েছিলাম। ঝরঝরে ইংরেজিতে পরিষ্কার হাতের লেখায় কিছু দিনের ঘটনাবলী সাজানো রয়েছে।
মানুষটার সাথে আমার প্রথম আলাপ স্কুলে, প্রিন্সিপালের ঘরে। ক্লাস থেকে বেয়ারা জয়দেব দা যখন আমায় ডেকে নিয়ে গেল। মনে মনে নিজের কীর্তিগুলোর ফর্দ অনুযায়ী কৈফিয়ৎ সাজিয়ে নিচ্ছিলাম। পরে করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় জয়দেব দা যখন বলল আমার বাড়ির লোক এসেছে বলে ডেকে পাঠানো হয়েছে। দুশ্চিন্তাগুলো খানিকটা প্রশমিত হয়। কিন্তু ভয়টা পুরোপুরি যায়নি। প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে যে লোকটাকে দেখলাম, খুব চেনা বলে মনে হয়নি। প্রায় ছ'ফিট লম্বা, ধবধবে ফর্সা, এক মাথা পরিপাটি করে আচড়ানো চুল, আর এক চিলতে গোফ। এই চেহারা সিনেমার পোস্টারে দেখেছিলাম বলে মনে হয়। কিন্তু কিছুতেই পরিচিত বলে মনে হয়নি। আমার এক বন্ধু সিনেমায় একবার কাজ করেছে। ওর মুখে নায়কদের বর্ণনা শুনেছিলাম। বিভুর মত আমারও কি ভাগ্যের চাকা ঘুরল? বেশ বুক ভরে শ্বাস নিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম।


আমার সামনে এসে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে ভদ্রলোক সবার সামনেই আমায় জড়িয়ে ধরলেন। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, "আমি তোমার বাবা, নৃপেন্দ্র।"

লোকটা বলে কি? এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম। আপাদমস্তক আরেকবার লোকটাকে জরিপ করে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকালাম। আমাদের প্রিন্সিপাল, ফাদার স্ট্যানলি, সাহেবও এগিয়ে এসে একটা কিম্ভূত হাসি দিয়ে বললেন, "হি ইজ ইওর ফাদার নির্পেন্দ্ররা।" সাহেবের উচ্চারণটা আজ আর কানে লাগেনি। ভয়, অভিমান, না রাগ; কোনটা যে কাজ করেছিল মনে জানিনা। এক দৌড়ে প্রিন্সিপালের ঘর থেকে পালিয়ে ক্লাসে চলে এসেছিলাম। সেই আমার প্রথম আলাপ বাবার সাথে। 

                                                                      //২//

আমার দেশের বাড়িতে বেশ ধুমধাম করে কালী পুজো হয়। মা-এর কাছেই শুনেছি আমার ঠাকুরদা অভয় কিশোর মুখোপাধ্যায় এই পুজো শুরু করেছিলেন। আর্থিক কারণে বন্ধ হয়ে গেলেও, আমার বাবা সেই পুজো আবার চালু করেন। অবশ্য পুজো শুরু করবার তিন বছর পরেই উনি বাড়ি থেকে চলে যান। আমার মা-কে বিশেষ পছন্দ করতেন না উনি। আমার বয়স তখন দশ মাস, সদ্য হামাগুড়ি দিতে শিখেছি। বড্ড খামখেয়ালি মানুষ ছিলেন বাবা। নিজের ব্যাবসা আর টাকা পয়সা ছাড়া কিছুই বুঝতেননা। আমার মা-কে সময় দেওয়া দূরে থাক, সামান্য কথাটুকু বলতেন না।  ঠাকুমা বাবা-র এই আচরন সমর্থন করেননি বলেই মা-কে নিজের কাছে রেখে দেন। আর ছেলেকে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যেতে বলেছিলেন। বিষ্ণু কিশোর অপেক্ষা করেননি, বা নিজেকে সংশোধন করবার চেষ্টাও করেননি। তাঁর মেজকাকু কে লেখা শেষ পোস্টকার্ড অনুযায়ী বাবা ইউরোপের কোন এক কারখানায় হিসেব রক্ষকের কাজ করছেন জানা গিয়েছিল। তারপর আর কোন যোগাযোগ নেই। 

