রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭

তপনদা'র চিঠি 


স্নেহের অনাদি,

গত পরশু তোমাদের চিঠি পেয়েছি। তোমার শারীরিক উন্নতির খবর শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। খুব কঠিন অসুখ সামলে উঠলে। নিজের খেয়াল রেখো। আমরাও কুশলে আছি। মিষ্টি তোমার লেখা চিঠি দেখে থেকে আহল্লাদিত, মামা  বাড়ি যাবে বলে। তাকে ভরসা দিয়েছি, আগামী মাসে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। শ্বশুরমশাই ও সে কথা লিখেছেন। 

এই সূত্রে বলে রাখি, আমার চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। এখন আমি আমাদের স্কুলের হিসেব সামলানোর কাজ করি। মাইনে বেড়েছে প্রায় একত্রিশ টাকা। আপাতত অভাবের গ্রাস থেকে খানিকটা স্বস্তি পাওয়া গেল। মিষ্টিও বড় হচ্ছে। তার যত্নের ত্রূটিগুলো সংশোধনের সুযোগ পেলাম একটু। এ'বার স্বরস্বতী পুজোয় তার হাতে খড়ি দিয়েছি। প্রথম ভাগ এখন ভালই আয়ত্ত করেছে; সংখ্যাগুলিও চিনতে শিখেছে। তোমার দিদি ওকে দূর থেকে দেখে, আর আমায় তাগাদা করে, মেয়ের পড়াশুনায় যেন ক্ষতি না হয়। মিষ্টির এই বয়সেই যদি এত চিন্তা করে, ভবিষ্যতে কি করবে ভেবেই হেসে ফেলি আপন মনে।

মিষ্টি আজকাল মাঝে মধ্যে খুব বায়না করে, কান্নাকাটি করে। তোমার দিদি সামলাতে পারেনা, তাই আমাকেই দেখতে হয়। সারা রাত ওকে কোলে নিয়ে ঘুরতে হয় দালান-এ। সারাদিন খাটনির পরে এটুকু অবসর সময় মেয়েকে দেওয়াই যায়, কিন্তু সত্যিগুলি যে বড় নির্মম অনাদি। আমার খুড়তুতো ভাইয়েরা উকিলের চিঠি পাঠিয়েছে বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে। আগামী শুনানিতে রায় ওদের পক্ষে গেলে বাড়ি ছেড়ে দিতেই হবে। আমি আমার জন্যে চিন্তা করিনা, কিন্তু মিষ্টি তো শিশু। এ'সব বিপাকের মধ্যে ওকে এখন থেকেই ফেলতে চাইনা। তোমাদের কাছে তাই ওর একটা আশ্রয় চাইছি। বাবা মারা যাওয়ার আগে নিজের সব সম্পত্তি তাঁর ভাইয়ের নামে করে দিয়েছিলেন, আমায় বলেননি। এখন নিত্য এক উপদ্রব এই মামলা লড়তে যাওয়া। সব কিছু নিয়ে বড় বিপদে পরে গেছি। একা সব দিক সামলানো যায়না।

কাজের কথায় আসি। আমি জানি তোমায় মিষ্টির দায়িত্ব দিয়ে টাকার প্রসঙ্গ আনা অপমান করা হবে। কিন্তু আমার একটা কথা তোমায় মানতেই হবে। প্রতি মাসে আমি ওর নামে কিছু টাকা পাঠাবো। সেই টাকা তোমার ব্যবহারে না লাগলে মিষ্টির নামে জমিয়ে রেখো। আমার এখন যা পরিস্থিতি টাকা পয়সা জমানোর প্রশ্নই আসেনা। কিন্তু ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমার এই অনুরোধ।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ঢুকে দেখি মিষ্টির খুব জ্বর। আমি কি আর অত বুঝি? সারা রাত বসে জলপট্টি দিলাম। তোমার দিদি ও বলে বলে দিল, সেই ভাবে পথ্য দিলাম। গোটা রাত মেয়েটা মা-মা করে কেঁদেছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম মিষ্টি যখন জ্বরের মধ্যে কাঁপছিল। পরদিন সকালে জ্বর কিছু কমলে ডাক্তার খানায় নিয়ে গেলাম। স্কুল কামাই করতেই হল। পড়শী এক জেঠিমার মেয়ে মাঝে মধ্যে এসে মিষ্টিকে দেখে রাখে। উঠতি মেয়ে, এমন ভাবে আসাটাও ভালো দেখায় না। তাই না করে দিতেই হল। পাড়াগাঁয়ে নিন্দে রটে বেশী।

আমার দীর্ঘ চিঠি হয়ত তোমায় বিব্রত করছে। সমস্যা সবার জীবনেই রয়েছে। তার এত উপঢৌকন সহযোগে বর্ণনা বিরক্তিকর। আসলে, অনেক কথা জমে রয়েছে, যা বলতে চাইলেও বলা সম্ভব নয়। তোমার দিদির অনুপস্থিতি আমার জীবনের একাকিত্বকে আরো প্রশ্রয় দেয়। মিষ্টি আজও জানেনা তার মা কেন বাড়িতে থাকেনা। মিষ্টি এখনো খুঁজে বেড়ায় তার মায়ের শাড়িগুলোতে পরিচিত গন্ধকে। রাতে তোমার দিদির একটা শাড়ি বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমোতে যায়। তুলসী তলায় মাঝে মাঝেই ছুটে যায় মা-কে দেখতে পেয়ে। রান্নাঘরে উনুন ধারাই যখন ভোরবেলা, মিষ্টি, ধোয়ার গন্ধে তার মা-এর কথা ভেবে উঠে আসে। মিষ্টির মত করে আমিও তোমার দিদিকে খুঁজি ওর শাড়ির গন্ধে, অথবা তুলসী তলায় সন্ধ্যেবেলা। যাকে ধরে রাখতেই পারলাম না, সে-কি আর সহজে ধরা দেবে?

মামলার কাজে চারদিন পর কলকাতা থেকে ফিরলাম যেদিন, সেদিন রাতে খুব ঝড় উঠেছিল। খোলা জানলার কপাটগুলো এলোপাথাড়ি এসে পড়ছিলো। ঝড়ের জন্যেই পৌঁছতে দেরী হয়েছিল আমার। ঘরে ঢুকে দেখি প্রমীলা জ্বরের ঘোরে প্রায় বেহুশ। বাজ পরার শব্দে ভয় পেয়ে মিষ্টি তখন চিৎকার করে কাঁদছে ওর মায়ের পাশে শুয়ে। কাকে ফেলে কাকে সামলাই। তোমার দিদির জ্ঞান ফেরে যখন আমায় দেখে উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। আমার জামাটা খিমচে ধরে কাছে টেনে বলেছিল মিষ্টিকে দেখে রাখার কথা। সুযোগ দিলোনা তোমার দিদি; একটু সুযোগ। চলে গেল নিজের খেয়াল মত। একটু আগে যদি ফিরতাম সেদিন, হয়ত এমন হত না।  

তোমার কাছে একটা শেষ অনুরোধ রেখে উপসংহার আনবো। মিষ্টি বুঝতে না পারে, তাই প্রমীলার কোন ছবি আমি ঘরে রাখিনি। তোমার দিদির একটা ছবি বাধিয়ে রাখবে? আগামী মাসে মিষ্টিকে রাখতে গিয়ে নিয়ে আসবো। কল্পনায় ওকে দেখতে খুব কষ্ট হয় এখন। তবু যদি একটা ছবিতে ওর সঙ্গ পাই।

সাবধানে থেকো। তোমার মা-বাবাকে আমার প্রণাম জানিও।

                                                                                                                   ইতি,
                                                                                                                        তপন দা





   

বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

প্রতিবিম্বে 


                                                                         //১//
"কি চাও কি তুমি? কাজে এত অমনোযোগী হলে চলবে?...... আমি তোমার সাথে কথা বলছি দোলা!" নিজের চেয়ার থেকে উঠে আসেন অবিনাশ মিত্র, দোলার Project leader. দোলা টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। অবিনাশ বাবু একবার ঝুঁকে দোলার চোখের দিকে দেখে, ব্যাঙ্গের হাসি দিয়ে ঘরের কোণে রাখা coffee machine এর দিকে এগিয়ে যান।

"এই তোমাদের মত মেয়েদের জায়গা কোথায় জানোতো? ঐ রান্নাঘরে। কাজে ভুল করে ফেলবেন, আর এদিকে boss কিছু বললেই চোখে জল চলে আসে। অন্যের sympathy কুড়িয়ে কাজে উন্নতি করবে ভেবেছ?" coffee cup নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসেন অবিনাশ। 

নিজের অজান্তেই হাতে থাকা file টা আরো বেশি খিমচে ধরেছিল দোলা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল নিজেকে সংযত রাখার জন্যে। পায়ের পেশিগুলো গরম হয়ে উঠেছিল দেহের ভারে। তবু অবিনাশের কথাগুলো তাকে শুনে যেতেই হবে। চাকরিটা এখন আর শুধু তার প্রয়োজন নয়, ভরসার জায়গাও বটে। উপার্জন বলতে পরিবারে সে একা। গত তিন বছর এই company তে accounts section এ কাজ করে সে। উন্নতির সম্ভাবনা যে ছিলনা, তা নয়। কিন্তু অন্য মেয়েদের মত সময় দিতে, overtime করতে, বা নিদেন পক্ষে পুরুষ মানুষের চোখের খিদে মেটানো পোষাক পরতে সে ব্যর্থ। আজও তাই সেই একই ঘরের কোণে, রঙ খসে পরা দেয়ালের ধারে একটা ছোট্ট টেবিলে তার ঠিকানা বরাদ্দ। গতকাল office আসার পরেই তার টেবিলে Roy Enterprise এর file টা এসে পৌঁছায়। Tender wise quotation বানাতে হবে। গত বারো বছর ধরে এই tender তার company নিয়ে এসেছে। গত বছর Marketing manager মৌসুমীর সাথে সে-ও গিয়েছিল Roy enterprise এর MD এর সাথে দেখা করতে। কত স্বচ্ছল স্বাভাবিক ভাবে মৌসুমীদিকে সে দেখেছে হাসতে, কথা বলতে। কিন্তু সে কেন এভাবে কথা বলতে পারেনা, দোলা জানেনা। একটা জড়ত্বের প্রাচীর যেন ঘিরে ধরে তাকে। পরিচিত শব্দগুলোও তখন আবদ্ধ হয়ে যায় জিভের আড়ষ্টতায়। 

তাদের যাত্রা সফল হলেও, ফিরে আসার পর থেকে দোলার চাকরি জীবনে একটা অন্ধকার কালো মেঘের ছায়া যেন আবহ বিস্তার করে। মৌসুমীদির মনে হয়নি দোলা এই রকম meeting এর উপযুক্ত 'item' বলে। কাজেই অবিনাশ এর কাছে report যায় সেইভাবে। এই বছর তাই একই ভাবে মৌসুমীদি meet করতে গেলেও, দোলার প্রয়োজন পরেনি। 

গতকাল tender দেখে, গত বছরের quotation এর সাথে tally করিয়ে নতুন quotation তৈরী করেছিল সে। কিন্তু নতুন কিছু সংযোজনে VAT এর পরিমাণ 4.7% এর বদলে 14.7% করতে হোত। আর তাতেই এই বিপত্তি।

"চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?" coffee cup এ চুমুক দিয়ে ধমক দিয়ে বলেন অবিনাশ। 

"Am sorry sir." দোলার অস্পষ্ট শব্দগুলো যেন ceiling fan এর আওয়াজের সাথে মিশে হারিয়ে যায়। 

"Sorry? কি বিরাট বড় ক্ষতি হয়ে যেত সেটা আন্দাজ করার ক্ষমতাটুকু আছে তোমার? অবশ্য থাকবেই বা কি করে। তিন বছর ধরে একই জায়গায় পরে আছো। না আছে নিজের উন্নতির চিন্তা, company র উন্নতি থোড়াই care কর। হিসেবে বাকি থাকা  tax এর টাকাগুলো কি তুমি pay করতে?"

শ্বাসনালীর কাছে কথাগুলো দলা পাকিয়ে উঠছিল। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। মনের মধ্যে চেপে রাখা প্ৰতিবাদগুলি পিঞ্জর আবদ্ধ বেয়ারা হাতির মত দামাল হয়ে উঠছে। কিন্তু সব কথা শুধু চোখের জল হয়ে পরিণতি পায় দৃষ্টিকে আরো ঘোলাটে করে দিয়ে। 

"আমি জানি তুমি কেন এরকম করেছ।" অবিনাশের চোখে একটা হীন দৃষ্টি। দোলাকে আজ অপমানিত করার নেশা যেন তার মাথায় সওয়ার। "মৌসুমীকে এত হিংসে তোমার? 

দোলা অবাক হয়ে অবিনাশের দিকে তাকায়। নিজের company র ক্ষতি করবে বলে সে এমন ভুল করেছে? অবিনাশ কি তাই বলতে চায়? আর মৌসুমিদিকে সে হিংসে করতে যাবেই বা কেন?

"অমন অবাক হয়ে যাওয়ার মত কিছু হয়নি। মৌসুমীকে হিংসে কোরোনা। ওঁর থেকে শেখার চেষ্টা কর। তোমার থেকেও নিচু post এ চাকরি পেয়ে এসেছিল এই company তে। আজ দেখ সে কোথায় পৌঁছে গেছে।"

"কিন্তু আমি স্যার।........." দোলার কথাগুলি মাঝ পথেই বাধা পায়। 

"তর্ক করনা। তোমার মনে কি চলছে আমি জানি। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছ কখনো? একটুও approachable তুমি? office এ কারো সাথে সদ্ভাব আছে তোমার? একেবারেই presentable নয় তুমি। নিজের মত আসো, যাও, সাদা ভূতের মত ঘুরে বেড়াও। এভাবে চললে, তোমার উন্নতি খুব কঠিন।"

প্রসঙ্গটা আরো দূর যেত হয়ত, কিন্তু subordinate প্রসূন এসে পড়ায় ইতি রচনা করতে হয় অবিনাশকে। "Quotations এ ৭টা item এ 14.7% VAT add করে নতুন print বার কর। Soft copy টা আমায় mail এ পাঠিয়ে দাও, আজকের মধ্যেই।" কথাগুলো শেষ করে file টা একরকম ছুড়েই দিলেন অবিনাশ। 

"স্যার, আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দরকার ছিল।" দোলার কথাগুলো অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতই নতুন উত্তাপ সৃষ্টি করে। 

"তুমি কি ঠাট্টা করতে রোজ আসো office এ? গত দু'মাসে সাত থেকে আটবার ছুটি নিয়েছ তুমি। বাড়িতে বসে থাকলেই তো হয়? Company accounts সামলাতে বলে তোমার নামে বরাদ্দ মাইনেটা নিয়ে যেতে মাসে মাসে।"

"স্যার, বাড়িতে একটু। ........"

