সোমবার, ২৪ এপ্রিল, ২০১৭


প্রথম কিস্তি 



                                                                           //১//
ঘরে ঢুকেই সামনে থাকা সোফা-সেট এর একটায় বসে পরেন সৌগত মল্লিক। কোটের বাম পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে, বার কতক বড় বড় শ্বাস ফেলে ধাতস্ত হন খানিকটা।

"আপনার কি শরীর খারাপ নাকি?" ছাইদানিতে সিগারেটের অবশিষ্ট অংশ টুকু ফেলে প্রশ্ন করে শচীন।

"আপনিই শচীন সামন্ত?" আরেকবার কপাল আর ঘারের ঘাম মুছে নিয়ে রুমালটা পকেটে রাখেন সৌগত বাবু।

"আজ্ঞে হ্যা! আমি।" এক গ্লাস জল মল্লিক বাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় গিয়ে বসে শচীন।

"বলুন কি সমস্যা?"

"বাপরে বাপ্! এমন জায়গায় বাড়ি আপনার, খুঁজে পেতেই এক ঘন্টা লেগে গেল। বড় রাস্তার কাছে একটা চেম্বার করলে পারেন তো?" গ্লাসের জল টুকু শেষ করে টেবিলে নামিয়ে রাখেন সৌগত মল্লিক।

"কি-আর করি বলুন। আমার মক্কেলরা বড়লোক হলেও, আমি তো নোই।" নিজের চিরাচরিত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে সোফায় আরো আরাম করে হেলান দিয়ে বসে শচীন।

"আপনার কাছে একটা সিগারেট হবে? আমার প্যাকেটটা বোধয় গাড়িতে ফেলে এসেছি।"

"নিশ্চই!" Goldflake এর বাক্সটা এগিয়ে দেয় শচীন।

সিগারেট ধরিয়ে পরপর দুটান দিয়ে একরাশ ধোয়া ছেড়ে কথা শুরু করেন আমাদের আজকের মক্কেল সৌগত মল্লিক।


"Calcutta Club এর অনির্বাণ দাসগুপ্ত আপনার নম্বর দিয়েছিলেন আমায়। উনি আপনাকে কিছু বলেছেন?"

"Text করে আপনার পরিচয়, আর আজকে আসার কথা জানিয়েছিলেন। ব্যাস! আর কিছু নয়।"

"ওহ!" আরো বার দুয়েক টান দিয়ে সিগারেটটা ashtray তে ফেলে দেন মল্লিক বাবু।

"অনির্বাণের কাছে আপনার যা বর্ননা শুনেছিলাম, তার সাথে যদিও কোন মিল খুঁজে পাচ্ছি না। আপনিই শচীন সামন্ত তো?"

"বিলেত যাওয়ার কোন ইচ্ছে বা সম্ভাবনা নেই বলে passport করিনি। গণতন্ত্রিক দেশে বাস করি বলে কোনদিন মনে হয়নি বলে, voter card ও করিনি। আর কাজের সূত্রে বাইরে থাকি বেশি বলে AADHAR card ও করানো হয়নি। এ`বার আমাকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সম্পূর্ণ আপনার ইচ্ছে!"

"আমার পরিস্থিতিতে থাকলে, আপনিও চট করে সবাইকে বিশ্বাস করতে পারতেননা মশাই।"

"গাড়িতে যে কুকুরটিকে রেখে এসেছেন, সে আবার পাড়া মাতিয়ে চিৎকার শুরু করে দেবে না তো?"

"কুকুর?"

"আপনার কোটের আস্তিনে যার লোম এখনো লেগে রয়েছে।"

কোটের আস্তিন পরীক্ষা করে লোম দেখে হেসে ফেলেন সৌগত মল্লিক।

"Lucy আমার দু`বছরের একটা লাব্রাডর। এখন সে-ই আমার সব থেকে বিশ্বস্ত শচীন বাবু।" কোটটা খুলে হাতে নিয়ে বসেন সৌগত বাবু। "আপনি চিন্তা করবেন না। গাড়িতে সে দিব্য আরামেই রয়েছে।"

"আপনার showroom তো বালিগঞ্জে? বাসে করে কোথাও গিয়েছিলেন?"

"আজ্ঞে?" একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন সৌগত বাবু।

"আমার পাড়ায় এসে রতনের দোকানে চা-বিস্কুট খেলেন। আমার নাম বলেও কোন লাভ না হওয়ায়, instruction মত গলির মুখে তিন নম্বর বাড়ি হিসেব করে তারপর এলেন।"


"বাবাঃ! আপনিতো পাকা গোয়েন্দাদের মত কথা বলছেন দেখছি।"

"পেশাটা এক না হলেও, অভ্যেসগুলো তো একরকম রাখতেই হয়, না!" আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে সৌগত বাবুর দিকেও একটা সিগারেট বাড়িয়ে দেয় শচীন।

"ডাক্তার আপনার pressure এর ওষুধ পাল্টেছেন, blood test ও দিয়েছেন, কিন্তু করানো হচ্ছে না!"

"কি করে বলছেন বলুন তো? আমি গোয়েন্দা গল্প পড়েছি অনেক, কিন্তু?"

