মর্তের করোনা, স্বর্গের যাতনা
বাসে বসে বসে কেমন যেন একটা ঢুলুনি ভাব এসে গেছিল। এত দিন পরে দূরদেশ যাত্রা করছি বেশ একটা শিহরণ বোধ করছিলাম। কিন্তু বাসে ওঠার পর থেকে আর সেই বোধ নেই। জীবনকালে একটাও শী হরণ করতে পারলুম না, এখন আর শিহরণ জাগে কি প্রকারে? সে যাক। সবে নিজের নাকের ডাক নিজেই শুনতে শুরু করেছি এমন সময় বাসের ড্রাইভার চিল্লে উঠলো "বৈতরণী বৈতরণী"। লোকটা বলে কি? সবে মাত্র মজুরী ক্যান্টিন থেকে কুমড়োর ছেচকি দিয়ে আর পুঁইশাক এর চচ্চরি খেয়ে বাসে উঠলুম, এর মধ্যেই বৈতরণী? কি আর করা, অগত্যা বাস থেকে নেমে গেলুম। নেমেই তো চক্ষু কপালে। আজকের দিনে হল কি? একসাথে এত লোক নদীর পারে করছেটা কি? বৈতরণীতে ভাসান হয় তো জানতুম না। বৃদ্ধ, দেহাতি, বামুন, কায়স্থ সবকে একসাথে কুনুই এর ধাক্কায় কুপকাত করে এগিয়ে গেলুম। এইসব ব্যাপারে আমার আবার একটু বেশী তাড়া। গঙ্গাসাগর দুবার ভিজিট করে দেহাতি ঠ্যাঙ্গানো প্রক্রিয়ায় আমি বিশেষ পারদর্শী। ছাতু আর লিট্টু খেয়ে এদের মনে বল ভরসা অসীম হলেও কায়িক জোর সীমিত। আমার মত ছ'ফুটিয়া ঢ্যাঙা হলে এদের অনায়াসে কুপোকাত করে এগিয়ে যাওয়া যায়। অবশ্য এরা মিলিত শক্তি হিসেবে ধোলাই দিলে কি হত সেই বিষয়ে আমি জানিনা। যাই হোক, কোন মতে গুঁতিয়ে তো নদীর পার অব্দি আসা গেল, কিন্তু এবার কি?
অস্থায়ী ইমিগ্রেশন অফিস নামে একটা ঘর দেখে সেদিকেই এগিয়ে গেলাম। বাঙ্গালীর অন্যান্য প্রিয় কাজের মধ্যে একটি হল লাইন দেওয়া। রেশন হোক বা ব্যাঙ্ক, ধন্তেরাসে সোনার দোকান হোক বা গোল্ড লোণের অফিসে লাইন। বড় ক্লাবের পূজা মণ্ডপ হোক বা শ্মশানের সার্টিফিকেট অফিস। সব জায়গায় বাঙালী লাইন দিতে ভালোবাসে। যুবক যুবতীরা আগে লাইন মারতে ভালোবাসতো। নোট বন্দীর পরে এখন তারাও ব্যাঙ্কের বাইরে লাইন দিতে ভালোবাসে। কেন লাইন, কি জন্যে লাইন সেই বিষয়ে খোঁজ রাখে কম। এই তো সেদিন ব্যাঙ্কে গিয়ে একজনের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালুম। বললুম, দাদা এটা কি টাকা জমা দেওয়ার লাইন। ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পরলেন। উনি ভেবেছিলেন ব্যাঙ্কে ঢুকতেই লাইন দিতে হয়। লাইনটা পাশ বই আপডেট করার ছিল। বাঙ্গালীর আর দেহাতির বড় সাধ প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে প্রতিদিন এসে পাশ বই আপডেট করানো। শুধু এইটুকু দেখার জন্যে গ্যাসের টাকা এসেছে নাকি। কোন এক সহৃদয় ব্যাক্তি লাইনের অগ্রভাগ থেকে আমার আকুতি শুনেছিলেন। উনিই শেষ রক্ষা করে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে জানালেন, না দাদা কার্ডে টাকা জমা করলে লাইন দিতে হচ্ছে না। বাপস! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। পকেট থেকে এটিএম কার্ড বের করে সেই যাত্রা লাইনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলুম। এই বেলা সেই চেষ্টা করবো বলে লাইন ফাঁকি দিতে গেছি একটা বাঁধাকপি পুলিশ এসে ক্যাঁক করে আমার ঘাড় ধরল। 'পরোয়ানা??'