নিজের মেজাজ হারিয়ে বসেন অবিনাশ। "প্রসূন, তুমি ওকে বলে দাও এই মুহূর্তে যেন আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কোন ছুটি হবেনা। আজকের মধ্যে quotation যেন আমার email এ blink করে।"

প্রসূন একবার দোলার দিকে তাকায়। রুমালে চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের department এ চলে আসে দোলা। একটু জল খেয়ে নিয়ে mobile টা নেয়। 

"বাবা কেমন আছে এখন?" উদ্বেগটা যেন সমস্ত আবেগ সহ কন্ঠস্বরে প্রতিফলিত হয়। 

"তুই ছুটি পেলি?" ওপাশে মা-এর কন্ঠেও ভীতির ছাপ স্পষ্ট। 

"না। কাজে চাপ আছে। আচ্ছা তুমি ভেবোনা। আমি দেখছি কি করতে পারি।"

ফোন কেটে দোলা একটা sms করে দেয় ইন্দ্রকে। নিজের পরিস্থিতি, আর যেতে না পারার কারণটাও জানায়। তারপর washroom থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে quotation টা correction করতে থাকে। 


                                                                          //২//
"আজ এত দেরী হল?" দরজা খুলে দোলাকে দেখে প্রশ্ন করেন দোলার মা। 

"Boss আজ খুব রেগে ছিলেন। ছুটি চাইবার সাহস পাইনি তাই। ইন্দ্র এসেছিল?" জুতোটা খুলে বসার ঘরে সোফায় নিজের ব্যাগটা রাখে দোলা। lunch box আর জলের বোতলটা বার করে। 

"তুই আগে স্নান সেরে আয়, তারপর সব বলছি।" 

নিজের ঘরে এসে পোষাক বদলাতে গিয়ে আয়নায় চোখ যায় দোলার। এগিয়ে যায় আয়নার সামনে। সকালে অবিনাশের কাছে শোনা কথাগুলো মনের মধ্যে আবার প্রতিধ্বনিত হয়। সত্যিই কি সে presentable নয়? approachable নয়? দুশ্চিন্তায় মুখে একটা অকাল বার্ধক্যের ছাপ এসেছে ঠিকই। রক্তাল্পতায় ভুগে মুখটা আরো ফ্যাকাশে। চোখে কাজল দিতে আর ইচ্ছে হয়না তার। মনে হয় দু'চোখের কোল ছাপিয়ে যেন সেই কাজল প্লাবন এনেছে। বাবার অসুস্থতায় পালা করে রাত জেগে থাকতে হয়। ঘুমের অভাবে সেই ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যায় বলে তাড়াহুড়োয় office বেরোয়, তাই সাজগোজের সেভাবে অবকাশ মেলেনা।

"খাবার গরম করছি। বেশি দেরী করিসনা।" বাইরের ঘর থেকে মা-এর কন্ঠস্বর শোনা যায়। 

সব চিন্তার পালায় ইস্তফা দিয়ে bathroom এ যায় দোলা। 

খাবার পালা শেষ করে বাবা কে দেখে নিজের ঘরে আসে। তার মা তখন ব্যস্ত বিছানা করতে। সারাদিনের নিত্য ব্যস্ততায় এই সামান্য কিছু সময় দু'জনে share করে এক সাথে। মা তার চুলে তেল মাখিয়ে বিনুনি করতে করতে সারাদিনে ঘরের খবর শোনায়। আবার দোলা নিজের office এর গল্প করে। 

"ইন্দ্র এসেছিল?" চাদরটা পাততে সাহায্য করে দোলা। 

বিছানা পেতে এক কোণে বসে মেয়েকে কাছে ডেকে নেন। "হ্যা এসেছিল।" মেয়ের চুলের খোঁপা খুলে চিরুনি দিয়ে আচড়ে বলতে শুরু করেন। 

"তুই office বেরিয়ে গেলি। তারপরেই তোর বাবা কে খেতে দিলাম। ঠিক করেই খেল সবটা। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই bathroom এ গিয়ে বমি। আর একদম রক্ত বমি। ঘাবড়ে গিয়ে তোকে phone করে বললাম একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা।"
মাথা সরিয়ে নিয়ে মা-এর দিকে ফিরে বসে দোলা। "তারপর?"

"আমি কি আর একা সামলাতে পারি? ভাগ্য ভালো মুদি দোকানের ছেলেটা সেই সময় এসেছিল জিনিস দিতে। তোর বাবাকে ওর হাতে দিয়ে ডাক্তার কে phone করতে গেলাম। কিন্তু এমন ছাই phone কিনে দিয়েছিস, মাথা-মুন্ড কিচ্ছু বুঝি না। ওদিকে তোর বাবা ডেকেই চলেছে। শেষে একটু সুস্থ হলে পুরোনো prescription ঘেটে ডাক্তার কে phone করলাম। মুদি দোকানের ছেলেটা কে লিখে দিতে ও এনে দিল ওষুধ।"

"ডাক্তার কাকুকে একবার আসতে বলতে?" দুপুরের ঘটনাগুলো নিজের সকাল থেকে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা কে ফিকে করে দেয়। 

"সে তো out of station. প্রায় ঘন্টা খানেক এই যুদ্ধ করে তোর বাবা একটু সুস্থ হলে তোকে phone করলাম। Switch off শুনে বুঝলাম meeting এ আছিস বোধয়। এদিকে বমি করার পরেই তোর বাবা এমন নেতিয়ে পড়ল ভয় করছিল। শেষে ওই ছেলেটাকে দিয়েই পাড়ার কৌশিক কে ডেকে  পাঠালাম। সে এসে সব দেখে শুনে ওষুধ দিয়ে গেল। তারপরেই তুই phone করলি, কিছু পরেই ইন্দ্র এলো। ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। অনেকক্ষন বসে তারপর গেল।"

"ইন্দ্র কোন ডাক্তারকে এনেছিল?" দোলার ভয়গুলো আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। 

"ওদের বাড়ির কাছেই একজন medicine এর ডাক্তার। খুব ভালো ব্যবহার। সব দেখে শুনে বললেন আপাতত ভয়ের কিছু নেই। যা ওষুধ পড়েছে ঠিকই আছে। কোন দরকার পড়লে তাকে যেন খবর দেওয়া হয়।"

মেয়ের মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে এলোমেলো ভিজে চুলগুলো আবার সাজিয়ে নেন। বুকের ভিতরে একটা শূন্যতা যেন অনুভব করে দোলা। মা-এর কোলে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে কোমর। চোখের জল গড়িয়ে পরে মা-এর শাড়িতে। 

                                                                       //৩//
ইন্দ্র, দোলার কলেজ জীবনের বন্ধু। বন্ধুত্ব ক্রমে প্রণয়ে পরিণতি পায়।  ইন্দ্রদের বাড়িতে দোলাকে পছন্দ না হলেও, দোলার পরিবার ইন্দ্রকে মেনে নেয়। কলেজ শেষে দোলা চাকরিতে join করে, আর ইন্দ্র নিজেদের পারিবারিক ব্যবসাতে। বন্ধুত্বের বাইরেও সম্পর্কের গভীরতা বাড়ছিল, হয়ত বিয়ের প্রসঙ্গও এসে যেত। কিন্তু বাঁধ সাধল দোলার বাবার অসুস্থতা। একটানা দু'সপ্তাহ জ্বরে ভোগার পর হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সবরকম test করিয়ে অবশেষে ধরা পরে Hepatitis B থেকে meningitis আর Liver cirrhosis। প্রায় একমাস হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে আসেন দোলার বাবা। এর পর থেকেই ক্রমাগত অসুখ বাড়তেই থাকে। অসুস্থতা, office এর ব্যস্ততা, সংসারের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে দোলা আর ইন্দ্রের সম্পর্কে একটা চির যেন দেখা দেয়। তবু বাবার জন্যে রাত জাগার সময় ইন্দ্রকে phone এ সময় দিত সে। কিন্তু ইন্দ্র যেন দূরত্বটাকে সহজভাবে নিতে পারছিল না। 

মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মোবাইল এ একটা sms পাঠায় দোলা। chat box এ reply ও এসে যায়। 

-'ajker jonne thanks. :) tumi ja korle aj.'

-'Hmm. thik ache. phn korbo?'

-'aj khub tired lagche. kal kotha boli?'

-'ok. gdnt then. bye.'

-'bye. thanks again.'

-'welcome. :)'

বালিশে মাথা রাখতেই একরাশ ঘুম যেন ঝাঁপিয়ে নেমে আসে চোখে। Boss এর কথা, বাবার অসুস্থতার কথা, Office এ কাজের কথা সব যেন ধুয়ে মুছে একটা নির্বাক, অন্ধকার স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যায় তাকে। বিছানার সাথে গোটা শরীরটা যেন মিশে যেতে চায়।

                                                                    //৪//
Office থেকে বেরিয়েই ইন্দ্রকে phone করে দোলা। সতেরো টা missed call ছিল, খেয়াল করেনি সে। আজ office এ board meeting ছিল। Mobile এর silent mode off করতে ভুলে গিয়েছিল। তাই টের পায়নি ইন্দ্রর call গুলো। এ'বছর company নতুন target declare করেছে। Production বাড়াতে হবে, সেই অনুপাতে খরচ এর হিসেবেও পরিবর্তন আসবে। একটা সম্ভাব্য recession এর খবর শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু director দের মতে, আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে। শেষ ৫ বছরে সমস্ত Debtors আর creditors এর list বানাতে হবে। Accordingly payment schedule আর collection করতে হবে। List বানাবার দায়িত্ব এবার দোলাকে দেওয়া হয়েছে। Conference hall থেকে বেরিয়ে অবিনাশ দোলাকে বলে দিয়ে গেছেন এটা একটা সুযোগ নিজেকে worthy প্রমাণ করার। একটা বড় কাজের দায়িত্ব পেয়ে দোলার মনটা বেশ ফুরফুরে। Office এর সিঁড়ি দিয়ে নেমে footpath এ উঠে call টা করে।

"Really sorry, mobile টা silent ছিল। বল কি খবর?"

"এ আর নতুন কি। হে হে!" ওপাশ থেকে ইন্দ্রর কন্ঠস্বরে সামান্য খাদের আভাস স্পষ্ট।

"কি হয়েছে?" রাস্তায় গাড়ির শব্দে ভালো করে কথা শোনা যাচ্ছিলনা। দোলা নিজের speaker volume টা বাড়িয়ে নেয়।

"একবার দেখা করা যায়?" ইন্দ্র নিজের গলাকে আরো খানিকটা খাদে নামিয়ে বলে।

ঘড়িতে সাতটা বাজতে পাঁচ। ঘড়ি দেখে নেয় দোলা।  হাতে কিছুটা সময় আছে। "কোথায় দেখা করবে বলো?"

"Same place. সরোবর?"

"Metro তে উঠে phone করে দিচ্ছি। তুমি সময় বুঝে চলে এসো।"

আজ প্রায় মাস খানেক পর তারা সরোবরে বেড়াতে এলো। এখানে একটা ফুচকার দোকানে গন্ধ লেবু দিয়ে ফুচকা বানায়। প্রথম দিকে ইন্দ্র ফুচকা খেত না। দোলার পাল্লায় পরে অভ্যাস হওয়ায় এখন দোলার থেকেও বেশি ফুচকা খায় ইন্দ্র। আজ অবশ্য ফুচকা খাবার ইচ্ছে ছিল না। ইন্দ্রকেও একটু ব্যস্ত বলে মনে হল। পার্কের একটা বড় তেঁতুল গাছের নিচে বাঁধানো বসার জায়গা বেছে নিয়ে দু'জন গিয়ে বসে। ইন্দ্র পকেট থেকে একটা খাম বের করে দোলার হাতে দেয়।

"কি এটা?" দোলা খামটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে।

"বাবা কিছু টাকা পাঠালেন। তোমার এখন প্রয়োজন আছে। তোমার বাবা এত অসুস্থ।" ইন্দ্র একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে।

"আমার এখনই লাগবেনা। তোমার কাছে রেখে দাও। বড় কোন দরকার পড়লে সাহায্যতো চাইবোই।"
দোলা খামটা এগিয়ে দেয়।

"ওটা তোমার কাছেই থাক। পরে আমি যদি না থাকি?"

কথাটার মধ্যে লোকানো আক্ষেপটা টের পায় দোলা। ইন্দ্রকে আজ বড় অন্যরকম লাগছে। অন্যান্য দিন দোলার সামনে সিগারেট ধরালেও এত বিকট গন্ধটা আসেনা। আজ তার মানে অনেকগুলো খেয়েছে ইন্দ্র। বলে বলে এক প্যাকেট সিগারেট থেকে এখন দিনে ২-৩টে সিগারেটে নামিয়েছে দোলা। ইন্দ্রর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে

"তোমার কাজের জায়গায় কোন সমস্যা হয়েছে?"

সিগারেটের শেষ টানটা অনেক্ষন বুকের মাঝে চেপে রাখে ইন্দ্র। সমস্ত উত্তাপটা প্রশ্বাসে সীমাবদ্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলে। একরাশ ধোয়ার সাথে বাষ্পীয় কিছু শব্দ ভেসে আসে দোলার কানে।

"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"

ইন্দ্রর কাঁধ থেকে হাতটা নিজের অজান্তেই নেমে আসে। দোলার শরীরটা কেমন যেন দুর্বল বলে মনে হয়। বেঞ্চের ধারটা খিমচে ধরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।

"কার সাথে?"

"বাবার এক বন্ধুর মেয়ে। গয়নার দোকান আছে ওদের। বাড়ি থেকে সবাই মেনে নিয়েছে। আমাকেও তাদের পছন্দ হয়েছে।"

"আর তোমার?" বড় বোকা বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলে নিজেকেই নিজে ধমক দেয় দোলা।

"আমি হ্যা বলে দিয়েছি।"

"আমাকে একবার বলতে পারতে?  আজকের দিনের জন্য prepared থাকতাম তাহলে।" চোখের জল আর আসেনা দোলার। অবিনাশের কথা মত sympathy কুড়িয়ে বেঁচে থাকতে চায়না সে। কিন্তু আবেগ বড় বিশ্বাসঘাতক অভিব্যক্তি। কন্ঠস্বরে নিজের কষ্টটা প্রতিফলিত হয়ে পরে।

"আমাকে ভুলে যেও। আর পারলে আমার নম্বরটা মুছে দিও mobile থেকে।"

"নিশ্চই!" একটা ঢোক গিলে কষ্টটাকে প্রশমিত করে নেয় দোলা। "কিন্তু একবার জানতে পারি এ'ভাবে সম্পর্কটা শেষ করে দিলে কেন?"

"তুমি নিজেকে এই প্রশ্নটা করে দেখ। উত্তর পেয়ে যাবে।" আরেকটা সিগারেট ধরায় ইন্দ্র।

"আমার ভুলটা একটু বলে দিলে সুবিধা হয়।" মুখের সামনে ভেসে আসা ধোয়াটা হাত দিয়ে কাটিয়ে নেয় দোলা।

"ভুল তোমার কে বলল? ভুলতো আমি করেছি। তোমার মত মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে।"

"আমার মত মেয়ে?"