স্কুলের সেই আলাপের পরে, বাবাকে আবার দেখলাম এ'বার কালীপুজোয় এসে। আমি এখন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করি। প্রতি বছর কালী-পুজোর সময় আমি আর মা দেশের বাড়িতে আসি। ঠাকুমা আর আমার এক বিধবা পিসি এখন এই বাড়িতে থাকেন। জৌলুসটা ফিকে হয়ে গেলেও, আমার পিসতুতো ভাই-বোনেরা এলে বাড়িটা জমজমাট হয়ে ওঠে। আমার মা-এর বাপের বাড়ি থেকেও অনেকে আসেন। মোটমাট কালীপূজোটা আমাদের কাছে একটা খোলা মাঠের মত। সারা বছর যেন অপেক্ষা করে থাকি, এই মাঠে এসে একটু শ্বাস নেব বলে। এইবার অবশ্য পরিবেশটা একটু গুমোট হয়েছিল। বাবার হঠাৎ উপস্থিতি যেমন চাঞ্চল্য তৈরী করেছিল। অনেকের উদ্বেগের কারণও হয়ে উঠেছিল। আমার মা অবশ্য বেশ নির্বিকার ভাবেই ছিল। ঠাকুর আনা হল। চাতালের ধারে মন্ডপ সাজানো হল। আলোর রোশনাই দিয়ে ঘর ভরিয়ে দেওয়া হল। 

উৎসবের বোধয় একটা অন্য আমেজ থাকে। পুরোনো ক্ষোভ, অভিমান, আক্ষেপের উষ্ণ নিঃশ্বাসের উপস্থিতি থাকলেও সেটার উর্ধে উঠে আমরা যেন ভুলে থাকার ভান করি। এই যে এত বছর বাবার কোন খোঁজ ছিলনা। লোকটা আদৌ বেঁচে আছে কি-না তাও কেউ জানত না। হঠাৎ এমন ভাবে এসে পরলেও, সেই নিয়ে বিশেষ কোন আলোচনা কিন্তু হয়নি। নিয়মমাফিক সব কিছুই চলতে থাকে। এমনকি বাবাকেও দেখলাম আমার মাসতুতো বোন এর সাথে বসে মন্ডপের সাজ তৈরী করতে। 

                                                                      //৩//
১৭ই অক্টবর '৬১

দেশে ফেরার পরেই মা-যে আমায় এমনভাবে বিপদে ফেলে দেবে জানতাম না। চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দেবার জন্যে মেতে উঠেছে যেন। এইবার কালীপুজোয় মেয়েটি এসেছিল। তার বাবা-মা কে একেবারে পাকা কথা দিয়ে মা-কালীর শাড়িটা অব্দি দিয়ে বসে আছে। বাবা চলে যাওয়ার পরে আবার এই পুজোটা শুরু করেছিলাম মা যাতে খুশি থাকে। আত্মীয়রা এলে বাড়ির থমথমে গুমোট ভাবটা, কিছু হলেও কমে। ছোট কাকু আর তাঁর পরিবারও এখন আসে শুনেছিলাম। এবার তা স্বচক্ষেই দেখলাম। কিন্তু মা-এর এই কথা দিয়ে ফেলাটা আমি কোন মতেই সমর্থন করতে পারছিনা। প্রতি বছর আমাদের মৃন্ময়ী মূর্তিকে যে শাড়ি পড়ানো হয়, তারই একটি মা সাধ করে তুলে রেখেছিলেন আমার স্ত্রী-কে দেবে বলে। কিন্তু যে মেয়েকে আমি এখনো চোখেই দেখলুম না, জানলুম না। তাকে এই ভাবে শাড়ি দিয়ে ফেলা মা-এর ঠিক হয়নি। 

মা-এর কথার অবাধ্য কোনদিন ছিলাম না। এখন বোধয় সময় এসেছে, সেই বিশ্বাসে একটা ইতি ঘোষণা করবার। পুজোর সময় কোনরকম পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয়, তাই কিছু বলিনি। কিন্তু ভাইফোঁটার পরের দিন মা যখন ডেকে বললেন ওবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার কথা। সত্যি নিজের রাগকে সংযত রাখতে পারিনি। অবশ্য, রাগ দেখিয়েও ফল কিছুই হয়নি। আজ সকালে পাত্রীর বাড়িতে আমায় যেতেই হল। 

পাত্রীর নাম শোভা বন্দ্যোপাধ্যায়। একটি কলেজে বি.এ পাঠরতা, সুশ্রী, সুদন্তী, সুকেশী, সুগায়িকা, এবং সর্বগুণ সম্পন্না। রান্নায় পারদর্শিনী, ও সাংসারিক কাজে অতুলনীয়া। সব ক'টি বিশেষণ এনার সাথে মিলে গেলেও, আমার পছন্দের সাথে মিল হয়নি। পাত্রীর বাবার কাছে অনুমতি পেয়ে শোভাকে নিয়ে ওদের বাগানে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম ভবিষ্যতে কি করবার ইচ্ছে রয়েছে? "বি.এ পাশ করবার পরে কি করবে?" উত্তরের বদলে শুধু নির্বাক, উদ্দেশ্যহীন, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা দুটো চোখ চেয়ে রইল আমার দিকে। মনে মনে দুটো বিশেষণ যোগ করে দিলাম পাত্রীর bio-data তে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত লাজুক, ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নির্লিপ্ত। 