বলে কি? স্বর্গে যেতে আবার পরোয়ানা লাগে নাকি? আমার ঠাট্টা শুনে পশ্চাৎদেশে ঐ মিলিটারি বুটের রোষায়িত পদাঘাতে গণ্ডী পার করে দিলেন। কাগজ না দেখালে অফিসেই ঢুকতে দেবে না, স্বর্গে যাওয়া তো দুরস্থান। কিছু ফিচেল ছোড়া আমার অবস্থা দেখে হাসছিল। ওদের কাছে জানতে পারলুম ওটা চিত্রগুপ্তের অফিস। স্বর্গে এখন লকডাউন চলছে। যমালয় থেকে তাই কমিশন গঠন করে এই অস্থায়ী অফিস বানানো হয়েছে। কিম কর্তব্য বিবেচনা করতে না পেরে অগত্যা গাত্রোত্থান করতেই হল। প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে নদীর পারে একটা বাধানো ঘাটে গিয়ে বসলুম।
ঘাটে এক সন্নেসী হুম হুম করে ধূম কুণ্ডলী নিঃশ্বাসে ব্যাপৃত করছিলেন। কিছু উজবুক সেই দৃশ্য দেখেই বেবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবাজীর ফন্দি ভালোই বোঝা যাচ্ছে। ঐ করে ভক্ত পটিয়ে বেশ চালডাল কলা মুলো বাগিয়ে নেবে। প্রাপ্তির ঠিকানা যে কি সে তো জানাই আছে। বাবাজী চোখ বন্ধ করেই ছিলেন, এমন সময় আমার দিকে রক্তিম দৃষ্টি প্রয়োগ করে বললেন, 'সোয়ারগ পে জায়েগা?'
হাত জোর করে সম্মতি জানালুম।
"নদী মে ডুবকি লাগাকে উস্পার চলে যা।"
মোল যা! তিনদিনের করোনায় বলে আমার সদ্য পঞ্চত্যপ্রাপ্তি হয়েছে। নিউমোনিয়া এখনও ঠিক করে সারেনি। এর মধ্যে ডুব সাঁতার দিয়ে আবার মরি আর কি। বাবাজী সুবিধার নয় বুঝে ঘাট থেকে উঠে এলুম। এই জায়গায় নদী বেশ শান্ত। বেশ সুন্দর ডাগর ডাগর ফুল ফুটে আছে চারিদিকে। কিন্তু হায় রে পোরা কপাল। এই জগতে যদি কিঞ্চিৎ ফাঁকা জমিও পরে থাকে বাঙালী সর্বত্র। কিছু সেলফি মামনি মরে গিয়েও কেমন দেখতে লাগছে সেই বিষয়ে নাক মুখ বেঁকিয়ে সেলফি তুলছে। ব্যাকে নদীর ল্যান্ডস্কেপ।
গঙ্গাসাগর যাত্রার স্মৃতি মনে পরে গেল। একজনের লিখিত রূপের অবিকল এখানে দিচ্ছি, সুলক্ষনা বহু সধবার সমাবেশ সেথা লক্ষণীয়। প্রত্যেকেরই যৌবন কালক্রমে অতিবাহিত হইয়া এক প্রকার অবক্ষয় এর পথে। তাহাদের উত্থিত প্রাক যৌবনের সমূহ সামগ্রীর প্রতি উদাসীনতার কারণেই হয়ত আবরণ সম্পর্কে তাহারা কিঞ্চিৎ উদাসীন। প্রায় প্রতি সধবাই তাহাদের বক্ষ পেশীর আস্ফালন অতি উদার ভাবে প্রদর্শিত করিয়া আপনা দিগের স্নান পর্বাদী সমাপন করিয়া বস্ত্র পরিবর্তন করিতেছিল। কথিত হয়, সাগর পারে সুদূর দেশের সমুদ্র তটে মেমসাহেবদিগকে এই প্রকার নগ্নপ্রায় দর্শন করা যায়। কিন্তু এই স্থান দৃশ্য সম্পূর্ন অন্য। বিপুল দেহী অতিকায়, অথবা জীর্ণ ক্ষীণ অতি দীন বপুধারী রমণীদের উন্মুক্ত বসনা দৃশ্য। না তাহা মনকে প্রলুব্ধ করে, না তাহা সুপ্ত পৌরুষের আভিজাত্য কে আহ্বান করে। কেবল একরাশ ঘৃণা ও তৎসহযোগে অর্ধ পাচিত খাদ্য সামগ্রী দেহের অন্তঃসল হইতে জিহ্বার অগ্রভাগে অনিয়া দেয়।