"তুমি বুঝতে পারোনা? আমার বন্ধুরা তাদের girlfriend নিয়ে movie যাচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছে। Weekends এ party করছে। আর আমায় দেখ? তোমার শরীর খারাপ, তোমার বাবার শরীর খারাপ, তোমার বাড়িতে এই, তোমার বাড়িতে সেই। আমি কোথায়? তোমার জীবনে আমি কোথায়?" ইন্দ্র উত্তেজিত হয়ে পরে।
"আমাদের সম্পর্কে কোনদিন তুমি আর আমি বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে? বিয়ের আগেই যদি এরকম থাকে, বিয়ের পরে তো আর দেখতেই হবে না। পুরো দায়িত্ব আমার ঘাড়ে।"

খামটা মুঠোয় চেপে ধরে দোলা। তার ভালোবাসার তুল্য-মূল্য বিচারের পদ্ধতি দেখে নিজেই বিস্মিত সে। সত্যিই তাই। ইন্দ্রকে কিই বা দিতে পেরেছে? সামান্য শরীরের বদলে আর কোন দাবিকেই গুরুত্ব দিতে পারেনি সে। শরীরটাই বা দিল কোথায়? তার শরীর সুস্থ থাকলে তবে তো? তল পেটের কাছে ব্যাথায় প্রত্যেক মাসে তিন চারদিন অন্ধকার ভাবে কাটে দোলার। চোখের কোণে সামান্য জলের আভাস যেন দেখা দিল। খামটা নিয়ে ইন্দ্রর হাতে ধরিয়ে দেয়।

"ভালো থেকো। বিয়ে করে সুখী থেকো। এই টাকা আমার চাই না। শরীর বিক্রী করার মত পরিস্থিতি আমার এখনো আসেনি।"

চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় দোলা। সম্পর্কের ইতি রচনা করা কঠিন হলেও, সেটা খুব সহজ ভাবেই মিটে গেল। দোলার জীবনে একজনের অভাব নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় অসহায় ভাবটা জাপ্টে ধরে। গোটা রাস্তা নিজেদের সুখের দিনগুলো মনে করে কাটে।

                                                                        //৫//
ঘরে ফিরে fresh হয়ে নেয় দোলা। আজকে বাবার সেরকম শরীর খারাপ হয়নি। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মা-এর কাছে এসে বসে। নিয়ম মাফিক মার কাছে সারাদিনের ঘটনা শোনায়। তারপর শুয়ে পরে। যাওয়ার আগে আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে মা। একলা ঘরের দেওয়ালগুলোয় রাস্তার সামান্য আলো এসে পড়ছে। পর্দাগুলো ইতস্তত ভাবে উড়ছে হাওয়ায়। সন্ধ্যেবেলা ইন্দ্র ও তার কথোপকথনগুলো মনে পরে যাচ্ছিল।
"নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কখনো?" "তোমার প্রয়োজন, তোমার বাড়ি, এ'সবের বাইরে কিছু ভেবেছ কোনদিন?"

নিজের মনেই হেসে ফেলে দোলা। Class IX এ পড়তে দোলার মা-এর পরে গিয়ে হাত ভেঙে যায়। স্কুল যাওয়ার আগে সকালের খাবার, বাবার টিফিন, নিজের টিফিন বানিয়ে নিত সে। উচ্চমাধ্যমিকের পর তার বাবার শরীর খারাপ হল খুব। বাবার অফিসে গিয়ে ছুটির দরখাস্ত জমা দেওয়া, Medi-claim এর আবেদন জমা দেওয়া। প্রতিদিন হাসপাতাল গিয়ে বাবাকে দেখে আসা, বাড়ির বাজার করা, ওষুধ-পথ্য কেনা, সব নিজেই সামলেছে। কলেজে final year এ হঠাৎ বাবার মুখ দিয়ে রক্ত আসে। নিজের হাতে সে রক্ত পরিষ্কার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কোন ambulance পাওয়া যাচ্ছিলনা দেখে ক্লাব অফিসে গিয়ে পাড়ার একজনের গাড়ি যোগাড় তো সে নিজেই করেছে। সে গাড়ি আবার ব্যবহার হয়না বলে তেল ছিল না। মাঝরাতে petrol pump বন্ধ।  সেই বন্ধ petrol pump এর লোকের ঘুম ভাঙিয়ে, গাড়িতে তেল ভরে হাসপাতাল নিয়ে এসেছে বাবাকে। একবারের জন্যেও আফসোস হয়নিতো তার পাশে কেউ নেই বলে? তাহলে আজ হঠাৎ সবাই তাকে করুণার চোখে দেখছে কেন ভেবে পায়না। চোখের পাশ দিয়ে কান্নার স্রোত তখন বালিশ ভিজিয়েছে। চোখ মুছে উঠে বসে দোলা। বিছানা থেকে উঠে ঘরের দরজা লাগিয়ে আলো জ্বালায়।  ঘরের কোণে আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। সবাই তাকে করুণা করে, সে কি নিজেও নিজেকে করুণা করে? আয়নার সামনে একটা টুল নিয়ে বসে দোলা।

 চুলগুলো বাঁধন খুলে মেলে দেয় কাঁধের ওপর। পাখার হাওয়ায় কপালের সামনে কিছু চলে আসে। সেগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে কানের পাশে নিয়ে ফেলে। বেশ মিষ্টি দেখতে কিন্তু তাকে। চুলগুলো কি সুন্দর নরম। চোখের দিকে তাকালে নিজেরই ভালো লাগে নিজেকে। নিজের কথা ভেবে নিজেই হেসে ফেলে। আয়নায় সে হাসি প্রতিফলিত হয়। কে বলে, সে presentable নয়? approachable নয়? কলেজ life এ নাহলেও সাত জন propose করেছে তাকে। Rose day, chocolate day তে কত ছাত্র উজাড় করে gift দিয়েছে, Valentine's day তে তার সঙ্গ পাবে বলে। সে'সব কিছু উপেক্ষা করেছে কত অনায়াসে। আর আজ তাকেই লোকে শোনায় সে presentable নয়? আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে আর মিচকি মিচকি হাসে। শেষে নিজেই বলে ফেলে। "আমি ছেলে হলে তোর প্রেমে পরে যেতাম রে পাগলি।"

স্বগোতক্তি, নাকি আয়নার মন্তব্য। বুঝে পায়না দোলা। কানের পাশ দিয়ে ঠান্ডা একটা ঘামের স্রোত বয়ে যায়। উঠে গিয়ে fan এর speed বাড়িয়ে দেয় সে। চুলগুলো আরো অবিন্যস্ত, বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে আসে। আঙ্গুল দিয়ে চুল সরিয়ে মাথার পিছন দিকে নিয়ে যায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের শরীরটাকে দেখে একবার। "উফ! এমন ভাবে তাকাস না আমার দিকে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তোকে। তোর গন্ধটা মেখে নিতে ইচ্ছে করছে খুব।"


বহুশ্রুত একটা গানের দু'কলি মনে পরতে গুনগুন করে ওঠে দোলা। কি মনে হল আয়নায় নিজেকে কোমর দুলিয়ে নাচলে কেমন লাগে সেটা দেখার ইচ্ছে হল। Charge থেকে খুলে mobile এ headphone লাগিয়ে নিজের পছন্দের "Sun and the Stars" গানটা চালিয়ে দেয়। নিজের খেয়ালেই দু'হাত মাথার পাশে নিয়ে গানের তালে দুলতে থাকে। মনটা বেশ ফুরফুরে বলে মনে হয়। আবার একই গান play করে, আলো নিভিয়ে শুতে চলে যায়।

                                                            //৬//
পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় দোলার। খুব মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখে উঠেছে সে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। স্নান সেরে আয়নার সামনে গিয়ে বসে। কাল রাতের ঘটনা গুলো মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দেয়। আলমারি খুঁজে নিজের একটা প্রিয় শাড়ি বের করে নেয়। সবুজ, লাল আর ময়ূরকন্ঠী রং মেশানো একটা hand-loom শাড়ি। চুলটাকে খোঁপা করে একটা clip দিয়ে বাধে। ঠোঁটে লাগিয়ে নেয় মেরুন lipstick. কাজল দিয়ে চোখ আঁকে আবার বহুদিন পর। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিফলনের কাছে গিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রাখে।

"এই তো আমার মা-কে কি সুন্দর লাগছে আজ।" দোলাকে দরজার সামনে দেখে বলেন দোলার বাবা। রোজ সকালে office যাওয়ার আগে বাবার সাথে দেখা করে যায়। আজ অনেকদিন পর মেয়েকে এ'ভাবে সাজতে দেখলেন। দোলা বিছানার এক কোণে গিয়ে বসে।

"ঘুম হয়েছিল ভালো?" বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে দোলা।

"তোর কি মন খারাপ? বুড়ো বাপটা তোকে বড্ড জ্বালায়। তাই না রে মা?" দোলার হাতটা নিজের দু'হাতের মাঝে নেন দোলার বাবা।

"খুব জ্বালাও তুমি। ভাবছি এবার বিয়ে করে পালিয়ে যাব।" দোলা মুচকি হেসে বলে।

"কি কথা হচ্ছে বাপ্-বেটী তে?" চায়ের cup নিয়ে ঘরে আসেন দোলার মা।

"তোমার মেয়ে বিয়ে করে পালিয়ে যাবে বলছে।" দোলার বাবা হাসতে হাসতে বলেন।

"ও আমি বুঝি শুধু মা-এর মেয়ে। তোমার নয়?" দোলা কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলে।

"তুই তো আমার মা। হে হে! কোথায় তোর ঘটা করে বিয়ে দেব। তোর আমোদ-আহ্ললাদগুলো ভরিয়ে দেব। তা না করে নিত্যদিন তোদের দৌড় করাচ্ছি। ভয় হয় তোকে নিয়ে। ভাসিয়ে দিয়ে না যাই।" দোলার বাবা অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে নেন। দোলা বাবার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে।

"তোমার মেয়ের মেরুদন্ড কি এতই নরম বাবা? আমার বয়সে তুমি কম দায়িত্ব সামলেছিলে? গোটা পরিবার, নিজের সংসার। সামান্য salary পেতে চাকরি করে। বৌ-মেয়ে কে টেনে নিয়ে গেছ নিজের কাঁধে। এতটুকু আঁচ লাগতে দাওনি আমাদের গায়ে। সেই বাবার মেয়ে কি এতই দুর্বল? সামান্য ঝরে সে ভেসে যাবে?"

দোলার বাবা ডানহাত নিয়ে দোলার মাথায় রাখেন। তারপর গালটা টিপে দিয়ে হেসে বলেন। "পাকা বুড়ি একটা। সাবধানে office যা। আমায় নিয়ে ভাবিসনা বেশি। মন দিয়ে কাজ কর।"

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোটা পথে বাবার হাসি মুখটা মনে করতে করতে যায় দোলা। আজকের সকালটা সত্যি অন্যদিনের থেকে সুন্দর।

                                                                        //৭//
দরজা খুলে নিজের ঘরে ঢুকতেই একঝাঁক ধুলো উড়ে এলো। বহুদিনের অব্যবহারে গোটা ঘরে পুরু ধুলোর আস্তরণ। তার খাটের ওপরে মাকড়শার জালে ভর্তি। বাইরের ঘরে sofa set গুলিরও একই অবস্থা। নিজের খুব পরিচিত এই বাড়ির প্রতিটি কোণ। Computer table এর পাশে আয়না টা রাখা। বারো  বছর আগের সেই রাতের কথা মনে পরে যায় হঠাৎ।  এই আয়নায় নিজেকে অন্যভাবে চিনেছিল সে। এই আয়নাই তাকে সঙ্গ দিয়েছে এত দূর পথে হেটে যেতে। ধুলোর চাদরে মোরা আয়নার কাঁচে হাত রাখে দোলা। সময়টা বারো বছর পিছিয়ে যায়।

সে'বছর promotion পায় দোলা। ভালো রকম increment ও হয়। একদিন office থেকে ফিরে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। মা-কে phone করে জানতে পারে বাবার অসুস্থতার খবর। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে তাই। হাসপাতাল পৌঁছে বাবার ঘরে যেতে খেয়াল করে গোটা ঘরের স্তব্ধতা। বাবা ঘুমিয়ে আছে bed এ। তার মা এক কোণে মাথা নিচু করে বসে আছে। Sister রা এক এক করে বাবার শরীর থেকে Iv channel, ecg lead গুলো খুলে নিচ্ছে। বাবাকে এরকম নিশ্চিন্ত ভাবে ঘুমোতে দেখেনি দোলা বহুদিন। নীরবে বাবার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দেয় নিজে হাতে। কপালের ওপর হাত রেখে দেখে নেয়, জ্বর আছে কিনা। বুকের ওপর কান রেখে চেষ্টা করে ধুক পুক শব্দটাকে খুঁজে পেতে। Bed এর পাশে বসে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে। বাবার কষ্টগুলো আজ সত্যিই নেই। কত নিশ্চিন্ত মনে বাবা ঘুমোচ্ছে।

মা এসে পাশে দাঁড়াতে সম্বিৎ ফিরে পায়। হাসপাতালের bill মিটিয়ে বাবার দেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। তাঁর বিছানাতেই শোয়ানো হয়। পোষাক বদলে দিয়ে চন্দন ফোটা দিয়ে সাজানো হয়। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে এক এক করে আসতে শুরু করেছে। এরপর সব কাজ মিটিয়ে বাবাকে রওনা করে দেওয়া। সময় বুঝি তার চোখের জল শুকিয়ে দিয়েছিল। একটা মুহূর্তেও নিজেকে দুর্বল মনে হয়নি। কারো সহানুভূতির মুখাপেক্ষীও তাই থাকতে হয়নি। বারো বছর পেরিয়ে গেছে বাবা চলে গেছেন। কিন্তু প্রতি মূহুর্তে তিনি দোলার পাশেই ছিলেন যেমন ভাবে ছোট্ট দোলাকে আগলে রাখতেন।

অতীতের স্মৃতি মনে করতে করতে হাত দিয়ে আয়নায় জমা ধুলো সরিয়ে ফেলেছিল দোলা। নিজের প্ৰতিচ্ছবি পুরোনো দিনগুলো মনে করিয়ে দেয়। আয়নাতেই বাবার ছবিটা চোখে পরে। বিপরীত দেয়ালে টাঙানো ছিল। নিজের ঘর থেকে বাবা-মা এর ঘরে যায় সে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে। এই ক'বছরে পাড়াটা অনেক বদলেছে। নতুন নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে। কিন্তু তাদের ছাদ থেকে পশ্চিম দিকের আকাশটা এখনো অনেকটা দেখা যায়। হঠাৎ একটা বাচ্চার হাসির শব্দ শুনে ফিরে তাকায় দোলা।

একটা ফ্রক জামা পরা ছোট্ট মেয়ে তিরতির করে গোটা ছাদে ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা লম্বা লোক, সেই পরিচিত হাসি, সেই পরিচিত পোশাকে, বচ্চা মেয়েটিকে ধরতে চেষ্টা করছেন। ওই ধরে ফেললেন ছোট্ট মেয়েটিকে। তারপর সোজা কাঁধের ওপর নিয়ে বসালেন। খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটি।

"মা দেখো! আমি বাবার থেকেও লম্বা হয়ে গেছি। হি হি হি!" আবার সেই খিলখিল করে হাসি। একজন মহিলা তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছেন তিনি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ রঙটুকু মিশে আছে। সেদিকেই তাকিয়ে তিনজন।

বহুদিন পর নিজের গালের ওপর একটা পরিচিত অনুভূতি টের পায় দোলা।  তার চোখ আজ আবার ভিজে গেছে নিজের অতীতের প্রতিবিম্বে। 








  

রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭

দন্ত-বিহঙ্গ 2

অর্ক ভট্টাচার্য্য 

                                                                     //১//
কোন একদিন: ~জ্যোতিষ গুরু দিব্যানন্দ ফটাফট~



সে'বার বিয়ের মরশুমটা বেশ মরা বাজার। দাঁতের যন্ত্রণা কাবু করে দিলেও, রুগীদের বিয়ে বাড়ি গিয়ে মাংস খাওয়া স্থগিত হবে, সেই ভয়ে কেউ আসেনা দেখাতে। বাজার মন্দা হলেও রোজ নতুন উদ্যমে চেম্বার খোলেন  ড: পুন্য রঞ্জন শিকদার। রোজ আসেন, চেম্বার খোলেন, ঝার-পোছ করেন। দুপুরে সরু চালের ভাত, ফিনফিনে মুসুর ডাল আর ঝুড়ি ঝুড়ি আলুভাজা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করেন। বিকেল হলেই ফটিক গিয়ে চা, সিঙ্গারা বা আলুরচপ নিয়ে আসে। ফটিক আজ ছ'মাস হল সহকারী হিসেবে কাজে লেগেছে। বিকেলে টিফিন হলে একটু বেরিয়ে আসেন শিকদার মশাই। বাজারের কাছেই হলদি নদীর চর। বাঁধ পেরিয়ে কিছু পথ গেলেই নদী। সূর্যাস্তটা বড় অনুভূতি প্রবন এই হলদি নদীর পারে। চামুরদহের বাজারের পোস্ট-অফিসের কাছে এক বাড়ির নিচে একটি ঘর নিয়ে তার চেম্বার। আজ দু'বছরে চেম্বারের উন্নতি অনেকখানি হয়েছে। কেবল চটে যাওয়া রঙ বা খসে পরা প্লাস্টারের খরচটা তুলতে পারেননি শিকদার মশাই। এইতো গেল শুক্রবার, হাট বসেছিল। বাজার করতে আসা মানুষের দল থেকে চারজন এলেন চেম্বারে। দু'জন তাঁর সুখ্যাতির কথা শুনিয়ে নিজেদের দাঁত সারানোর বরাত ও দিয়ে গেলেন। কেবল সামনেই চারটে বিয়ে বাড়ি আছে বলে কাজ করালেন না।  