কাজের বাইরে মেয়েদের সাথে আমার বিশেষ ভাবে আলাপ আলোচনা হয়নি কোনদিন। যে প্রশ্নগুলি মাথায় নিয়ে শোভার সাথে কথা শুরু করতে গিয়েছিলাম, সব কিছুই কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেল উদ্দেশ্যহীন, নির্লিপ্ত চোখ দুটো দেখে। মেয়েদের শরীরের প্রতি আকর্ষণ, পুরুষ মানুষের দুর্বলতা। শোভা সেই দিক থেকে নিশ্চই আকর্ষণীয়। কিন্তু,  বিয়ে তো কেবল শরীর চর্চায় আবদ্ধ ক্লীব সম্পর্ক নয়? আজ কাল পরশু শরীরের প্রতি আকর্ষণ থাকে। কিন্তু তার পরে কি শুধুই চাল-ডাল আর হেঁসেলের খবর নিয়ে সম্পর্ক টিকে থাকে? মেজকাকিমার সন্তান হবার কোন সম্ভাবনা নেই দেখে মেজকাকু নিজের ঘরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কাকিমা চলে যাওয়ার পরে মেজকাকুর অন্য নারীসঙ্গ পাওয়ার প্রতি আকর্ষণ আমি দেখেছি। কিন্তু ঠাকুমা আর আমার মা-এর কড়া শাসনের জন্যেই বিপথে যেতে পারেননি। শোভার সাথে আমার সম্পর্কটাও কি সেই স্বার্থের জন্যেই হবে? একজন স্ত্রী তার স্বামীর অভাবগুলির পরিপূরক হয়ে আসে। আমি সেই ভাবেই আমার স্ত্রী-কে দেখতে চেয়েছিলাম। যার কাছে আমার আকর্ষণটা শরীরের বাইরেও একটা কারণে থাকবে। সেটা হল মতের অমিল, যুক্তি দিয়ে তর্ক করা। মস্তিষ্কের চর্চা করা। বারবার হেরে যাবো আমি তার কাছে নতুন কিছু জানার চেষ্টায়। এক সাথে দুজনে মিলে প্রতিটি পদক্ষেপ নেওয়া। 

শোভার মধ্যে আমার চাহিদাগুলির অভাব ছিল। প্রসঙ্গের পরিবর্তন প্রয়োজন দেখে তার কলেজের আর পড়াশোনার বিষয় আলোচনা শুরু করি। কথার মধ্যে সত্যজিৎ রায় এসে পরলে আরো অবাক হলাম। শোভা সত্যজিৎ রায় কে চেনে না। মেনে নিলাম অনেকেই হয়ত জানে না। কিন্তু সুকুমার রায়? বাধ্য হয়েই আমি গুম মেরে গিয়েছিলাম। বেশ কিছুক্ষন কথা বন্ধ থাকায় সে জিজ্ঞেস করে সুকুমার রায় সম্পর্কে। কেমন যেন নিজের প্রতি নিজেকেই পরিহাস করতে ইচ্ছে হল। বলেছিলাম সুকুমার রায়ের সন্দেশ বানাবার কারখানা আছে। সত্যজিৎ রায় এখন সেই কারখানা চালায়। এবং কোন প্রতিবাদ ছাড়াই এটা বিশ্বাস করে নিয়েছিল শোভা। মা-এর পছন্দ সম্পর্কে সত্যি একটা তিক্ততা জন্ম নেয়। 

মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রণ থাকলেও চা ও জলখাবারে আজকের আলাপচারিতার ইতি রচনা করে পালিয়ে এসেছিলাম। ফেরার পরে মা-কে সব বুঝিয়ে বলেছিলাম। মা আমার সব কথা বেশ মন দিয়ে শুনলেন। তারপর উঠে ঘরের কোণে রাখা আলমারি থেকে একটা শাড়ি এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, যে নক্সা করা  হয়েছে সুতো দিয়ে তার নাম বলতে। উত্তর দিতে পারিনি। শত্রূও বোধয় এইভাবে উপহাস করেনা, মা যেভাবে হেসেছিল। দুপুরে খেতে বসে পাতের ধারে একটু ক্ষীর দিয়েছিল মা। মুখে দিয়ে মনে হয়েছিল এখন আমি মরে গেলেও কোন আফসোস থাকবেনা। জীবনের সব থেকে সুখের খাওয়া আমি পেয়ে গিয়েছি। মা-কে সে কথা বলতেই মা ক্ষীর বানাবার পদ্ধতি জিজ্ঞেস করেছিল। এবারেও আমি উত্তর না দিতে পেরে মা-এর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা হেসে বলল ওই শাড়িতে সুতোর কাজ শোভা করেছে। এরকম অনেক সুতোর নক্সা করতে সে জানে। দুপুরে যে ক্ষীর খেয়ে আমি মরে গেলেও আফসোস থাকবেনা বলেছিলাম। সেই ক্ষীর, শোভা নিজে হাতে বানিয়েছে। 

"একটা মেয়ে সত্যজিৎ, সুকুমার কে চেনেনা বলে তুই যদি তাকে বাতিলের খাতায় ধরিস। ওই মেয়েটির সাপেক্ষে তাহলে তো তুই কিছুই জানিস না?"