না মশাই কোন জায়গাই পোষাচ্ছে না। একরাশ বিরক্তি নিয়ে স্থান পরিবর্তন করতেই দেখলাম নদীর পারে এখানে বেশ লোকজন জড়ো হয়েছে। কিছু বামুন এর মধ্যেও দু'পয়সা কামিয়ে নিচ্ছে। বড় বড় যজ্ঞকুণ্ড বানিয়ে সেখানে ঘৃতাহুতি দিয়ে নদী পারের ব্যাবস্থা করছেন। কিছু মানুষ বেবাক সেই ছলনা হজম করে প্রণামী দিচ্ছে। নদীর ধারে বালির চরে এক পাল গরু আর বাছুর নিয়ে গোয়ালারা রফা করছেন। ব্রাহ্মণ কে গোদান করলেও মুনাফা, আবার বাছুরের লেজ ধরে নদী পার করলেও মুনাফা। অর্ধেক পথ গিয়েই মানুষ তলিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু বাছুর দিব্য এই পারে ফিরে আসছে। ফলে ঐ মোবাইল ফোনের মতোই আনলিমিটেড প্রাপ্তি। এর মধ্যে এক দেহাতি চাষা গোয়ালাকে প্রাপ্য দিয়ে এক বাছুরের লেজ ধরে দিব্য সাঁতরে ওপারে চলে গেল। সেই দেখে তো এক বামুনের কি তম্বী! গোয়ালাকে ধমক ধামক দিয়ে সস্তায় রফা করে তিনি যেই না একটা বাছুরের লেজ চেপে ধরলেন অমনি বাছুর দিল হেব্বি ছুট। বামুন মানুষ, শনি পুজোতে ফুল ছুড়ে যার অভ্যেস তিনি কি আর দেহাতি চাষার মতন পারেন। কাদার মধ্যে ক্যোঁৎ করে পরে একেবারে লুটোপুটি খেলেন। এমন সময় কিছু যুবক যুবতী রে রে করে তেড়ে এলো। বাছুরের লেজ ধরে এমন ভাবে বৈতরণী পার অমানবিক। কেউ কেউ আবার মোবাইল খুলে লাইভ করা শুরু করে দিলো। এক মামনি বাছুরকে চিমটি কেটে আদর করতে লাগলো।
এক মামনি আবার আয়োডেক্স এনে বাছুরের কপালে লেপে দিল। সেই ঝাঁঝে বাছুর তো কেঁদেই অস্থির। সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে একসাথে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো। বাছুরেরও প্রাণ আছে, বাছুর ও কাঁদে ইত্যদি ট্যাগ লাইন দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট শুরু হয়ে গেল।
যারা বাটি হাতে গরুর পশ্চাতে ঘুরছিল এতক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরে যাওয়ার পরেও গোমূত্র খাবে বলে বাটি হাতে এসেছিল। এখন লাইভ সেশান দেখে ঘাবড়ে গেছে। গোয়ালা বেচারা, 'হামি গরীব আদমি, গরীব আদমি' বলে হাত জোর করে লাইভে এসে ক্ষমা চাইছে।
এইসব উপভোগ করছি এমন সময় পাশের ঘাটে চিট ফান্ড, চিট ফান্ড বলে রব উঠলো। একদল লোক বুক চাপরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। গরূঢ় পুরাণে আছে, সৎ গুরু সঙ্গ নিলে বৈতরণী পার হয় সহজে। সেই উদ্দেশ্যে মর্তে যারা নিজেদের সঞ্চয়ের অধিকাংশ গুরুর সেবায় দান করেছেন তারা এখানে এসে জানলেন ঐ গুরু ভুয়ো। মর্তেও চিট ফান্ডে টাকা ঢেলে অনেক বাঙালী সর্বস্বান্ত হয়েছে, এখানেই বা ব্যাতিক্রম কেন?