নিজের মনেই খবরের কাগজের নজর কারা খবরগুলো নিয়ে ভাবছিলেন শিকদার মশাই। এমন সময় দরজায় টোকা। 

"ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?" বাইরে থেকে প্রশ্নকর্তার রাশভারী কন্ঠস্বর ও আবেগ প্রবন আলাপ শুনে মনটা বিগলিত হয়ে যায়। শিকদার মশাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যান আগত ব্যক্তিকে স্বাগত জানাতে। ঘরের মধ্যে যিনি এলেন, দেখলেই ভক্তি জাগে। পরনে ধুতি আর মখমলের পাঞ্জাবি। কাঁধে উত্তরীয়, নিপাট করে টেরি কাটা চুল। ভুরু যুগল যেন বাধভেঙে একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। পুরু ঠোঁটের ওপর এক চিলতে গোফ। ঠোঁটের কোণে পানের লাল দাগ। এতদিন পরে এমন রুগীর পায়ের ধুলো পড়ল এই চেম্বারে। মনটা উরু উরু করতে থাকে। একমাসের খরচ উঠে যাবে প্রায় এনার মুখে যা যা কাজ হতে পারে। আপ্যায়ন করে চেয়ারে বসান শিকদার মশাই। ফটিক দুপুর অব্দি অপেক্ষা করে কাজ নেই দেখে বাড়ি গেছে খেতে। নিজেই দাঁত পরীক্ষা করার সব সরঞ্জাম খুঁজে নিয়ে চেয়ারের কাছে আসেন শিকদার মশাই। 

"হাতিবের চকের শ্যামলাল সামন্ত আমার মক্কেল। তার কাছে আপনার নাম শুনে আসা।" গোটা ঘর যেন ভদ্রলোকের কন্ঠস্বরে গমগম করে উঠল। শ্যামলাল সামন্তকে মনে পড়েনা শিকদার মশাই এর কিন্তু তবু সম্মতি সূচক ভাবে মাথা নাড়েন। আগত রুগী আবার বলে ওঠেন। 
"আপনার হাত নাকি কথা বলে মশাই। নিখুঁত ভাবে দাঁত মারি থেকে তুলে আনতে নাকি আপনার জুড়ি মেলা ভার?"

"হে হে, কি যে বলেন?" মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে নেয় শিকদার। তারপর মুখের ভিতর দেখার ছোট্ট আয়না তুলে নিয়ে প্রশ্ন করে, "বলুন কি সমস্যা?"

"আজ এক মাস হল, আমি দাঁতের যন্ত্রনা সহ্য করছি। আশেপাশে অনেকে আছে, কিন্তু ভরসা হয়নি বলে যাইনা।  শ্যামলাল বাবু সেদিন আমার দাঁত ব্যাথার খবর পেয়ে আপনার কথা বললেন।"

"কোন দিকে ব্যাথা?"

"ডানদিকের নিচের পাটি।  সব দাঁতেই এখন ব্যাথা। গোড়ার দিকে মালুম পেতাম কোন দাঁত দায়ী। এখন পুরো মারিতেই যন্ত্রনা।" রুগী মুখ খুলে মাথা হেলান দিয়ে বসেন। 

"পান খেয়ে তো সব দাঁতেরই অবস্থা খারাপ। ডানদিকের নিচের পাটির দাঁতগুলো নড়ছে রীতিমত।" শিকদার ডাক্তার রুগী দেখে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেন। প্রেসক্রিপসন টেনে নিয়ে লেখা শুরু করেন। 

"আপনার নাম?

চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের সামনে রাখা একটা টুল নিয়ে বসেন রুগী, তারপর বলেন।

"আমার নাম যোগী দিব্যানন্দ ফটাফট।"

"আজ্ঞে?" একটু হোঁচট খান শিকদার মশাই। এমন নাম জম্মে শোনেন  নি। 

"আমার নাম দিব্যানন্দ ফটাফট, বয়স দুই কুড়ি চার বছর।"

"আপনার দাঁতের যা অবস্থা, তাতে নড়ে যাওয়া দাঁতগুলো ফেলে দিতেই হচ্ছে। একমাস সময় নিয়ে মারি শুকিয়ে গেলে দাঁত বাধানোর কাজ করতে পারবো। সেই অবসরে যদি আপনি সময় দেন, বাকি দাঁত গুলির মেরামত করে নেওয়া যায়। যেমন আপনার দুটো দাঁতে সিল করতে হবে, প্রায় চারটে দাঁতে চিকিৎসা করে crown দিতে হবে। আর সবার আগে দাঁতগুলি পরিষ্কার করতে হবে।"

প্রেসক্রিপসন লিখে ওষুধ আর কি কি খরচ হবে বুঝিয়ে বলেন শিকদার মশাই। তারপর দাঁত ফেলার জন্য তারিখ বাছতে গিয়ে দিব্যানন্দ বাবু বলে ওঠেন। 

"এখনো বিয়ে করেননি কেন?"

হঠাৎ এমন প্রশ্নে বেশ হতচকিত হয়ে যান শিকদার মশাই।  "সময় হয়নি আরকি। কেন?"

"দেখি আপনার হাতখানা।" কিছু বোঝার আগেই শিকদারের ডান হাত নিয়ে দেখতে শুরু করেন দিব্যানন্দ বাবু। 

"হুম! বিবাহ স্থানে শনির যোগ। আপনার বুঝি শনিবারে জন্ম? গোধূলি লগ্নে?"

ভদ্রলোকের কন্ঠের দৃপ্ত ভঙ্গি, আর চিবুকের কাঠিন্য শিকদার মশাইকে ভালোই বশ করে নেয়। 

"ছেলেবেলা থেকেই বুঝি অমনোযোগী? পড়াশোনায় মন ছিল না?"

শিকদার আবার সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে জবাব দেয়। 

"ধনস্থানে কেতুর যোগ। বিষয়-আসয় খুব বেশি করে উঠতে পারেননি।"

"আজ্ঞে কি করে করি বলুন? মাস গেলে সাকুল্যে আট আনা আয় হলে, চোদ্দ আনা ব্যায়। বাকি টাকা জোগাড় করতে ধারকর্জ করতে হয়। তার ওপর বাজারের যা অবস্থা। বিয়ে করলে খাওয়াবো কি? তাই আর। ..."

"হুমম!" গভীর মনোযোগের সাথে হাতের রেখার দিকে চোখ রাখেন দিব্যানন্দ। 

"আপনার এই লাইনে আসা ঠিক হয়নি মশাই। ব্যবসা আপনার হাতে নেই। তার মানে আপনি ডাক্তার ভালো নয়, সে'কথা ভাববেন না। কিন্তু এটাও তো একরকম ব্যবসা। আপনি বড় সরল মানুষ। আপনাকে ঠকিয়ে লোকে  বড়লোক হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি উন্নতি করতে পারবেন না। এবার থেকে কোন চুক্তি কারো সাথে করলে দেখবেন বামদিকের চোখ ফরফর করে কাঁপছে কিনা। যদি কাঁপে বুঝবেন রাম ঠকা ঠকবেন। "

"তাহলে উপায়?" শিকদার বেশ আতঙ্কিত ভাবেই জিজ্ঞেস করে ফেলে। 

"চিন্তার কিছু নেই। কেতু কে শান্ত রাখতে ও বৃহস্পতির কৃপা পেতে পোখরাজ ধারণ করুন। বিবাহ স্থানে বুধের উপস্থিতি আপনার জন্যে একটু সুবিধা দিত। কিন্তু সে উপায় করতে হলে আপনার একটা ছক বানাতে হবে। তারপর। ....."

"আজ্ঞে বিয়ের থেকেও আমার টাকার প্রয়োজনটা বেশি। যদি সে'ব্যাপারে কিছু?" শিকদার মশাই বলে ফেলেন।

"ঐশ্বর্য লাভ কি এতই সোজা? মূলাধার চক্রে ঠেলা দিয়ে, কুল-কুন্ডলিকার আজ্ঞাক্রমে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়। গ্রহের অবস্থান পাল্টে ফেলে বৃহস্পতির কাল বিচার করতে হয়। সেই কালে সময়ের অক্ষ স্থাপন করে কালের উল্টো স্রোতে সহস্র ধারার মাঝে ধনস্থানে কেতুর আবাহন করতে হবে। সে কি আর এতই সহজ বাবা?"

"আজ্ঞে না। তাহলে?" বেশ হতাশ হয়েই বলেন শিকদার মশাই।

"আর কিছুই না, মুক্ত ধারণ করুন নিজেকে শান্ত রাখতে। সোমের কৃপায় মতি যেন স্থির থাকে। রোজ সকালে উঠে পুব দিকে চেয়ে সূর্য প্রণাম করুন নিয়ম মেনে। বৃহস্পতি র মঙ্গলবারে ক্ষুর ছোয়াবেন না। শনিবারে নিরামিষ খান। আর তেলেভাজা খাওয়া ছাড়ুন। এঁটো তেলের রান্না আপনার রাহুস্থানে নিয়ামক। শনির শক্তিও বৃদ্ধি পায়। "

সব বুঝে নিয়ে বেশ ঘাবড়ে যান শিকদার মশাই। ফটিক না এসে পড়লে ঘোর কাটতেই না। রাশিফল, গ্রহ-নক্ষত্রের আবহাওয়া যেন এখনো আছন্ন করে রেখেছে শিকদার কে। শিকদার এর মোহগ্রস্ত ভাব বোধয় টের পেয়েছিলেন দিব্যানন্দ। একটা মিহি কাশির ধমক এনে উঠে পড়েন।

"আচ্ছা, আজ তাহলে আসি। এই ওষুধগুলো ধারে-কাছের দোকান থেকে পাওয়া যাবে তো?"

একটু সময় লাগে শিকদারের নিজেকে ফিরিয়ে আনতে।  তারপর আশ্বাস দেয় সব ওষুধ এখানেই পাওয়া যায় বলে। দিব্যানন্দ পাঞ্জাবির পকেটে প্রেসক্রিপসন ভরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

"আজ্ঞে আমার fees ৫০টাকা।" শিকদার উঠে দরজার কাছে যান।

"আমার fees ২৫০টাকা। আমি জ্যোতিষগুরু দিব্যানন্দ ফটাফট। ব্রজলালচকে আমার চেম্বার। ছক বানাতে ৪০০টাকা, সমস্যা সমাধানের জন্যে রত্ন আমার কাছেই পাবেন। একমাসের মধ্যে এলে আপনার জন্যে special discount এর ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আজকের fees টা নিলাম না। তবু আপনার সাথে সমান করতে, আমি ২০০টাকা পাই। আপনি নেহাতই নবীন আমার থেকে। তাই কিছু চাইলাম না। ঠিক আছে, আজ চলি। নমস্কার।"

বামদিকে চোখের নিচটা কেমন যেন ফরফর করে কেঁপে উঠলো শিকদার মশাইয়ের। অস্তগামী সূর্য লাল আবির ছড়িয়ে দিয়েছে সবদিকে। পথে লোকের আনাগোনাও বেড়েছে। চা দোকানি উনুন ধরিয়েছে, তার ধোয়া গোটা বাজার জুড়ে। ঐপারে তেলেভাজার দোকানে বড় কড়াইতে ডালডা ঢালা হল। ব্যস্ত বাজারের ব্যস্ত পথ নিজের মতোই চলতে থাকে। এক কোণে ভাঙা বাড়ির নিচে এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিকদার ডাক্তারের বামদিকের চোখের নিচ তখনো ফরফর করে কাঁপছে।





  


মূল কাহিনী কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। স্থান, কাল ও পাত্র সম্পূর্ণ কল্পিত চিত্রণ।

ছবি: S. Rai




রবিবার, ৫ মার্চ, ২০১৭

দন্ত - বিহঙ্গ 

                                                                   //১//
গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয় ফটিক। ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম থেকে সবে গতি নিয়েছে। এই ট্রেন ফস্কে গেলে আজ আর চেম্বার করা হবে না। ব্যাগ ভর্তি দাঁত তোলার সরঞ্জাম, সেই ভার নিয়েই দৌড় দেয় সে। ফটিকের তুলকালাম দৌড়ের সাথে তারাও কলতান জুড়েছে। ঝনঝন, ঠুনঠুন, আরো কত রকম শব্দের বিন্যাসে ফটিকের দৌড়ের cinematic background তৈরী করছে। সিনেমার নায়কের মত ধীর-প্ৰক্ষেপণে কল্পনা করে নিজেকে। কপালের ঘাম বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে নিখাদ নায়কোচিত রাগের আলাপ। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন Olympicএর professional দৌড়বাজদের মত। শেষ কামরার শেষ দরজার হাতল ধরে লাফ দিতেই confidence টা একটু ঘোলাটে হয়ে যায় ফটিকের। টিকিট তো কাটা হলনা? ঢং করে একটা আওয়াজ হল মাথার ওপর। তারপর ছলাৎ করে আঁশটে গন্ধওয়ালা জল ভিজিয়ে দিল ফটিকের ঘামে ভেজা জামাকে আরো কয়েক প্রস্থ। কামরার পা-দানিতে সঠিক সময় পা রাখা হলনা। গেটের পাশে ঝুলে থাকা এক মাছওয়ালার হাড়িতে লাফ দেবার সময় গুতিয়ে ফেলেছে সে। আর তাতেই ঢং, আর তৎ পর ছলাৎ। ট্রেনের গতির সাথে খানিকটা দৌড়েও ভরবেগ সমান রাখতে পারেনা। পিঠের বোচকা ভারি ব্যাগটা অকালকুষ্মান্ডের মত সামনে এগিয়ে ভারকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটায়। আর তাতেই হুমড়ি খেয়ে একেবারে পপাত চ। ধুলিকৃত প্ল্যাটফর্মে খানিক গড়িয়ে ও খানিক ডিগবাজি খেয়ে আপাত গতিবেগ রুদ্ধ হয়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষন ঐভাবেই পরে থাকে মেঝেতে। মাছের গন্ধে গা ঘিনঘিন করছে তার। আজকের দিনটাই খারাপ। সকাল সকাল এমন কান্ড প্ল্যাটফর্মে বেশ শোরগোল ফেলে দেয়। কিছু নেতা ও আঁতেল গোছের কাকু এগিয়ে আসেন 'আহা আহা!!' করে।    


"অমন বেয়াক্কেলের মত ঝাঁপ দিতে গেলেন কেন? Running ট্রেনে ঐভাবে কেউ ওঠে?" একজন ষণ্ডা মতন লোক ফটিককে হ্যাচকা টানে তুলে পাশের বেঞ্চিতে বসিয়ে প্রশ্ন করে। কয়েকজন সমব্যাথী ব্যাগ থেকে ছিটকে পরা যন্ত্রপাতি কুড়িয়ে এনে দেয়। 