কোন উত্তর আমার কাছে ছিল না। মাথা নিচু করে মা-এর ঘর থেকে বেরিয়ে  আসার সময় জানতে পারলাম। আগামী ডিসেম্বরেই আমার বিয়ে ঠিক করেছে মা। এবং শোভার সাথেই আমার বিয়ে দেবেন। প্রতিবাদ করিনি। 

                                                                           //৪//
বাবার ট্রাঙ্ক আর টেবিলের দেরাজ ঘেটে অনেক চিঠি আর খাতা পেয়েছি। বাবার যে লেখা-লিখির অভ্যেস ছিল জানতাম না। খাতার পাতাগুলোতে অনেক কাটাকুটি আর ছবি দেখে আন্দাজ পেয়েছিলাম এগুলো সাধারণ আঁকিবুকি নয়। বাবার লেখা গল্প। দুটো প্রায় ছিড়ে যাওয়া চিঠি থেকে জানতে পারলাম বাবার লেখা কলকাতার দুটো পত্রিকাতে ছাপানো হয়েছিল। বৈদিক যুগ সম্পর্কে বাবা যে একটা তথ্যচিত্র বানিয়েছিল আর সেটা যে সমালোচকদের কাছে পাঁচে তিন পেয়েছিল, একটি পত্রিকার কেটে রাখা অংশ পরে জানতে পারলাম। এইসব কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে একটা পুরোনো প্রায় হলদে ছাপ পরে নষ্ট হয়ে যাওয়া ছবি পেলাম। প্যারিসের আইফেল টাওয়ারের সামনে বাবা দাঁড়িয়ে। বাবার এই চেহারাটাই আমার মনে আছে। স্যুট-বুট পরা, পরিপাটি করে আচড়ানো চুল। সত্যিই বাবাকে দেখলে একটা ইনস্পিরেশন কাজ করে যেন। 

কালীপুজোর সাতদিন আগেই আমরা চলে আসি। অনেক কাজ থাকে পুজোর আগে। সে'সব বন্দোবস্ত করতে হয়। হৈ-হুল্লোড় করে ভাই-বোনেরা মিলে  করেও ফেলি কাজগুলো। ঠিক পুজোর আগের দিন বাজার করে ফিরছি। সদর দরজার সামনে একটা বড় গাড়ি দেখতে পেলাম। ঠাকুর ঘরে দশকর্মার জিনিস গুছিয়ে রেখে ঠাকুমার ঘরে আসতেই দেখলাম এক ভদ্রলোক বসে আছেন। ঠাকুমা আমার দিকে তাকাতেই দেখলাম লোকটাও চেয়ারে পিছন ফিরে বসল। তারপর আমার দিকে ঠিক এক ভাবে এগিয়ে এলেন। স্কুলের ক্লাস টু-তে বাবা কে প্রথম দেখার দিনটা মনে পরে গেল। 

সেই টানটান সুঠাম চেহারা। ছ'ফিট লম্বা, এক মাথা কাঁচা-পাকা চুল। তবে আজকে স্যুট-বুট ছিল না। লোকটা আমার কাছে এসে কিছুক্ষন এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তারপর হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেক করবার জন্যে। "হ্যালো ইয়ং ম্যান। কেমন আছো?"


গতবারের ঘটনাটা বাবার বোধয় মনে ছিল। তাই বেশ সুন্দর ভাবেই নিজের আবেগকে গুছিয়ে নিয়ে হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে প্রাথমিক আলাপ পর্বটা মিটিয়ে ফেললেন। 

                                                                     //৫//

১২ই মার্চ, ১৯৬৪

শোভার সাথে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। গত এক বছরে আমার ব্যাবসা অনেকগুলি ঝড় সামলে এখন ধুঁকছে। সরকারের নিত্য নতুন নীতি প্রয়োগ, আর কাঁচামালের ওপর কর বাড়ানোর ধাক্কা সামলাতে গিয়ে লাভের হিসেব ভুলেই গিয়েছি প্রায়। তার ওপর লেবার ইউনিয়নের নিত্য নতুন দাবী আর হাল ফ্যাশনের ধর্মঘট সামলাতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা। মা এ'সব ব্যাপারে বোঝে না। আমার বাকি ছোটখাটো কারবারের অংশীদারেরাও নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। একটা গোটা জাতি শুধুমাত্র পরের গোলামী করেই কাটিয়ে দিল। স্বাধীন ভাবে ব্যাবসা করব বলে সামান্য পুঁজি নিয়ে নেমেছিলাম। আজ প্রায় শূন্য মূলধন থেকে কয়েক লক্ষ টাকার এই কারখানা, জমি সব বিক্রী করে দিতে হবে হয়ত। শ্রমিক শ্রেণীটাই মূর্খ। দুবেলা খাবার জোটেনা, পরনে কারখানার ইউনিফর্ম ছাড়া পোষাক জোটেনা। এদিকে ট্রেড ইউনিয়নের নেতার কথায় মালিককেই শত্রূ বানিয়ে ধর্ণা দিচ্ছে। আমি সত্যি আর পারছিনা ধকল সামলাতে। এদিকে শোভা সন্তান সম্ভবা। আমি বাপ্ হতে চলেছি, আর শিশু জন্মে দেখবে তার ভিখিরি বাপকে। 