এতো সব হচ্ছে এমন সময় জবাব চাই, জবাব দাও রব শোনা গেল। সেই তো। পলিটিকাল বাঙালী এখানে এসেই বা নীরব থাকে কেন? শান্ত নদীর পার এক সাথে এত লোকের শোরগোলে একেবারে মাছের বাজার হয়ে গেছে। তারকানন্দ নিউজ থেকে একজন রিপোর্টার আর তাঁর ক্যামেরাম্যান সাথী দৌড়ে গেলেন মিছিলের দিকে। সাদা জামা, সাদা চুল হুমদো একটা লোক হাউ হাউ করে কিসব বলছেন। উনি বলছেন কম, থুতু ছুড়ছেন বেশী। একে মহামারী তায় এমন থুতু ছেটালে যে কেলেঙ্কারি? এতো গুলো লোক কে একসাথে ডেকে এনে কোন সুব্যাবস্থা না দিয়ে এইভাবে ফেলে রাখার প্রতিবাদ করছেন তারা। প্রথমত একটা আইসলেশান সেন্টার নেই, ব্রিজের পরিকাঠামো নেই। একটা ছিল, সেটাও ভেঙ্গে পরেছে দালাল চক্রের চালিয়াতিতে। নৌকার ব্যাবস্থাও করেনি। কিছু নেতা গোত্রীয় লোক কাট মানি নিয়ে নদী পার করে দিচ্ছেন গুপ্ত পথে, বা কাগজ জোগাড় করে দিচ্ছেন। যারা জন্ম থেকে পাপ করে আসছে তারাও কপালে তিলক কেটে পার পাওয়ার ধান্দা করছেন। কোন এক নায়ক নাকি তোরজোড় শুরু করেছেন পরিযায়ী স্বর্গযাত্রীদের নৌকো চাপিয়ে ওপারে পাঠানোর। কিন্তু ঈশ্বর কি করছেন সেই নিয়ে প্রতিবাদ।
এমন সময় সেই ক্যামেরাম্যান নদীর অন্য পারে ক্যামেরা তাগ করে জুম করলেন। সেই বিবরণী আরও ভয়ানক। গণেশ নাকি ঠিক করে মাস্ক পরতে পারছেন না বলে বারান্দা থেকে নামছেন না। কার্তিকের ময়ূর নিয়ে কোন এক সোশ্যাল মিডিয়া প্রেমী ছবি তুলতে সেই যে গেছে এখনও ফেরত আসেনি। ওদিকে বিষ্ণু নতুন মন্দির বানিয়ে নাসানিনাদে দিবাপক্ষের নিদ্রা সম্পন্ন করছেন। মা দুর্গা, দুই মেয়েকে নিয়ে শপিঙে গেছেন। আর মাস কয়েক বাদেই বাপের বাড়ি যাবেন। স্বর্গে নাকি ধুতিলুন্স এ ব্যাপক অফার দিচ্ছে। ওদিকে ভোলেবাবা আছেন নিজের মতন। ভারতীয় নারকোটিক্স দপ্তর নাকি সম্প্রতি একাধিক নায়ক নায়িকার থেকে উত্তম প্রকার গাঁজা বাজেয়াপ্ত করেছে। ভোলেবাবা সেই স্টক আমদানি করে চেখে দেখছেন। ওরে বাবা! এই গাঁজার সলিড দম। ফেলটু নায়ক নায়িকার ফ্রাস্ত্রু গোছানোর চাবিকাঠি। কাজেই ভোলেবাবা সেই গাঁজায় দম দিচ্ছেন আর ব্যোম ব্যোম বলে ধোঁয়া ছাড়ছেন।
এত অরাজকতা, এত অনিয়ম নদী পারে, তবুও মানুষ মহেস্বর আর বিষ্ণুকে স্মরণ করছে, ব্রহ্মাকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। ব্রহ্মা তাই ভীষণ অপমানিত বোধ করে পদ্ম ফুলে চেপে বসে আছেন। এর পিছনে উনি এক ভয়ানক ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন।
দামাল ছেলেদের দৌরাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। নারদ কি করবেন বুঝে উঠতে না পেরে দামালদের সামাল দিতে এইপারে চলে এসেছিলেন। এযুগের ছেলেপিলে গিভ রেস্পেক্ট, গেট রেস্পেক্ট এ বিশ্বাস করে। নারদ ফুট কাটতে আসা মাত্রই তাই চাপিয়ে দিয়েছে বিরাশি সিক্কা চর। বাপের জন্মে চর না খাওয়া নারদ তাই নদীর চড়ে বসে ঘোঁত ঘোঁত করে হাফাচ্ছেন।
এমন সময় যমরাজের আগমন। মুষ্ক কিছু বাহিনী নিয়ে উনি লেলিয়ে দিলেন প্রতিবাদী মিছিলে। যমদূতগুলো নিমেষে নিজেদের ড্যাঙ্গস পেটা করে হাতের সুখ করতে শুরু করে দিল। যমরাজের সাক্ষাৎ বাহন মোষ ঝিলিক দেওয়া সিং বাগিয়ে গুঁতোতে শুরু করলো। এই মরেছে! মোষ যে দেখি এদিকেও আসছে। একে নিউমোনিয়া তায় কোনদিন প্রাণভয় দৌড়াই নি। তবুও দিলাম ছুট। একটু আড়াল পেয়ে নদীর ধারে একটা ঝপের পিছনে যেতেই দেখি একটি কুকুর। আরে! সেই কোন নেটওয়ার্ক এর কুকুরটা না?