"আপনার ব্যাগটা একবার দেখে নিন মশাই। সবকটা screwdriver আর plus আছে কিনা।"

নাকে ধুলো আর মেছো জল ঢুকে বন্ধ হয়েছিল বলে ফোতফোঁৎ করে নাক ঝাড়ছিল ফটিক। তার দাঁত তোলার সরঞ্জামের এ'হেন্ নামকরণ শুনে খানিকটা ধুলো নাক দিয়ে টেনে ফেলে ভুল করে। তারপর অবাক দৃষ্টিতে উপস্থিত সবার দিকে ক্ষণিক তাকিয়ে থেকে "যাছ্যাৎ!" শব্দে বিকট ভাবে হেঁচে ফেলে। উপস্থিত ত্রাতাদের মধ্যে কয়েকজন চমকে উঠে নিজের জিভ কামড়ে ফেলে। প্ল্যাটফর্মের এক কোণে বসে এক ভিখিরী খুচরো পয়সা ভর্তি বাটি ঝাকিয়ে ভিক্ষে করছিলো। হাঁচির শব্দে চমকে ওঠায়, সব খুচরো পয়সা ছিটকে পরে বাটি থেকে। তাদের মিলিত পতন যেন গোটা প্ল্যাটফর্মে করতালির মত শোনায়। একটা বাচ্চা বেঞ্চির একপাশে বসে বরফজল খাচ্ছিলো। হাঁচির শব্দে ভয় পেয়ে গোটাটাই হাত থেকে পরে যায় বলে কান্না জুড়ে দেয়। 

"মশাই তো হাঁচির জন্যে ভারতরত্ন পেতে পারেন দেখছি।" সহমর্মীদের একজন মন্তব্য করে বসে। 

এমন সময় কিছু সহৃদয় ব্যক্তি স্টেশন মাস্টারকে ধরে নিয়ে আসেন। ট্রেন থেকে পরে একজন গুরুতর আহত এই মর্মে। শারীরিক আঘাত তেমন গুরত্বপূর্ন না হলেও, ট্রেন মিস করে মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল ফটিক। তার ওপর স্টেশন মাস্টারকে দেখে ভয় এসে কাঁধে চাপে। স্টেশন মাস্টার অবশ্যি খুবই সজ্জন ব্যক্তি। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জিজ্ঞেস করলেন,
"এত তাড়াহুড়োর কি ছিল মশাই। আধ ঘন্টা অন্তর তো ট্রেন। একটা নাহয় মিস হত। এমন ভাবে কেউ ঝুঁকি নেয়?"

"আজ্ঞে না।" মুখ কাচুমাচু করে বলে ফটিক। "আধ ঘন্টা নয়, আবার এক ঘন্টা পর ট্রেন।"

"বাহ্! যাবেন কোথায় আপনি?" স্টেশন মাস্টার আরেকবার নিজের কপালের জমা ঘাম মুছে নেন। 

"আজ্ঞে ক্যানিং যাবো।" ফটিক আবার কাচুমাচু মুখ করে বলে। 

"ভারি আজব মানুষতো আপনি। যাবেন ক্যানিং এ, এদিকে আছাড় খেলেন নামখানা লোকাল থেকে? কোন ট্রেনে উঠছেন দেখেন না?"

এবার সত্যিই নিজেকে বুৰ্বক বলে মনে হয় ফটিকের। নিজের আক্কেল দেখে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হয়। অবশ্য নিজের আক্কেল সম্পর্কে কোন কালেই খুশি নয় সে। নইলে এই মরা বাজারে কেউ দাঁতের ডাক্তার হয়? উচ্চ-মাধ্যমিকের পর যে উৎসাহে দন্তচিকিৎসক হবে বলে দাঁত-কারী কলেজে ভর্তি হয়েছিল, সব উৎসাহ নিমের পাচনের মতই তেঁতো এখন। চারিদিকে এত দাঁতের ডাক্তার যে দন্ত চিকিৎসক হয়েও কলকাতার বাজারে দাঁত ফোটাতে পারলো না সে? সাধে কি আর ক্যানিং মেচেদা ছুটে বেড়াতে হয়। 

                                                                    //২//
"ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?" চেম্বারের বাইরে কেউ বলে ওঠে। 
"একটু দাঁড়ান, আসছি।" ফটিক জবাব দেয় চেম্বারের ভিতর থেকে। 
কিছু পরেই প্রায় নীলবর্ণ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে ফটিক। একদম চাতালে এসে কুঁজো হয়ে দম নেয়।
আগত ব্যক্তি ডাক্তারের এমত অবস্থা দেখে সংকিত হয়ে এগিয়ে আসেন। 

"কি ব্যাপার? শরীর খারাপ নাকি?"

"আজ্ঞে না। ভিতরে ধূপ জ্বেলে পুজো দিচ্ছিলাম। আমার আবার ধুলো ধোঁয়ায় বড় এলার্জি কিনা! তাই দম আটকে পুজো করি।"

চেম্বার খোলার পরে নিত্যকর্ম পদ্ধতি পড়ে পুজো দেওয়ার অভ্যেস ফটিকের। পুজোর বিষয়ে বাকি সব কিছুই ঠিক থাকলেও, এই ধূপ ধুনোয় তার বড় অসুবিধে। একটুখানি নাকে গেলেই ব্যাস। একশ চব্বিশ বার না হাঁচলে, থামে না। এদিকে পুজোর এই বিশেষ অধ্যায়টা বাদ দিলেও চলে না। সকাল সকাল এসে চেম্বার খুলে, নাকে রুমাল বেঁধে ঝাড়পোছ করে, পুজো দেয় ফটিক। ক্যানিং এর এই চেম্বারে তার পসার এখন ভালোই জমেছে। গেল পৌষে তার রুগীর সংখ্যা দুই পেরিয়ে চার হয়েছিল। সেই থেকে তার দৃঢ় বিশ্বাস। এই চত্তরে তার মত দন্তচিকিৎসক আর নেই।

দম আটকে প্রায় পাঁচ মিনিট ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে, ধুনো দিয়ে চেম্বার থেকে বাইরে আসে ফটিক। তারপরে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে আবার চেম্বারে ঢোকে। আগত ব্যক্তি রুগী না পর্যটক সে বিষয়ে এখনো কিছু জানে না ফটিক। কিন্তু আগন্তুকও পিছুপিছু চেম্বারে এসে ঢোকে। নিজের সাধ করে বানানো কাঠের চেয়ারে গিয়ে বেশ সাহেবি কেতায় বসে গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে আগন্তুককে বসতে বলে। আগত ব্যক্তি তখন চেম্বারের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষনে ব্যস্ত। ডাক্তারবাবু বসতে বলায় ছোট্ট করে নমস্কার ঠুকে রুগী বসার একটা টুল নিয়ে টেবিলের সামনে এসে বসে।

"বেড়ে সাজিয়েছেন কিন্তু আপনার ডিস্পেন্সারি। নাহ! এ'জিনিস এই তল্লাটে কেউ দেখেনি।"

আগন্তুকের প্রশংসা শুনে বেশ গদগদ আহল্লাদিত হয়ে, মাথা নিচু করে হেসে নেয় ফটিক।

"তা আমার যা সাধ্য, সেই মতোই সাজিয়েছি। অতিরিক্ত কিছু নেই।" ব্যাগ থেকে প্রেসক্রিপসন প্যাড আর কলম বার করতে করতে বলে ফটিক।

"না না। তাও যেভাবে সাজিয়েছেন, ক'টা ডাক্তার পারে?"

"হে হে!! ধন্যবাদ। বলুন। কি সমস্যা আপনার?"

আগন্তুক এবার যেন প্রশংসা থেকে বিরত হওয়ার সময় এসেছে বুঝে যায়। একটু থেমে বলেন।

"আজ্ঞে সমস্যা ঠিক আমার নয় ডাক্তারবাবু। আমার মেয়ের।"

"কি ব্যাপার?" ফটিক উৎসাহিত হয়।

"প্রায়ই বলছে, দাঁত মাজতে গেলে নাকি মাড়ি দিয়ে রক্ত আসছে। কি করা যায় বলুন দেখি?"

"বেশ তো, মেয়ে কে নিয়ে চলে আসুন। দেখে নিচ্ছি।"

একটু যেন বিপাকে পরেন আগন্তুক ভদ্রলোক। ক্ষণিক বিরতি নিয়ে বলেন,

"তাকে এখন পাই কোথায় বলুন? সে তো এখন কলেজে। কাল কি আপনি বসেন? তাহলে আমি তাকে নিয়ে আসব।"

"আমি তো এখানে সপ্তাহে দু'দিন বসি। আমি আবার আসব শুক্রবার। সেদিন নিয়ে আসবেন নাহয়।"

"ওরে বাবা! তাহলে এই ক'দিন রক্ত আসলে কি করব?"

ফটিক যেন একটু বিপাকে পরে যায়। সত্যি তো। একজনের সমস্যা জেনেও সে কোন উপকার না করে, শুক্রবার অব্দি অপেক্ষা করবে? মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। ভদ্রলোকটিকে দেখেই মায়া হয়। মাথার ওপর পরিপাটি টাক, উপরের পাটির সামনের দাঁতের অগ্রদূত মূর্তি গোফের আড়ালে লোকানো ভাবাবেগ মিশ্রিত হাসির উজান এনে দেয় যেন। কি মনে হল, ব্যাগ থেকে একটা মলম আর কুলকুচির ওষুধ বেড় করে টেবিলের ওপরে রাখে ফটিক।


"এই মলম নিয়ে যান। মেয়েকে বলুন নিয়ম করে, দু'বেলা মাড়িতে মালিশ করতে। আর প্রতিবার খাওয়ার পরে এই কুলকুচির ওষুধ দিয়ে কুলি করতে। শুক্রবার আমি দেখি। তারপর নাহয় কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।"

ওষুধগুলি হাতে নিয়ে আগন্তুক আবার বলে ওঠে।

"আমার স্ত্রীরও জানেন তো দাঁতের সমস্যা। এত অযত্ন করে, কি আর বলব। পিছনের মাড়িতে একটি দাঁত ও অবশিষ্ট নেই। সব কটির গোড়া পরে আছে। এখন তো প্রায়ই শুনি মাড়ি ফুলে ওঠে নাকি।"

ফটিক আরো খানিকটা আহল্লাদিত হয়ে ব্যাগের ভিতর হাত দেয়।

"দাঁতের গোড়া পরে থাকা খুব একটা ভালো জিনিস তো নয়। এক কাজ করুন না। শুক্রবার আপনার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে আসুন। এই ওষুধগুলি নিয়ে যান। আজ থেকে খাওয়ানো শুরু করলে আমি শুক্রবার দাঁত কিছু তুলেও দিতে পারব তাহলে।"

দু'পাতা ওষুধ পকেটে ভরে পেন্নাম ঠুকে উঠে পড়েন আগন্তুক। "আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো ডাক্তারবাবু। আচ্ছা আজ আসি তাহলে, শুক্রবার দেখা হচ্ছে।"

"ওষুধগুলোর দামটা একটু দিতে হত।" পিছু ডেকে ফেলে ফটিক।

আগন্তুক ফিরে আসেন। "ওবাবা! এগুলোর দাম আছে নাকি?"

"আজ্ঞে হা! এগুলো বিক্রির ওষুধ।"

"আমি তো আমার ভগ্নিপতির কাছে আপনার সুখ্যাত শুনে খবর নিতে এসেছিলাম ডাক্তারবাবু। টাকা-পয়সা তো সঙ্গে আনিনি। শুক্রবার এগুলোর দাম দিলে হবেনা? নইলে আপনি রেখে দিন, আমি শুক্রবার এসে নিয়ে যাবো।"

ভারি লজ্জায় পরে যায় ফটিক। "আরে না না। পরদিন আসুন, একেবারেই দিয়ে দেবেন নাহয়।"

অনেক আশীর্বাদ ও ধন্যবাদ জানিয়ে সকালের আগন্তুক বিদায় নেয়। শুক্রবার সকালের জন্যে দু'টো রুগী পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে নেচে উঠল যেন। শুক্রবার কি কি করবে সেইসব ভেবে ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে পাঁচশ বাতাসা মানত করে ফেলে ফটিক।

                                                                         //৩//
"ন্যাপলা এখানে কি করতে এসেছিল?"

ঠাকুরের ছবির পানে তাকিয়ে চোখে জল এসে গেছিল ফটিকের প্রায়। গোটা মাস যে রুগীর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, একদিনের সকালেই দুটো রুগীর বরাত পাওয়া কি মুখের কথা? ভগবানের অসীম কৃপা ছাড়া কিই বা হতে পারে? এ'সব ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্থায় হঠাৎ নিজের ঘরে কারো কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে ফটিক।

"কে? কে এসেছিল?" ফটিক দরজার দিকে তাকায়। ঠাকুরকে আরো কিছু উপঢৌকন মানত করেই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু মাঝ পথে বাধা পরে।

"ন্যাপলা।  ন্যাপলা কি করতে এসেছিল তোমার চেম্বারে? বেরোতে দেখলাম মনে হল?" তামীম শেখ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন। এক কালে এখানকার নাম করা হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন। ফটিক এর যুবা বয়সের মেহনত দেখে মাঝে মধ্যে আড্ডা মারতে আসেন। এখানকার ইতিহাসের গল্প করেন। রুগী না থাকলেও, তামীম শেখের সাথে গপ্প করে আর হুঁকো টেনে সময় যেত ভালো।

"আপনি ওনাকে চেনেন নাকি?" ফটিক নিজের জায়গায় এসে বসে।

"চিনি মানে? ওর মত হাড় বজ্জাত আর একটাও আছে নাকি এই গ্রামে?"

ঢোকটা গিলতে গিয়েও মাঝ পথে আটকে যায় ফটিকের। বিষম খেয়ে বলে, "উনি নিজের স্ত্রী ও মেয়ের জন্য নাম লিখিয়ে গেলেন। আগামী শুক্রবার সকালে।"

"ন্যাপলার আবার স্ত্রী-কন্যা কবে হল? ব্যাটা বিয়েই করেনি।"

জোড়ালো একটা বিষম খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় ফটিক।

"তার মানে?"