না। আমি পারব না। আমি নিজে অনেক কষ্ট করেছি। বাবার অক্ষমতাকে বুঝে পরিস্থিতি কে মেনে নিয়েছি। কিন্তু শোভা বা আমাদের সন্তানকে আমি সেই কষ্ট পেতে দেবনা। শোভা তো আমার আর আমার মা এর মুখ চেয়ে এই সংসারে এসেছে। তাকে কষ্ট দেবার কোন অধিকার আমার নেই। এই ক'বছরে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্টতা কিছুটা বেড়েছে। যে দূরত্ব আমি বজায় রাখতাম, তার পরিমিতি সীমিত হয়ে এখন আমরা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পরলাম। শোভা আমায় একটি সন্তান উপহার দিতে চলেছে। আর ঠিক এই সময়েই শুরু হল কারখানায় গোলযোগ। বাজারে অনেক টাকা আটকে রয়েছে, অংশীদারেরা নিজেদের ভাগ টেনে নিয়ে সরে গেছে। দেনার দায়ে লাভের টাকা দিয়ে সুদ গুনতে হয়। শ্রমিকদের কাছে অনেকবার বুঝিয়ে বলেও কোন সুফল না হওয়ায় উলুবেড়িয়া আর সোনারপুরের দুটো ইউনিট আমার বিকল হয়ে পরে রয়েছে। শ্রমিক ধর্মঘটে আমার নিজের কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন এখন আমার। মেজকাকুর সময় আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার সময় তো কেউ নেই? 


শোভার কাছে একদিন বলেই ফেললাম সব। কোন সমাধান সূত্র পাওয়ার বদলে একটাই কথা শুনলাম। "ঠাকুর সব ঠিক করে দেবেন। ধৈর্য ধর।  সব ঠিক হয়ে যাবে।"

কারখানার দরজায় যে তালা ঝুলছে, ঠাকুর যে কিভাবে সেই তালা খুলে দিয়ে যাবেন আমি জানি না। কাজ বন্ধ থাকার জন্যে যে পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি আমার হচ্ছে রোজ ,তার ক্ষতিপূরণ ঠাকুর কিভাবে করে দেবেন আমি জানি না। মদ আমার ধাতে সইত না। একা একা যুদ্ধ করতে গিয়ে আমি ক্রমে সেই দিকেই ঝুকে পরলাম। মা অবশ্য জানেনা। কিন্তু শোভা অপ্রস্তুত হয়ে পরত আমায় দেখে। নিজের আস্তানা গুটিয়ে তাই আমার ছেলেবেলার চিলেকোঠার ঘরে চলে এসেছি। আমার যুদ্ধের কি কোন অবসান নেই? এত সুন্দর করে সাজিয়েছিলাম আমার স্বপ্নকে। আজ সব কিছু নষ্ট হয়ে যাওয়ার মুখে। আমার সত্যিই আর এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। 

                                                                        //৬//
রান্নাঘরে পিসির কাছে গিয়ে জানতে পারলাম বাবা এখন থেকে এখানেই থাকবেন বলে এসেছে। নিজের সব জিনিসপত্র নিয়েই এসেছেন তাই। কাউকে উপদ্রব করবে না। নিজের চিলেকোঠার ঘরেই থাকবে। এমন সময় মা ডেকে পাঠানোয় বাবার ফিরে আসার কারণটা জানা হয়নি।

বেশ মজলিশী লোক ছিল বাবা। প্রবাসীদের মধ্যে বোধয় একটা স্বভাবগত পরিবর্তন এসে যায়। টুকরো বিষয়গুলো কে সামান্য বলে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা থাকে বেশি। পিসি এবং মা এর ভগ্নিপতিদের কটাক্ষ কিছু তাই খুব নিখুঁত ভাবে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল বাবা। অবসর সময়গুলোতে বাচ্চাদের সাথে নানা রকম খেলায় কাটিয়ে দিল বাবা। তাসের ম্যাজিক, জাগলিং, আরো কত রকম খেলা। বাবা কে আমি সত্যিই এইভাবে চেনার সুযোগ পাইনি। খুব ইচ্ছে করছিল, ছেলেবেলা থেকে পাওনা আদরগুলি আদায় করে নিতে। ইচ্ছে করছিল এতদিনের নিরুদ্দেশ থাকার কারণ গুলো জানতে। কিন্তু কোথাও যেন একটা আড়ষ্টতা আমার পরিধিকে বেড়া দিয়ে রেখেছিল।