'মূর্খ!'
সে কি! কুকুরেও কথা বলছে যে!
'আমি কোন নেটওয়ার্কের কুকুর নই, আমি মহাপ্রস্থানের কুকুর।'
'ও হরি! সেই পাণ্ডবের কুকুর?'
'হ্যাঁ আমি সেই।'
এর থেকে ভালো মউকা আর কিই বা হতে পারে? শুরু করলাম অনুসরণ। কিছুদূর যেতেই নদীর তট অপেক্ষাকৃত শূন্য হয়ে এলো। ভির বাঁচিয়ে এমন নির্জনে স্বর্গলাভ বিশাল ব্যাপার। মনে মনে আমোদ অনুভব করছি। দূরে দেখতেও পেলাম যেন নদীর দুই পার সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। হেঁটে পার করা যায় অনায়াসে। ঠিক এই সময় বালির মধ্যে পা আটকে গেল।কিছু বুঝে ওঠার আগেই ক্যোঁৎ করে পা ডেবে গেল অনেক খানি। অদূরে সাদা জোব্বা পরা একটা লোক বসে আছে। নায়ক সিনেমার মতোই দৃশ্যটা মনে পরে গেল। আমিও চিৎকার করে উঠলাম, 'শঙ্কর দা। শঙ্কর দা আমায় বাঁচান।'
'মূর্খ! আমি ত্রিকালদর্শী।'
'আচ্ছা তা হবেন। কিন্তু এইবেলা তো টেনে তুলুন?'
"তুই ঋণের চোরাবালিতে ডুবেছিস। তোর তো মুক্তি নেই।" ত্রিকালদর্শী একগাল হেসে উঠলেন।
"কি বলেন মশাই। মর্তেও যে ঋণের চোরাবালি ছিল। এখানে তো এই সবে এলুম!"
"ঋণ শোধ না করে স্বর্গে যাবি ভেবেছিস?"
"আরে মশাই ছ'মাস তো কাজ করতেই পারলুম না। ইএমআই দেবো কি করে?"
"তবে তো তোর মুক্তি নেই" এই বলে ত্রিকালদর্শী নিজের স্থানে ফিরে গেলেন। কুকুরটি আপ্রাণ ঘেউ ঘেউ করে চিৎকার করে গেল। আমার শরীরটা একেবারে অর্ধেক ডুবে গেছে এখন। এই অসম লড়াই করে একেবারে ঘেমে গেছি আমি। ধস্তাধস্তি করছি এমন সময় কপ করে বালি আমায় গিলে নিল আর তারপরেই একটা ধপাস শব্দ।
ধরফর করে উঠে বসতেই খেয়াল হল আমি মেঝেতে পরে আছি। রাতে এসি ঘরে শোয়ার সময় চাদর নেওয়ার বাতিক আছে। স্বপ্নের আবহে সেই চাদর জড়িয়ে খাট থেকে দুম করে নীচে পরেছি। মোবাইলটা সেই থেকে একঘেয়ে সুরে বেজে চলেছে। এমন দুঃস্বপ্ন বাপের জন্মে দেখিনি। কোন মতে চাদরের ফাঁস মুক্ত হয়ে উঠে গিয়ে ফোন ধরতেই ওপার থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। "রোগ হোক যা তা, সবেরই ত্রাতা ল্যাব" থেকে ফোন করেছে।
'স্যার আপনি গতকাল করোনা টেস্ট করতে দিয়েছিলেন। রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে স্যার।'
পুলক আর রাখি কোথায়? উচ্ছ্বাসে যে আমার নেত্য করতে ইচ্ছে করছে। ঢক ঢক করে এক বোতল জল সাবার করে দিয়ে গত রাতের স্বপ্ন নিয়ে ভাবছি, দেখি একটা মেসেজ ঢুকল ফোনে। আমার আজকের ইএমআই এর ইসিএস ব্যাঙ্ক থেকে রিজেক্ট হয়েছে অপ্রতুল অর্থ সংখ্যা থাকায়।
ত্রিকালদর্শীর কথা মনে পরে গেল। ঋণের চোরাবালি, 'ধুর শালা।'
পাগলাদাশু