                                                                          //৪//
রবিবার করে চৈতন্যপুর বলে এক মফস্বলে চেম্বার করতে যায় ফটিক। শনিবার রাতে চলে আসে। পরদিন চেম্বার করে বিকেলের ফেরীতে বাড়ি যায়। কলকাতা থেকে সময় লাগে প্রায় ছ'ঘন্টা। Diamond harbor road ধরে প্রথমে আসতে হয় রায়চক। সেখান থেকে ফেরীতে নদী পেরিয়ে কুঁকড়াহাটি। কুঁকড়াহাটি থেকে বাসে এক ঘন্টা গেলে চৈতন্যপুর। শনিবার বেহালার চেম্বার থেকে বেরোতে একটু দেরী  হয়ে যায়। মালিকের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। ফটিক আবার নিমন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়া একদম পছন্দ করে না। সে যত কাজই থাকুক, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ঠিক পৌঁছে যাবে। আর যাই হোক, খাবারের প্রতি অভক্তি করা চলে না।

রায়চক আসার পথে সুখের ঢেকুর তুলতে তুলতে দুপুরের আয়োজনের কথা ভাবছিলো সে। খেয়ে-দেয়ে উঠেই চলে আসায় বিশ্রাম হয়নি ঠিক। তাই একটু আইঢাই করছে। ফেরী পার করে, কুঁকড়াহাটি পৌঁছে একটা সিগারেট খেয়ে নেবে। শেষ বাস সাড়ে সাতটায়। পরিকল্পনাগুলো আরেকবার সাজিয়ে নিয়ে চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে উপভোগ করতে থাকে। কি সুন্দর এখানের সব কিছু। ধানের ক্ষেত, সর্ষের ক্ষেত , কুড়ে ঘর।  পুকুর ভর্তি পদ্ম, শালুক ফুটে রয়েছে। একটা গাছের ডালে অনেকগুলো বক বসে আছে। অবাক পৃথিবীর অবাক শোভায় মগ্ন হয়ে যায় ফটিক। দুপুরের অমন খাওয়া, তারপর গতিমান বাসের জানলা দিয়ে প্রকৃতির  রূপ। চোখে ঘুম নেমে আসে ফটিকের।


ঘুম ভাঙলো মাথায় কিছু পড়ায়। ওপরের বাংক থেকে কারো জলের বোতল গড়িয়ে বাসের ঝাকুনি আর অভিকর্ষের টানে সরাসরি অবতরণ করে ফটিকের মাথায়। সবে তখন ফটিকের সংকীর্ণ নাসা পথে নির্গত বাতাস, তরুণাস্থির কম্পনে আন্দোলিত হয়ে গুরু গম্ভীর নিনাদ সুর সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। স্বপ্নের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে সে দেখছিলো, গ্রামের পঞ্চায়েত তাকে সম্মবর্ধনা দিচ্ছে।  ভাষণ দিচ্ছেন ফটিকের মহানুভবতা নিয়ে। দুম করে মাথার ওপর কিছু একটা পরে ঘুম ভেঙে গেলেও, হাত তালি দিয়ে ওঠে সে। একটু হুঁশ ফিরতে পাশে বসা সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়। মাথার আঘাতটাও টের পায়। বেশ টনটন করছে একটা জায়গা। কিন্তু বলার বা করবার মত কিছু না পেয়ে, জলের বোতলটা পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে সহযাত্রীকে ফেরত দেয়। স্বপ্নটা বড় ভালো ছিল, কিন্তু ঘুমটা আর আসলো না।

বাস থেকে নেমেই সবাই দৌড় দেয় ফেরীর টিকিট কাটার জন্যে। ফটিক এখন আর দৌড়ায় না। একটু সংযত হচ্ছে আজকাল। মা-এর নিষেধ ও রয়েছে। কাজেই ধীরে সুস্থে নিজের ব্যাগ নিয়ে টিকিট কাউন্টারে এসে দাঁড়ায়। টিকিট হাতে পাওয়ার পর ঘাটের কাছ থেকে 'ভোঁ আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে সাতটার ফেরী রওনা দিচ্ছে। এখন দেরি করলে সত্যি সর্বনাশ। ওপারে ঠিক সময় না পৌঁছালে বাস বেরিয়ে যাবে। আর শেষ বাস বেরিয়ে যাওয়া মানে পদযাত্রা ছাড়া গতি নেই।

ভরপেট খেয়ে এমন দৌড় দেওয়া সত্যি কষ্টের। ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে যখন ফেরীর কাছে  পৌছালো, জেটি থেকে তখন একহাত দূরে vessel . সব বিপদের থেকেও বড় বিপদ বাস না পাওয়া। সুবিধা বুঝে লাফ দিলো ফটিক। vessel এ উপস্থিত যাত্রীরা দেখল সেই কালজয়ী লাফ। হনুমান যেমন সাগর পেরিয়ে লঙ্কা পৌঁছে ছিল। ফটিকের অভিব্যক্তিও খানিকটা সেরকম। ফেরীর rod এ গিয়ে ধাক্কা খেতে কোৎ করে একটা শব্দ আসে ফটিকের মুখ থেকে। ব্যাগের ভারে আরেকটু হলেই জলে পরে যেত ফটিক, কিন্তু কিছু সহকারীর সাহায্যে সে যাত্রা আর কোন বিপদ ঘটেনি। কেবল একটা টিফিন এর ব্যাগ ধাক্কা সামলাতে না পেরে জলে পরে গেল।

পারে উঠে টিকিট দেখিয়ে বাইরে আসতে চৈতন্যপুর লেখা বাস সামনেই দাঁড়ানো দেখে নিশ্চিন্ত হয় ফটিক। বাসের কাছে গিয়ে ফাঁকা বাস দেখে মনটা আরো প্রফুল্য হয়। এতটা পথের ধকলে বেশ খাটনি গেছে। এদিকে সিগারেট খাওয়া হয়নি অনেক্ষন। ফাঁকা বাস দেখে নিশ্চিন্ত ছিল ফটিক, না ভরলে তো আর ছাড়বে না। সেই ফাঁকে বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোয়া দেওয়া যাক। একটা সিগারেট ধরিয়ে চা দোকানে ঢোকে ফটিক। নজর রাখে বাসের দিকে। লোক উঠতে শুরু করলেই, ছুটতে হবে। চা-বিস্কুট পর্ব শেষ করে একটু প্রয়োজনীয় কর্মের তাগিদে, চা দোকানের পিছনে যায় ফটিক। ফিরে এসে চায়ের দাম মিটিয়ে জিজ্ঞেস করে,

"কি ব্যাপার? আজ চৈতন্যপুরের বাসে ভিড় নেই?"

"কি বলছেন দাদা, ঐদিকে একবার চেয়ে দেখুন?" চা দোকানি পয়সা ফেরত দিয়ে বলে।

বড় রাস্তার কাছে উপচে পরা ভিড় নিয়ে একটা বাস এগিয়ে যাচ্ছে। ফটিকের সব হিসেবে গোলমাল হয়ে যায়।

"তাহলে এই বাস টা কোথাকার?"

"এটাতো কাল সকালের ফাস্ট বাস। ঐদিকে আজকের শেষ বাস বেরিয়ে গেলো তো।"

দোকানির কথাগুলো বজ্রাঘাতের চেয়েও নির্মম বলে মনে হয়। ব্যাগ নিয়ে আবার দৌড় দিতে হয় ধোয়া উড়িয়ে চলে যাওয়া বাসের পিছনে। ফটিকের এই দন্ত-বিহঙ্গ জীবনের আরেকটি অধ্যায় রচনা হয় ধুলো মাখা পথের ধারে চৈতন্যপুরগামী বাসের পশ্চাৎ ধাবনে।












শনিবার, ৪ মার্চ, ২০১৭

মধ্যবিত্ত্ব। ....... 


                                                                       //১//
ঘরটা বড় অন্ধকার বলে মনে হয়। ডাক্তারি যন্ত্রপাতির হলুদ-সবুজ আলোগুলো গোটা ঘরের শেষ সম্বল যেন। মুখের ওপর oxygen mask টা খুব বিরক্তিকর। এমন এঁটে বসেছে গালের সাথে খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এমন সময় বুকের ঠিক একপাশ দিয়ে চিন চিন করে একটা ব্যাথা উঠতে শুরু করে। ঘরের AC টাও বোধহয় বড্ড বেশি বাড়ানো আছে। শীতটা এমন জাঁকিয়ে অনুভব কোনদিন করেনি সে। আজ প্রথমবার। বুকের পাঁজরগুলো, যা এতদিন তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর সহকারী ছিল, তারাও যেন বিরতির অপেক্ষায়। কেবল হৃদযন্ত্রের তাড়নায় তাদের সঞ্চালন অব্যাহতি পাচ্ছে না। এক মুহূর্তে ছুটি পাওয়ার জন্যে তারা যেন ওঁৎ পেতে আছে। ঐ দূরে কে যেন তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ঝাপসা, দৃষ্টিটাও ঝাপসা আজ। ক্রমাগত অন্ধকার কে সাথী করে সে যেন নেমে আসছে চোখের চারপাশে। বুকের ব্যাথাটা আরেকধাপ বেড়ে জানান দিলো তাদের কর্মবিরতি declare হতে, আর দেরী নেই। হৃদযন্ত্রের ধুকপুক শব্দটা গলার খুব কাছে উঠে এসেছে। আরেকবার চেষ্টা করে সে oxygen mask এর বদ্ধ ক্ষেত্র থেকে জীবন বায়ুকে প্রশ্বাসে ভরে নিতে। নিজের হাত-পা এর অবস্থানও যেন মালুম হয় না আর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়াটা এখন অনেক কাছে। শেষ বুঝি এসেই গেল। বন্ধ হয়ে আসা চোখের পাতাদুটো আরেকবার খোলার চেষ্টা করে। যতটুকু আলো আসে, সেই সবটুকু আগ্রাসী ভাবে দেখতে ইচ্ছে করে। অচেনা ছায়ার সামনে নিজেকে বড় অসহায় লাগতে থাকে। সব কিছু থেকে পালিয়ে এসেও এবার আর উপায় নেই। আরেকবার চেষ্টা করে প্রাণ ভরে প্রশ্বাস নিতে। ফুসফুস দুটো নিঙড়ে ইচ্ছে হয় সমস্ত দূষিত বাতাস বের করে দিতে। আরেকবার, শেষ বার। অর্ধোচ্চারিত প্রায় অশ্রুত স্বর কন্ঠনালী বেয়ে একটা শব্দ করে, "মা".

                                                                        //২//
"তুমি চাইলেই আমাদের সাথে এসে থাকতে পারো। কিন্তু না। সুখ তোমার কপালে সইবে কেন? এমন মা-বাবার সাথেই তোমার থাকতে ভালো লাগবে।" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আকাশের দিকে তাকায় বনানী। আকাশ যেন নীরবে বনানীর এইরূপ এর তারিফ করছে। এমন উপদেশ সত্যি বিরল। নিজের মা-বাবা কে ছেড়ে প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে থাকাই যায়। এরকম সহজ সরল সমাধানটা এতদিন তার মাথায় আসেনি কেন, সেটাই ভাবছিলো আকাশ।
"কি দেখছ অমন করে?" বনানী আবার প্রশ্ন করে।
"তোমাকে। কি সুন্দর সহজ ভাবে আমায় সত্যিটা বলে দিলে। সত্যিই তোমার জবাব নেই। তোমার বাবা বলেছিলেন বটে, আমাদের দোকান ঘরটা ওনাকে দিলে আমায় একটা গাড়ি বা বাইকের showroom বানিয়ে দিতেন।"
"কিন্তু তুমি রাজি হলে তবে তো।"
"না! সত্যি বড় বোকামি করে ফেলেছি। দোকানটা তোমার বাবার নাম লিখে দিলে আজ আমার জীবন টা তৈরী হয়ে যেত গো!" আকাশ খুব হতাশ ভাবেই বলে কথাগুলো।
"এখনো সময় আছে। বাবা আমার জন্যে পাত্র দেখছে, কিন্তু পছন্দ হয়নি। তুমি যদি রাজি হয়ে যাও showroom, রাজারহাটে নতুন ফ্ল্যাট, আর গাড়ি, সব পাচ্ছ। বিয়ের পরে honeymoon trip টাও দাদাভাই দেবে বলেছে Europe tour. ভাবো আকাশ, একবার ভাবো। আমাদের নতুন সংসার। নতুন জীবন।"
আকাশ একবার হাসে শুধু। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে বনানীদের বাড়ি থেকে। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনানীর নম্বরটা block list এ add করে দিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি এবার। আকাশ যেন একটা বুক ভরা শ্বাস নেয় ফাঁকা রাস্তায় উঠে। এবার নিশ্চিন্তে যাওয়া যেতে পারে।

সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে দুই বাড়ি পরিচিত হবার পর থেকেই। আকাশের বাবা সামান্য সরকারি স্কুলের শিক্ষক, অন্যদিকে বনানীর বাবা দুটো কারখানার মালিক। ব্যবসায়ী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা বনানীর জন্যে সামান্য মাইনে পাওয়া মাস্টারের বাড়িতে বৌ হয়ে আসা একটু সমস্যার। প্রথম দর্শনেই বনানীর বাবা সম্পর্ক ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বনানীর জেদের কারণেই আকাশকে ডেকে পাঠান। নিজের কিছু শর্ত সামনে রাখেন। আকাশ ইচ্ছে করে সব শর্ত নাকচ করে দিয়ে চলে এসেছিল। ভেবেছিল, বনানী এগুলির প্রতিবাদ করবে। তার বদলে, বনানীও নিজের বাবার কথাগুলো চাপিয়ে দেয়া শুরু করে। প্রথম দিকে প্রতিবাদ করলেও, ইদানিম আর ভালো লাগতো না। তবু সম্পর্কের খাতিরে বনানী কে সহ্য করে নিত আকাশ। কিন্তু আজ আর মেনে নেয়া সম্ভব না। একটা নীরবে প্রতিবাদ প্রয়োজন ছিল, যার প্রথম পদক্ষেপ আজ সে নিতে পেরেছে। এবার ভুলে যাওয়াটা সহজ। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে, কিছুই মনে পড়বে না।

                                                                    //৩//
মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারের ছন্দটা বিঘ্ন হয়েছে ভালোরকম। ছেলেবেলায় কত মজাই না ছিল। নিশ্চিন্তে জীবন যাপন। School এর homework করা, রোজ সকালে tuition যাওয়া, বিকেল হলেই মাঠে খেলতে যাওয়া school থেকে ফিরে। কিন্তু কলেজে ওঠার পর থেকেই বাস্তবের আসল রূপরেখা চোখের সামনে আসে আকাশের। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত তফাতের প্রকট ও প্রচ্ছন্ন দিকগুলো উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটে। কিন্তু আকাশের মা-বাবা এ'বিষয়ে কোন আঁচ লাগতে দেননি দুই ছেলের গায়ে। সমস্যা হল বাবার stroke হওয়ার পর থেকে। আর্থিক স্বচ্ছলতা কোনকালেই তাদের ছিলনা। কিন্তু দেনায় ডুবে গিয়ে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা বড় ক্লান্তিকর। একজনের ধার মেটাতে গিয়ে অন্য ধার কাঁধে চাপে। কলেজ শেষ হতেই আর অপেক্ষা করেনা আকাশ।প্রথমে ছোটখাটো চাকরি, তারপর টাকা জমিয়ে ব্যবসায় নামে সে। পাঁচ রকমের ব্যবসা করে বেশ ভালোই রোজগার হচ্ছিলো, কিন্তু দেনায় নিমজ্জিত বলে, সে রোজগারের সিঁকিভাগ ও  দেখা যেত না। তবু পাওনাদারদের তাগাদা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। এই বা কম কি? ক্রমে নিজেকে ও নিজের ব্যবসাকে গুছিয়ে নিয়েছে আকাশ কিন্তু পরিবারের সাথে দূরত্বটা কোথাও যেন বেড়ে যাচ্ছিল। টাকার গন্ধ যে বিষাক্ত সে কথা আকাশ বিশ্বাস করে। কিন্তু নিজের পরিবারের লোক ও যখন দূরে সরে যায়, নিজেকে অসহায় বলে মনে হয়।

হাতে টাকা আসলে বোধহয় প্রভুত্ত্ব করবার একটা প্রবনতা চলে আসে। আকাশের মধ্যেও সেই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু মা-এর কথায় নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারে। অবশ্য সেই বোঝার ফল কোনদিনও সে পায়নি। অনিয়ম বা হিসেবের গরমিল দেখলেই অশান্তি শুরু করে দিত। নিজের পরিশ্রমের দেমাগ দেখিয়ে কতৃত্ত্ব ফলাতো। আর আঘাত প্রাপ্ত মা-বাবার চোখের জলকে তাচ্ছিল্য করে নিজের কাজে বেরিয়ে যেত।  অভাগী মা চোখের জল ফেলে আফসোস করতেন, "বোধহয় ঠিক করে মানুষ করতে পারিনি। গরীব মা-বাবার তাই এই পরিণতি।" একবার তো বাড়ি থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল আকাশ রাগ করে। এই পরিবর্তন অবশ্য একদিনের ফলাফল নয়। বহুদিনের অভাব অভিযোগ দূর করে পরিবার কে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আনতে বেশ মেহনত করতে হয়েছিল আকাশকে। সেই মূল্য অবশ্য কেউ দেবেনা কোনদিন। আকাশ মূল্য চায়ও না। শুধু তার হিসেবের মত করে সংসারটাকে ছকে বাঁধতে চায়। আর এখানেই বোধয় সবার আপত্তি।