আর পাঁচজন এন্টারটেইনারকে যেভাবে দেখি, বাবাকেও সেইভাবে দেখতে কষ্ট হচ্ছিল খুব। কিন্তু মা-এর চোখের জলগুলি মনে পরে যাওয়ায় সেই ইচ্ছেকে মুলতুবি করে দিয়েছিলাম। রাত্রে যখন পুজো হচ্ছে বাবা একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী আর ধুতি পরে এসে দাঁড়িয়েছিল মন্ডপের এক কোণে। মেজদাদু মারা যাওয়ার পর থেকে আমাকেই পুজোর কাজে যোগ দিতে হয়। যজ্ঞের সময় পরিবারের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। বাবার দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখেছিলাম। বাবার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি। মন্ডপের ধারের আলো-আঁধারি আর যজ্ঞের আগুনের কম্পমান শিখার আলোয় বাবার চেহারার সাথে নিজের সাদৃশ্যগুলি খুঁজে পাচ্ছিলাম একটু একটু যেন।

পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পরে বাবা নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। ছাতে উঠে বাবার ঘরের সামনে গিয়ে দেখি বাবা ঘুমোচ্ছে। মনের মধ্যে জমে থাকা কথাগুলিকে আবার বাক্সবন্দী করে ফিরে এসেছিলাম।

পরের দিন ভাসানের সময় আবার বাবাকে দেখলাম। এক রাতেই চেহারাটা  যেন অনেকখানি ভেঙে গেছে। একবার মুখ ফস্কে বলেও ফেলেছিলাম, "বাবা তোমার কি শরীরটা খারাপ?" বাবা বোধয় আন্দাজ করেছিল আমি কিছু বলতে চাই। কাছে এসে জিজ্ঞেস করেছিল, "কিছু বলবে?"
দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করেছিলাম, "আপনার এখানে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা তো?"

বাবা একটু হেসে উত্তর দিয়েছিল, "কোন প্রয়োজনে তোমাকেই আগে বলব।"

                                                                  //৭//
১৯শে এপ্রিল, ১৯৭২

শিবুর কাছে খবর পেয়ে সোজা চলে এলাম দার্জিলিং। মেজকাকুর কাছে খবর পেয়েছিলাম আমার ছেলে হয়েছে। শোভা সুস্থ আছে সেই খবরও জানিয়েছিলেন। ইচ্ছে করছিল ছুটে যেতে। কিন্তু কাজের জন্যে সম্ভব হয়নি। বহু কষ্টে কারখানা বিক্রি করে দেনা মুক্ত হয়েছিলাম। বাকি টাকা মেজকাকুর নামে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম শোভা আর আমার ছেলের জন্যে। একরকম বাধ্য হয়েই আবার দেশ ছাড়লাম। বড্ড দলাদলি আর মারামারি যেখানে। ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ীদের আয়ু সেই দেশে কমে যায়। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে একটা পত্রিকা অফিসে সিকিউরিটির কাজে চাকরি পেয়ে যাই। তারপর টাকা জমিয়ে চলে আসি ব্রাসেল শহরে। ইউরোপে এসে দেখলাম টাকা রোজগারের একটা সহজ উপায় ট্যুর গাইড করে। পড়াশোনা করে সেই কাজ জুটিয়ে নিলাম। গোটা ইউরোপ ভ্রমণ হয়ে গেল আমার। এদিকে দু'পয়সা রোজগার ও হয়ে গেল। 

স্পেন এ এসে এক ভারতীয়র পাল্লায় পরে ঘড়ির ব্যাবসা শুরু করে দিলাম। সেই সূত্রেই ভারতে আসা। শোভা হয়ত ঠিক বলেছিল।"নতুন দরজা খুলবে বলেই পুরোনো দরজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়।" আমার ঘড়ির কারবার জমে ওঠে। সাউথ আফ্রিকা সহ পাঁচটি দেশে এখন আমার এজেন্সি আছে। কাজের সূত্রেই বম্বে এসেছিলাম। আর সেখানেই শিবুর সাথে দেখা। শিবু সম্পর্কে আমার শ্যালক, শোভার খুড়তুতো ভাই। আমার ছেলের নাম নৃপেন্দ্র। দৌড়াত্বের দিক দিয়ে তার জুড়ি মেলা ভার। তার অত্যাচারে একরকম বাধ্য হয়েই শোভা তাকে দার্জিলিঙের একটি বোর্ডিং   স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। শোভা নিজেও একটি স্কুলে চাকরি করছে আর মেজকাকুর ব্যাবসা সামলাচ্ছে। 

পৈতে হওয়ার সময় আমার পূর্ব-পুরুষদের নাম মুখস্ত করেছিলাম। নৃপেন্দ্র মোহন আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদা। নবদ্বীপের রাজ দরবারে একটা তর্ক সভায় 'পঞ্চানন' উপাধি পেয়েছিলেন। বয়সকালেও ওনার শিশুসুলভ দৌরাত্ব আর রসিকতার মাধ্যমে অকাট্য যুক্তি প্রদর্শনে তার জুড়ি মেলা ভার। রাজা তাই খুশি হয়ে নৃপেন্দ্রকে কিশোর বলে ডাকতেন। সেই থেকে আমাদের নামের মাঝে কিশোর আসে। আমাদের প্ৰ প্ৰ পিতামহের ডাক নাম সেই থেকে আমাদের বংশে ব্যাবহার হয়ে এসেছে। সেই নৃপেন্দ্র কিশোরের নাম পেয়েছে আমার ছেলে। এতদিনের সুপ্ত আগ্রহ যেন বাঁধ ভেঙে প্লাবন ডেকে আনে। 

মেজকাকু মারা গিয়েছেন শুনে নিজের সব যোগসূত্রের শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলেছি মনে হয়। ইচ্ছে করছিল মা-এর কাছে ছুটে যেতে। শোভার কাছে গিয়ে আত্মসমর্পন করে ক্ষমা চেয়ে নিতে। কিন্তু সেই সব ইচ্ছেকেও ছাপিয়ে নৃপেন্দ্রকে দেখার আবেগ আমায় আবদ্ধ করে ফেলেছিল। 

শিবু অবশ্য আমায় সাহায্য করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমার পাঠানো টাকা সে তার দিদির হাতে দিয়ে আসবে। গোপনীয়তা বজায় রাখবে বলেও কথা দিয়েছে। আর আমি যে তার কাছে খবর পেয়ে নৃপেন্দ্রকে দেখতে এসেছি, সেই খবর ও সে জানাবে না। 

প্রিন্সিপাল ফাদার স্ট্যানলির কাছে নিজের পরিচয় দিতে উনি আমার সব কথা শোনেন। তারপর একটি বেয়ারাকে দিয়ে নৃপেন্দ্রকে ডেকে পাঠান। কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর প্রিন্সিপাল ঘরের দরজা দিয়ে যে বাচ্ছাটি এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে নিজেই নিজেকে বিশ্বাস করতে পারিনি। অবিকল নিজের প্রতিকৃতি যেন ত্রিশ বছর এক লাফে পিছিয়ে দরজার সামনে মূর্ত প্রতিফলন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার এই বয়স থেকেই চিনেছিলাম অভাব কি জিনিস। জেনেছিলাম হেঁসেলে কিচ্ছু না থাকলে জল ঢালা ভাত নুন দিয়ে খেতে। বিকেলে বন্ধুর ঘরে রুটি-তরকারি দিয়ে টিফিন হলে বাড়ি গিয়ে স্কুলের পড়া নিয়ে বসে যেতাম খিদে ভোলাবার জন্যে। আমার অবিকল প্রতিকৃতি আমার সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের ছেলেবেলাকে আলিঙ্গন করতে কে না চায়। নৃপেন্দ্রকে টেনে নিয়েছিলাম আমার বুকে। নরম একটা উষ্ণ শরীর আমার দুহাতের মাঝে। ওর বুকে কান রেখে শুনলাম ওর হৃদপিণ্ডের স্পন্দন। আর অনুভব করলাম নিজের রক্তবাহে বয়ে যাওয়া স্রোত। 

নৃপেন্দ্র আমায় চিনতে পারেনি। স্বার্থপরের মত কেবল নিজের কথাই ভেবে এসেছি এতদিন। ওর জন্মের সময় মেজকাকু বারবার বলেছিলেন ফিরে আসতে। আমিই জেদ ধরে ছিলাম। খুব অন্যায় করে ফেলেছি। শোভার প্রতি করা অন্যায় আজ আমার এই কষ্টের কারণ। 

                                                                         //৮//
পুজো শেষ। পরেরদিন বিকেলে ভাসান হবে। তার আগে মন্ডপের বাইরে চাতালে, ঢাকের তালে ধুনুচি নাচ হল। বাবা ঢাক বাজাল, ধুনুচি নিয়ে মা কালীর সামনে আরতিও দিল। তারপর চারদিক থেকে একসাথে রব উঠল.... "বলো কালী মা-য় -কি............  জয়য়য়।" মা কালীর মূর্তি তুলে নিয়ে যাওয়া হবে কাছেই পুকুরপাড় অব্দি। বাবা-ও এসে যোগ দিল আমাদের সাথে। পুকুর পার অব্দি গিয়ে মূর্তিকে সাতপাক ঘোরাতে হয়। এই সময় অনেকে হাফিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রতিবারেই আমি শেষ অব্দি টিকে থাকি। এবারে আমি আর বাবা। চতুর্দিকে শাঁখের আওয়াজ আর উলুধ্বনি। পুকুর পার থেকে একটা হিমেল হাওয়া এসে মুখে ঝাপ্টা দিয়ে যাচ্ছে। মূর্তির একপাশে আমি আর অন্যপাশে বাবা। বাবার পাঞ্জাবিটা ঘামে ভিজে জবজবে। আমিও ঘেমে গেছি। ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ একটা  শৈত্য ভাব আছে। রব উঠল "বলো কালী মা-য়-কি.........."