                                                               //৪//
"তুমি নিজেকে যতটা smart মনে কর এ'সব কথা বলে, আদপেও তা নয়, সেটা অনুমান করতে পারোনা নিশ্চই।" Metro তে ফেরার সময় আলেয়ার সাথে দেখা হয়েছিল আকাশের। কথায় কথায় কি একটা বলে ফেলেছিল। সম্ভত তার এত সিগারেট খাওয়া নিয়েই প্রসঙ্গের শুরু। সে আলোচনায় হঠাৎ এইরকম উক্তি, বেশ হতচকিত করে দিয়েছিল আকাশ কে। এক মুহূর্তের জন্যে নিজেকে সংযত করে পরের station এ নেমে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। পাল্টা দু'টো কথা শোনাবার ইচ্ছেও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু আলেয়ার কথার আড়ালে চোরা সত্যিটাই বোধয় সব ইচ্ছেগুলো কে আটকে দিয়ে আরো বকা খাওয়ার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দেয়। শিশুর মতোই কৈফিয়ৎ দিতে শুরু করে আকাশ। বিপক্ষের অবশ্য কথা সাজানোই ছিল ঠোঁটে। উত্তরগুলো শুনতে ভালোই লাগছিল। মা-এর পরে এ'ভাবে কেউ বলেনি তাকে। আলেয়া বলে চলে।

"একটা জিনিস তুমি বোধহয় জানো না। নিজের সত্ত্বাকে ভুলে, অন্যের সত্ত্বা adopt করা easy নয়। তুমি যদি সত্যিই অনুভূতি প্রবণ না হতে, বনানীর কথাগুলো মনেও রাখতে না। আর সিগারেট খেয়ে পরিণতির উপর ভয় না পেলে নিজের শারীরিক অবস্থার ওপর চিন্তিত হতে না।"

"কিন্তু আমি তো. ......" বলার মাঝেই বাধা পায় আকাশ।

"এরকম ভাবে চললে আর ক'দিন বাদে personality disorder এ ভুগবে তুমি। আর কে তোমায় কিভাবে চেনে, আমি জানি না। কিন্তু আমায় অন্তত তোমার মুখোশ পড়া রূপটা দেখিও না। খুব হাস্যকর লাগে তোমায়।" আকাশের উত্তর দেবার অবকাশ দেবে বলেই বোধয় আলেয়া একবার বিরতি নিল।

" আমি জানি আমি বোকা। কিন্তু মুখোশটা পড়তে হয় ব্যবসার খাতিরে। বনানী চলে যাওয়ার পর সিগারেট খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু তার সাথে। ......." আবার প্রতিপক্ষ প্রতিবাদ করে ওঠে।

"আর তাই তুমি দেবদাস সেজে সিগারেট ধরে নিলে? বাঃ! কি বীরপুরুষ।" আলেয়া কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

শিরিষ কাগজ দিয়ে মুখের ওপর ঘষে দিলেও বোধহয় এরকম যন্ত্রনা হয় না, আলেয়ার শেষ কথাগুলো যেমন ধারালো ছিল। আকাশও চাইলে খারাপ ভাবে বলতে পারত। কিন্তু আলেয়ার তিক্ত অপ্রিয় সত্যিগুলির মধ্যে সহানুভূতির স্বাদ পেয়েই বোধয় আবার কোন একটা বোকা বোকা কথা বলে বসত।

আলেয়াকে আকাশ ভুলভুলাইয়া বলে ডাকে। ভুলভুলাইয়ার মতই জটিল মনস্তত্ব বলে মনে হয়। আলেয়া কে চেনা, আকাশের সাধ্যি নয়, সে কথা আকাশ বরাবর স্বীকার করে এসেছে। এমন চাপা প্রকৃতির মেয়ে সত্যি বিরল। আলেয়া সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য শোনা bank এর বড়বাবু তাপস মল্লিকের কাছ থেকে। Bank এর কাজেই আলেয়ার সাথে আলাপ। যে bank থেকে আকাশ ব্যবসা সংক্রান্ত loan নিয়েছে, আলেয়া সেই bank এর PO. কাজের সূত্রের আলাপ ক্রমে একটা বন্ধুত্বে পরিণতি পায়। অবশ্যি আলেয়া তাকে বন্ধু ভাবে কিনা সে'কথা আকাশ জানে না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই দেখা হলে, হেসে আলাপ করতে দুজনেই সমান আগ্রহী বলে মনে হয়। আকাশের আপাত নির্লিপ্ত, নির্বিকার আভরনের আড়ালে সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির খবর আলেয়া কিভাবে যেন টের পেয়ে যেত। আকাশ ও বাধ্য ছেলের মত বকা খেত। এই আলাপ পর্বের পরিসর অবশ্য ওই যাতায়াতের পথেই যা কিছু হত।  Leukemia এর মত বিকট রোগ যার নিত্যদিনের সঙ্গী। তিলেতিলে যার শরীরটা ধুকছে অসুখের প্রভাবে। সেই মেয়ে নিজের সমস্ত আবেগ কে কোন অতল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নিত্য অফিস আসছে, কাজ করছে। এ'দিকে কেউ জানতেও পারছেনা আলেয়ার খবর।

একবার bank এ খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে এসেছিল আলেয়া। নির্ভেজাল compliment করেই আকাশ জিজ্ঞেস করেছিল আজ হঠাৎ এমন সাজের কারণ। হেসে বলেছিল, "আজ সকাল থেকে মনটা একটু খারাপ ছিল। তাই সেজে নিলাম।" এমন পরিহাসের আড়ালে লোকানো আবেগের হদিশ আকাশ জানে না। খোঁজার চেষ্টাও করেনা। বনানীর পরে নিজের মনে আর কাউকে প্রশ্রয় দেবেনা বলে সে decide করেছিল। কিন্তু আলেয়ার কাছে এলে নিজের মনই প্রশ্রয় চেয়ে আবদার শুরু করে। যেটুকু দুর্বলতা আকাশের, সেটা আলেয়ার চোখে। প্রায় ফ্যাকাশে মুখের আদলে ঐ দুটো ঘন কালো চোখের গহীন অতলে সব আবেগ লুকিয়ে, সে চোখ যেন হাসির সাজে রঙিন। বনানীর ছাঁচে সব নারীকে বিচার করতে করতে আলেয়ার কাছেই প্রথম হোঁচট খায় আকাশ। নিজের অজ্ঞাতেই তাই অনেক সময় মন কে প্রশ্রয় দিয়ে আলেয়ার কাছে চলে আসে সে। আর আলেয়ার প্রতিটি কথায়, মন্তব্যে নতুন করে চেনার চেষ্টা করে তাকে।



                                                                 //৫//
বনানীর সাথে সম্পর্ক ভেঙে গেছে প্রায় তিন বছর। এতগুলো দিন যে কিভাবে পেরিয়ে গেছে, টের পায়নি আকাশ। অর্থাভাব বোধহয় অন্য সব অভাবের মূল্যকে ফিকে করে দেয়।  যে বনানীর প্রতি এত দুর্বলতা, এত ভালোবাসা আজ তার কোন প্রভাবই নেই তার জীবনে। নিজের অফিসে ঢুকে, desk এর ওপর বনানীর বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেখে অতীতের কিছু স্মৃতি ছায়াছবির মতই চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছিল। Chair এ বসে তাদের প্রথম আলাপ, পরে প্রেম নিবেদন, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা রকম স্বপ্ন। আজ সবই মনে পড়ছে। কিন্তু প্রভাব বিস্তারে আজ সেগুলো বড়ই তুচ্ছ।

"দাদা, চা এনেছি।" সহকারীর ডাকে ভাবনা ভাঙে আকাশের।

"এই card টা কে দিয়ে গেল?" খামের মধ্যে বিয়ের card টা চালান করে চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয়।

"একজন মেয়েছেলে এসেছিল। তোমার খোঁজ করে না পেয়ে আমায় ওই card দিয়ে চলে গেল। বলল তুমি আসলে তোমায় যেন দিয়ে দি।" নিজের কাপে চা ঢালতে ঢালতে কথাগুলো বলে নেপাল, আকাশের সহকারী।

"তোকে না কতদিন বলেছি, মেয়েছেলে বলবিনা? একটি মেয়ে এসে দিয়ে গেছে বলা যায় না?" চায়ের কাপে চুমুক দেবার আগে ধমকটা দিয়ে নেয় আকাশ। নেপালের বাসস্থান যে এলাকায়, সেখানে মেয়েদের, মেয়েছেলে বা মাগী বলার চলটাই বেশী। নেপালেরও দোষ নেই। নিজের মা-কেও সে ঐভাবেই ডাক শুনে আসতে দেখেছে। আকাশ তবু তালিম দেয় নেপালকে শহুরে আদব কায়দায়। আর যাই হোক, তার মক্কেলদের সামনেও নেপাল নিজের সহজাত ভাষায় কথা বললে, মান সম্মানের ওপর কালিমা পরে যাবে। চা শেষ করে, কাপটা table এ রেখে উঠে পরে আকাশ। বিয়ের card টা ছিড়ে dustbin এ ফেলে বাইরে এসে সিগারেট ধরায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুসফুসে ভরে নেওয়া ধোঁয়াকে নির্গত করে, স্বগোতক্তি করে বসে। "যাক বাবা। বেঁচে গেলাম।"

"কি বিড়বিড় করছিস অমন অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে?"

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে আকাশ। তালুকদারের গলা। তার থেকে ৫ হাত দূরে একটা light post এর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিল তালুকদার, আকাশের বাল্য বন্ধু। প্রায় বছর সাতেক পর আবার দু'জনের দেখা। চাকরি পেয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে, তালুকদারের সাথে আর সেভাবে যোগাযোগ রাখা হয়নি। আজ আবার দেখতে পেয়ে বনানীর বিয়ের প্রসঙ্গটা এক লহমায় যেন মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।


সেই পুরোনো কায়দাতেই আড্ডা শুরু করেছিল তারা। পিকলুদার দোকানের চা, আর ছোটুর দোকান থেকে কেনা চারমিনার ধরিয়ে। আকাশ আর ঋক তালুকদার এক স্কুলের ছাত্র। Cricket এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব, দু'জনেই ফেলুদার ভক্ত। এছাড়াও অনেক সমান্তরাল চিন্তা ভাবনার কারণে দুজনই খুব ভালো বন্ধু। কলেজে ওঠার পর ফেলুদাকে অনুসরণ করেই চারমিনার দিয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে হাতেখড়ি। তারপর কলেজ শেষে চাকরির চেষ্টা। ঋক Bangalore এ একটি বিদেশী সংস্থায় চাকরি পেয়ে চলে যায়। দু'বছর ওখানে থাকার পর কি করে, কি বৃত্তান্ত আকাশের অজানা। প্রায় সাত বছর পরে, এই আবার দু'জনের দেখা। আকাশ বরাবরই ঘরের প্রতি আসক্ত; অবশ্য উপায়ও ছিলনা। কলেজের তৃতীয় বছরেই আকাশের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরের বছরেই মা। কলেজ শেষ করে টাকার বন্দোবস্তে না বেরোলে সংসারটা অগোছালো হয়ে যেত। এইসব অতীত আকাশের মনে আর স্থান পায়না। কিন্তু মাঝরাতে উঠে হিসেবে নিয়ে বসে আর্থিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে মাঝেমধ্যে বন্ধুদের ভাগ্যকে হিংসে হয়। তারপরই নিজের স্বাধীন ব্যবসার কথা মনে করে নিজেই নিজেকে বাহবা দেয় আর স্বান্তনা দেয়।

"আজ দু'বছর হল Germany তে আছি। ওখানেই ভাবছি settled হয়ে যাব। মা চলে গেলো বলে দেশে ফিরলাম। কাজ, অনুষ্টান সব শেষ করে তোর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি। শুনলাম বড় business man হয়ে গেছিস?" চায়ের প্রথম চুমুক দিয়ে কথাগুলো বলে ঋক।

"তোর মা? কি হয়েছিল?" খবরটা খুবই অস্বস্তির। আকাশ নিজের কাছেই নিজে বিরক্ত হয় উপযুক্ত শব্দ চয়নের অভাবে।

"ঐ যা হয়। Cerebral stroke, coma তে ছিল প্রায় পঁচিশ দিন। আমি দেশে ফেরার দু'দিন পরেই take off করল মা।" খুবই casual ভাবে কথাগুলো বলে ঋক।

"জেঠুকে নিয়ে যাচ্ছিস? এখানে তো ওনার একা থাকা খুবই চাপের।"

"মা তো বাবার কাছেই গেল। আমি আবার বাবাকে নিয়ে কোথায় যাব?" একইরকম সচ্ছন্দভাবে বলে ফেলে ঋক।

"তার মানে? জেঠু! কি বলছিস তুই?" আকাশ নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

"বাবা মারা যাওয়ার পরেই তো Germany তে চাকরি টা নিয়ে ফেলি। মা এখানে মামা বাড়িতে থাকত। এখন মা-ও রওনা দিয়েছে। কাজেই আমার এখানে ছুটি। একেবারেই চলে যাব বলে school এর বন্ধুদের সাথে একবার দেখা করে নিচ্ছি। তুই তো পুরো বেপাত্তা। অনেক খোঁজ নিয়ে তোর office এর address পেলাম।"

ঋক এর একটা স্বভাব ছিল যে কোন serious বিষয়েও একেবারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারত। নিজের মা-বাবার মৃত্যু সংবাদও কেউ এইভাবে দিতে পারে, আকাশের জানা ছিলনা। ঋক বলত, "কারো করুণা ভিক্ষা পেতে হলে নিজেকে দুর্বল সাজাবি। বিবেকানন্দ পড়ে দেখ। লোকটা ভগবান হয়েও কি নিষ্ঠূর ভাগ্যের পরিহাস সহ্য করেছে। সেই লোক স্বয়ং ভবতারিনীর  করুণা না চেয়ে, মুক্তির পথ চেয়েছিল। সেখানে আমি সামান্য মানুষ, আরেকটা মানুষের কাছে করুণা ভিক্ষে করব? কভি নেহি।" এসব কথা শুনলে আকাশের হাসি পেত। ঋকের ঘিলুতে ধূসর পদার্থের অভাব ভেবে ঋক কে নিয়ে হাসাহাসি করত। কিন্তু ঋক বোধয় সত্যি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। তাই জীবনের সব থেকে বড় সম্বল হারিয়েও এমন নির্বিকার চিত্তে কথাগুলো বলে চলেছে।

"তোর ব্যবসায় কিছু টাকা দিতে চাই। ভেবেনে, আমি investor. কত percent return দিবি বল?"