"ঝপাস!" উলুরধ্বনি আর শাঁখের শব্দে চারিদিক গমগম করছে। জলের মধ্যে একটু একটু করে হারিয়ে যাওয়া মূর্তির দিকে তাকিয়ে আছি। অনুভব করলাম আমার কাঁধে কেউ যেন হাত রাখল। ফিরে দেখি বাবা। মুখে সেই হাসিটা। আঁকড়ে ধরলাম বাবাকে। আমিও আজ বাবার মতোই লম্বা। বাবার মত করেই পরিপাটি চুল আচরাই। চোখের কোণ দুটো যেন আপনা থেকেই ভরে উঠল। সত্যি বড় বিচিত্র মানুষের মনের অভিব্যক্তি। আমার এতদিনের জমানো ক্ষোভ, অভিযোগ, যা ব্যক্ত করব ভেবেছিলাম ভাষার মাধ্যমে, কিছু কড়া প্রশ্নবানে বাবাকে জর্জরিত করার মাধ্যমে। সব পরিকল্পনা যেন উত্তাপে বাষ্পীভূত হয়ে যায় আর, বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরে দুচোখের কোল বেয়ে।

"কেন আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলে বাবা?"

ঘামে ভেজা ঠান্ডা শরীরটা আমার ওপর ভর দিয়ে। কোন উত্তর নেই দেখে নিজেকে একটু অবসর করার চেষ্টা করতেই বাবার শরীরটা লুটিয়ে পড়ল পুকুর পারে। নিষ্প্রাণ দেহটাকে বার কয়েক ধাক্কা দিলাম। এতদিন ধরে যার অস্তিত্ব জেনে এসেও সান্নিধ্য পাইনি। সেই বাবাকে এত কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেললাম অবহেলায়। বাবা চলে গেল আমাদের ফেলে। বাবাকে না পাওয়ার আফসোসটা আরো বেশী করে মনে হয়। সেদিন স্কুলে বাবাকে দেখে যদি পালিয়ে না যেতাম; বাবা হয়ত আমার টানেই বাড়ি ফিরে আসত।


                                                                        //৯//
বাবার শ্রাদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয়েছে। ঠাকুমা এখন একেবারেই নীরব। বাবা এতদিন বাড়িতে থাকতনা ঠিকই।  কিন্তু ছেলের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস যে তার প্রতিটি হৃদ্স্পন্দন, এতো আর বলার অবকাশ রাখে না। ছেলের মৃত্যুতে এখন তাই ঠাকুমা আরো চুপ করে গেছেন। পুজোয় আসার পরে বাবা নিজের চিলেকোঠার ঘরেই উঠেছিল। বাবার অফিস বা ব্যাবসা সম্পর্কিত লোকজনের কাছে শোক-সংবাদটা দেবার উদ্দেশ্যে বাবার ঘরে এসেছিলাম। ডায়রি, খাতা-পত্র ঘেটে কারুর ঠিকানা বা ফোন নম্বর যদি পাওয়া যায়। কিন্তু যা পেলাম তা একগুচ্ছ ইতিহাস।

মা-এর ঘরে এসে দেখি মা জালনার ধারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কাছে গিয়ে বুঝলাম হাতে ফোনের রিসিভারটা। কাঁধে হাত রাখতেই মা সচেতন হয়ে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেয়।

"কে ফোন করেছিল?"

"তোর শিবু মামা।"

"কোন খারাপ খবর না-কি?"

"না, কলকাতা ফিরলে তোকে আর আমাকে দেখা করতে বলেছে।"

"কেন? আর তোমার হাতে ওটা কি?" মা-এর হাতে কাগজটা ঘরে ঢোকার সময়ই লক্ষ্য করেছিলাম।

"কিছুনা। তুই তোর ঠাকুমার কাছে যা একবার। shock পেয়েছেন। তোর এখন সাথে থাকা উচিত।"

ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মা। শিবু মামা ফোনে কি বলেছে হয়ত আন্দাজ করতেই পারছি। ডায়রিগুলো পড়ে সেটুকু ধারণা করে নেওয়া যায়। আর মা-এর হাতের কাগজটা যে বাবার লেখা প্রথম এবং শেষ চিঠি। সেটা বুঝেই মা-কে আর বিরক্ত করলাম না।




 -------------------------------------------------------সমাপ্ত--------------------------------------------------------





গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে কারো সাথে কোন ঘটনার মিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। 

সহকারী: আগন্তুক। 
 কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Google images .AhD