কথার মাঝখানে হঠাৎ এমন প্রসঙ্গ পরিবর্তনে আকাশ কিছুটা বেসামাল হয়ে যায়। আমতা আমতা করে আবার জানতে চায় ঋকের ইচ্ছে।

"আমি তোর সব কথাই শুনেছি।" ঋক চায়ের দাম মিটিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরায়। আকাশের অবাক ভাবটা দেখে কারণ বুঝতে পেরে বলে,
"তোর বাড়ি গিয়েছিলাম। কাকিমার সাথে দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় সবই শুনলাম। ওখান থেকেই তোর office এর address নিয়ে এলাম।"

"মা তোকে কি বলেছে?" আকাশ আরেকটা সিগারেট ধরায়।

"সুদে ধার নিয়ে কারবার চালাচ্ছিস। পাওনাদাররা মাঝে মধ্যেই বাড়িতে আসে। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। রাতে ঘুম নেই। মাঝে মধ্যে নাকি বাড়িও ফিরিস না। কি চাইছিস কি?" আকাশ যে নিজের মা এর প্রতি বিরক্ত হয়েছে, অনুমান করতে পারে ঋক। তার রেশ ধরেই বলে, "কাকিমার ওপর রাগ করে কি করবি? আমার হাতের চড় যদি ভুলে না গিয়ে থাকিস, বেপারটা আমাদের দু'জনের মধ্যেই রাখ।"

"কিন্তু এই বাজারে কোন ব্যবসায়ি ধার নিয়ে কারবার চালায়না বল? তাই বলে মা-কে জনে জনে বলে বেড়াতে হবে?" আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে।

"কাকিমার concern টা কি অহেতুক? আছে বলে যে দম্ভে কথাগুলো বললি, আমার জায়গায় থাকলে সেই কথাগুলো, সেই concern টুকু পাওয়ার জন্যেই ছটফট করতিস।" ঋকের মন্তব্যে সত্যি দুমড়ে যায় আকাশের ফাঁপা দম্ভের গোলক। "আমি কিছু টাকা তোকে দিয়ে যাচ্ছি। তুই ব্যবসায় লাগা। প্রয়োজনে ধার কিছু শোধ করে দে, যাতে মাসে মাসে সুদ গোনাটা বন্ধ হয়। আমায় তো আর সুদ দিতে হবে না। বছর শেষে মুনাফার একটা অংশ আমায় পাঠিয়ে দিবি।"

"তুই না বললি, কারো করুণা ভিক্ষে না করতে?" আকাশ মাথা নিচু করে বলে।

"নেহাত আমরা বড় হয়ে গেছি তাই। স্কুল-এর বারান্দায় কিভাবে ফেলে পিটিয়েছিলাম তোকে, মনে আছে নিশ্চই?"

"তুই আমায় করুণা ভিক্ষে দিচ্ছিস না? আচমকা এমন কি হল, যে তুই আমায় টাকা দিবি?" আকাশ খুব বিরক্ত ভাবেই বলে কথাগুলো।

"তুই না share market এ টাকা লাগাস? তুই এই কথা বললি? ভাব আমি তোর company র বিশ percent share holder. তুই company grow করিয়ে মুনাফা তুলে আমায় ফেরত  দিবি। তাহলেও কি বলবি এটা করুণা?"

"কিন্তু হঠাৎ এইভাবে?"

"এত ভাবিস না। ব্যবসায় সুযোগ একবার আসে, বারবার নয়। আমার আর কি বল? সংসার করিনি, মা-বাবাও স্বর্গে। টাকাগুলো এমনিই পরে থাকার চেয়ে তোর কাজে লাগুক। তুই ভালো করে ব্যবসা কর আর আমায় return দিতে থাক। তারপর বুড়ো বয়সে দু'জনে ফুর্তি করা যাবে। কি বলিস?" ঋক নিজের স্বভাবচিত সেই হাসি দিয়ে আকাশের পিঠ চাপড়ে দেয়।

"যদি ফেরত দিতে না পারি?" আকাশ প্রশ্ন করে।

"তাহলে দিবি না! কি যায় আসে? তুই পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলিস না, সবাই হয়ও না। কিন্তু তুই খুব ভালো মানুষ আকাশ। আর সে জন্যেই বোধহয় তোকে সাহায্য করছি। অবস্থার বিপাকে সবাই পরে। কিন্তু নিজেকে এভাবে বদলে ফেলিস না। বদলে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু এই বদলে যাওয়ার কারণে যাদের হারাবি, তাদের ফিরে পাওয়া অনেক কঠিন।"


পরেরদিনই আকাশের account এ বড় অঙ্কের টাকা এসে যায়। সেই টাকায় দু'জন সুদের দালালের হাত থেকে রেহাই পায় আকাশ। বাকী টাকা ব্যবসাতে লাগায়।  সুযোগ সত্যি একবার আসে, আর এরকম সুযোগ হারালে আকাশ আবার পেত না। এই ক'দিনে, আকাশ নিজের লভ্যাংশকে প্রথমবার চোখে দেখতে পেল। টাকা থাকলে বোধয় মানসিকতা পাল্টে যায়। অনেক পরিশ্রমের পরেও ভাঁড়ার শূন্য দেখলে সবারই মন রুক্ষ হয়ে থাকে। Account balance এর সংখ্যাগুলি এখন আর আফসোসের কারণ হয়না আকাশের।

                                                                 //৬//
ঋক Germany চলে গেছে প্রায় দু'বছর হল। নিয়ম মাফিক প্রত্যেক মাসে আকাশ লভ্যাংশের এক ভাগ ঋক এর account এ পাঠিয়ে দেয়।  আগের তুলনায় আর্থিক অবস্থা এখন অনেকটাই স্বছল। দিন-রাত পরিশ্রমের ধকলটাও অনেক কমেছে। এখন শুধু তদারকি করা ছাড়া আর সেরকম খাটনি নেই। বাড়িতেও একটা ছন্দ ফিরে এসেছে। মা-এর অসুস্থতার সময় নিজেদের সঞ্চয় পুরো শেষ হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-বন্ধুর দ্বারে, প্রায় একরকম ভিক্ষে করেই হাসপাতালের bill মেটাতে হয়েছিল আকাশদের। সেই ঋণ সোধ করতে নিজেদের বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে হয়। একরকম নিঃস্ব অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সত্যি অনেক সময় নিয়ে নেয়। Office এর ঠিকানা বদল না হলেও আয়তনে অনেকটা বেড়েছে। কর্মচারীর সংখ্যাও বেড়েছে। নিজের ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে আকাশ। এই কাজে অবশ্য আলেয়ার অনেকটাই সাহায্য ছিল। একরকম নিজের মত করেই আলেয়া ঘরের প্রতিটি কোণ সাজিয়েছিল।

সাজানো গোছানো ঘরটায় ঢুকলেই আলেয়ার কথা খুব মনে পরে আকাশের। প্রথমবার দু'জন সিনেমা দেখতে গিয়ে, আলেয়ার ছেলেমানুষিগুলো খেয়াল করে আকাশ। একটু একটু করে নিজেদের পরিচয় বাড়তে থাকে। ভালো বন্ধুত্ব তখন যেন আরেকটু কাছের মানুষ করে দিয়েছিল তাদের।

"এইভাবে কলকাতাকে কোনদিন দেখিনি। Thank you." গঙ্গার পার দিয়ে হাটতে হাটতে বলে আলেয়া।  প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে গাড়িটা park করে দু'জনে গঙ্গার পারে এসেছে। পড়ন্ত সূর্যের শেষ আলোটুকু গঙ্গার ওপর প্রতিফলিত হয়ে অন্য আমেজ তৈরী করেছে। আজ রবিবার থাকায় সারাদিন দুজনে ঘুরেছে। প্রথমে সিনেমা দেখতে যাওয়া, পরে lunch সেরে Park street cemetery. সেখান থেকে জাদুঘর হয়ে প্রিন্সেপ ঘাট।

এতটা সময় একসাথে কাটিয়েও যেন বড় অল্প বলে মনে হয়। আলাপের সিঁকিভাগ ও এখনো হয়নি, এদিকে দিন তার সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছে। আর্থিক কাঠামো সুসজ্জিত করে আকাশ আবার নিজের ছাত্রজীবনের কিছু অভ্যাস ফিরিয়ে এনেছিল। বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা। কাজের টানাপোড়েনে কোথায় যেন সব হারিয়ে গিয়েছিল। আবার সে অভ্যেস ফিরে আসায় আকাশ আগের মতোই প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে তার পড়াশোনা বহুদিনের। Park street cemetery র অনেক অজনা ইতিহাস, সেদিন আলেয়া কে বোঝাতে বোঝাতে নিজেও যেন হারিয়ে গিয়েছিল সেই প্রাচীন ইতিহাসে। সারাদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন তারা গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়ায়, নিজেদের অজান্তেই  দুজনের আঙ্গুল ঠিকানা খুঁজে নেয় একে ওপরের হাতে।


                                                                    //৭//
ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ঘুমটা ভেঙে যায় সকাল সকাল। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা। স্বপ্নের উপলব্ধিগুলোকে আরেকবার আমেজ সহ অনুভব করতে ইচ্ছে করে। আলেয়াকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা জায়গায় বেড়াতে গেছে আকাশ। পাহাড়ি এলাকা, চারিদিকে নানারকম ফুল ফুটে আছে।


বহুদিনের অপেক্ষা শেষ করে আকাশ নিজের মনের কথা জানায় আলেয়াকে। নীরব পাহাড়ি উপত্যকায় দুজনের উপস্থিতি সেই স্বপ্নের আমেজকে আরো ছদ্ম-উষ্ণতা দেয়। আলেয়ার হাত যেন সত্যি নিজের হাতের মাঝে অনুভব করতে পারে আকাশ। পরিবেশ ও ঘটনার চরম মুহূর্তে স্বপ্নটা ভেঙে যায়। কিন্তু সেটুকুই বা কম কিসে। নিজের কাছে নিজেই যখন হারিয়ে গিয়েছিল আকাশ, আলেয়ার উপস্থিতি তাকে একটু একটু করে বিপথ থেকে সরিয়ে এনেছে। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে, বাস্তবের মাটিতে পা রেখেও আবেগ কে সাথী করে চলতে শিখিয়েছে। নিজের জীবনের বাকি সময়টুকু তাই আলেয়াকেই দিতে মন চায় আকাশের।

"তুমি এ'ভাবে আমায় বেঁধে রেখনা। আমার হাতে সময় কম আকাশ।" আলেয়া একরকম জোর করেই দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল আকাশ কে।

"তোমায় বেঁধে রাখার সাধ্য আমার নেই। তবে তোমার সঙ্গ পেতে আমার বড় লোভ হয়। আর ব্যবসা করে এ'টুকু বুঝেছি। সমান ভাবে অংশীদার হয়ে কোন ব্যবসা চালালে, সে ব্যবসার গতি অনেক স্থির ও নিশ্চিত হয়।"

"তোমার-আমার সম্পর্কটা বুঝি ব্যবসার?" অভিমান করে হাত সরিয়ে নিয়েছিল আলেয়া।

"আমার word selection যে কতখানি নিম্নমানের, সে'বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে, এ'টুকু আমি বুঝি। তুমি আমার জীবনের প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে যেভাবে সাহায্য করেছ, তোমাকে ভুলে অন্য কাউকে নিজের সময় দেওয়ার কথা আমি অন্তন্ত ভাবতে পারিনা।"

"ডাক্তার বলছে আমার হাতে আর মাত্র পাঁচ বছর সময়। কি হবে এমন সম্পর্কের পরিণতি দিয়ে?"

"তুমি কবে যাবে, তোমার হাতে কতদিন সময়, সে বিষয় আমি বিশ্বাস করি না। এমনও তো হতে পরে, তোমার আগেই আমি, ........."

আকাশের মুখ চেপে ধরেছিল আলেয়া। বাকি কথা নীরব প্রলাপের মতোই কেবল আন্দোলিত করেছিল আকাশের ঠোঁট। সেই প্রথম অন্তরঙ্গ হয়েছিল তারা দু'জন। একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে মনের কথা প্রকাশ করেছিল নিকট আলিঙ্গনে। আর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল, সেই নতুন প্রেমকে আরো সজীব করে তুলতে।


স্বপ্নের কথাটা ভাবতে ভাবতেই বিছানা থেকে উঠে জানলার কাছে আসে আকাশ। ভোরের আলো তখন সবে পঙক্তি রচনা করেছে পুব আকাশে। নতুন দিনের শুরুটা বেশ উপভোগ্য বলে মনে হয়। বেসিনের কাছে গিয়ে মুখে চোখে জল দেয় আকাশ। তারপর brush paste নিতে গিয়েই সব অন্ধকার।

                                                                       
















                                                                            //৮//
আকাশের জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে পৌঁছে। ডাক্তারদের তদারকি, মা-এর উৎকন্ঠায় ভরা কন্ঠস্বর, আর হাসপাতালের ব্যস্ততা, আবছা আবছা মনে পড়ছে এখন। ICCU room এর এই cabin এ একাকিত্বকে অনুভব করে স্মৃতির পাতাগুলি উল্টেপাল্টে দেখছিল আকাশ। মাস কয়েক আগে একটা ছোট ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে পরেছিল সে। ডাক্তারদের মতে Heart এর অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক ছিলনা। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে আকাশ পুরো ব্যাপারটাই গোপন রেখেছিল সবার কাছে। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও, নিয়ম বহির্ভূত জীবনযাত্রা কে বিরতি দেয়নি। সেদিন ভোরের স্বপ্নের সাথে সকাল শুরুর পরে যেটুকু স্মৃতি বেঁচে আছে, তাকেই সম্বল করে নিজের অতীত-এর পথগুলি স্মরণ করতে থাকে। এই একলা ঘর, যন্ত্রের আওয়াজ আর জানলার কাঁচের বাইরে সন্ধ্যার আলোকিত কলকাতা। বুকের পাশ দিয়ে ব্যাথার প্রভাবটা আরেকবার জানান দিয়ে যায় নিজের উপস্থিতি। এই বুঝি শেষ। ............  ঘরটা বড় অন্ধকার বলে মনে হয়। ডাক্তারি যন্ত্রপাতির হলুদ-সবুজ আলোগুলো গোটা ঘরের শেষ সম্বল যেন। মুখের ওপর oxygen mask টা খুব বিরক্তিকর। এমন এঁটে বসেছে গালের সাথে খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এমন সময় বুকের ঠিক একপাশ দিয়ে চিন চিন করে তীব্র একটা ব্যাথা উঠতে শুরু করে। ঘরের AC টাও বোধহয় বড্ড বেশি বাড়ানো আছে। শীতটা এমন জাঁকিয়ে অনুভব কোনদিন করেনি সে। আজ প্রথমবার। বুকের পাঁজরগুলো, যা এতদিন তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর সহকারী ছিল, তারাও যেন বিরতির অপেক্ষায়। কেবল হৃদযন্ত্রের তাড়নায় তাদের সঞ্চালন অব্যাহতি পাচ্ছে না। এক মুহূর্তে ছুটি পাওয়ার জন্যে তারা যেন ওঁৎ পেতে আছে। ঐ দূরে কে যেন তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ঝাপসা, দৃষ্টিটাও ঝাপসা আজ। ক্রমাগত অন্ধকার কে সাথী করে সে যেন নেমে আসছে চোখের চারপাশে। ........................................................................................

হৃদযন্ত্রের শেষ স্পন্দন জানিয়ে monitor এর রেখাগুলি একভাবে সরলরেখায় চলতে শুরু করে। শেষ নিঃশ্বাসের অনুভূতি কে সঙ্গী করে সবার অলক্ষ্যে আকাশ পালিয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। সে দারিদ্রতাকে ভয় পেত,  ভয় পেত ঋণ এর বোঝা কে। সেই সব কিছু থেকে পালাবার জন্যে একটু একটু করে সরে এসেছিল নিজের প্রিয়মানুষদের কাছ থেকে। আজ জীবনের সব অধ্যায়ের উপসংহার রচনা করতে চলেছিল সে, আর তখনই জীবন তাকে ছেড়ে বিদায় নিল কিছু অসমাপ্ত ইচ্ছের ঋণ রেখে দিয়ে।