"অল্প বয়সে বাসে ট্রামে চড়ার অভ্যেস ছিল বোধয়। ticket নিয়ে হাতে ঘড়ির band এর নিচে রাখা দেখে আন্দাজ করলাম বাসে উঠেছিলেন। রতনের দোকানে চা খেয়েছেন বুঝলাম আঙুলে লেগে থাকা মাটির ভাঁড়ের ধুলো দেখে। আর চা বোধয় গরম ছিল, প্রথম চুমুকে ছ্যাকা লাগায় সামান্য চা shirt এ পরে। তার দাগ দেখা যাচ্ছে আপনার জামায়। আর বিস্কুটের কিছু গুঁড়ো এখনো লেগে আছে ঠোঁটের কোনায়। রতনের দোকান বুঝলাম দাগগুলো এখনো বেশ টাটকা রয়েছে দেখে। পুরোনো হলে আঙুলে মাটির ভাঁড়ের ধুলো থাকতো না। আর এই পাড়ায় একমাত্র রতনের দোকানেই ভাঁড় চালু আছে।  Pressure এর ওষুধের বেপারটা আন্দাজ করলাম আপনার গোড়ালির কাছে ফোলা দেখে। ইডিমা হয়ে আছে।"

"না মশাই, ফেলুদা আমিও পড়েছি। তবে application টা এমনভাবে চাক্ষুস করিনি কোনদিন।"

"এবার আপনার সমস্যার কথা শুনি?"


                                                                 //২//
পাঠকদের সুবিধার্তে আলাপ পর্বটা এইবেলা সেরে ফেলি। আমি সুবীর গাঙ্গুলী আর শচীন আমার বাল্যবন্ধু। দুজনেই একসাথে ডাক্তারি পড়েছিলাম, কিন্তু পেশাদারিত্বে অপটু এবং অযোগ্য প্রমাণ হওয়ায়, ডাক্তারি ছেড়ে স্বাধীন ব্যবসা শুরু করেছি। ব্যবসাটা কি, সেটা গল্পের প্রবাহের সাথেই জানতে পারবেন। আমাদের আজকের মক্কেল সৌগত মল্লিক, কলকাতার নামকরা মল্লিক এন্ড সন্স এর মালিক। পৈতৃক ব্যবসায় এসে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় আজ এই জায়গায় নিয়ে আসতে পেরেছেন।

মল্লিকবাবু phone এ যা বলেছিলেন, তার সারাংশ করলে যা দাঁড়ায়। গত তিন বছর যাবৎ পারিবারিক একটি বিষয়ে উনি বাজে ভাবে জড়িয়ে পড়েছেন। যার থেকে মুক্তি পাওয়া খুবই জরুরি, এবং সেটা গোপনীয়তার সাথে হলেই সবচেয়ে ভালো। নিজের যে পরিচয় বাজারে এখন তৈরী হয়েছে, তার ওপর কালিমা মাখলে ব্যবসার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।

আমি আর শচীন এ রকম বিপাকে পরে যাওয়া মানুষদের উদ্ধার করি, বা উদ্ধার হতে সাহায্য করি। একটা সূত্র দিয়ে রাখি, পেশার প্রয়োজনেই আমাদের দুজনের আসল নাম প্রকাশ পায়না। গল্পের প্রয়োজনেও সেটা গোপন থাকে?

"আমার স্ত্রীকে নিয়ে সমস্যা।" Flask থেকে গরম চা দিয়ে গেছে কেষ্ট। কাপে চুমুক দিয়ে আবার টেবিল রেখে বলতে শুরু করেন মল্লিক বাবু।

"নির্মলার সাথে আমার আলাপ হয় আমাদের ad agency মারফত। একটা product launch এর সময় কিছু model এর প্রয়োজন ছিল। নির্মলা সেখানে audition দেয়। কি দেখেছিলাম কে জানে, হয়ত যুবা বয়সের উৎসাহেই নির্মলাকে select করতে বলি আমি। তারপর কিছু ভুল করে ফেলি আর যে কারণে। ..."

"প্রথম স্ত্রীর সাথে বিচ্ছেদ এবং নির্মলার সাথে বিবাহ?"

"অনির্বাণ বলেছে আপনাকে?"

"উনি নিজেও জানেন কিনা আমি জানি না।"

"হুমম! ব্যাপারটা আড়ালে মিটিয়ে নেওয়া হয়। "

"নির্মলা দেবী আপনাকে blackmail করতে শুরু করেন, এবং তার সহকারী যে ছিল সেই সময় এই কাজে, এখন নতুন দাবী নিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে শুরু করেছে।"

"আজ্ঞে হ্যা! রাকেশ যাদব নামের একজন। আমার স্ত্রীর কলেজ জীবনের প্রেমিক। ওদের মধ্যে যে সম্পর্কটা এখনো রয়েছে তার প্রমাণ পেয়েছি গত বছর। রাকেশ এখন আমার ব্যবসার অর্ধেক মালিকানা চায়। নির্মলা তাকে সেই কাজে সাহায্য করছে।"

"নতুন দাবীর জন্যে এই রাকেশ আর নির্মলা কি বিষয়ে আপনাকে blackmail করেছে?"

"আমাদের পারিবারিক সোনার ব্যবসা এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, বুঝতেই পারছেন, সোজা পথে সবকিছু হয়নি।"

"আর সেই অন্ধকার দিকের হদিশ রাকেশ পেল কিভাবে?"

"নির্মলার প্রতি আমার একটাই দুর্বলতা ছিল, তার শরীর। আর সেই ফাঁদেই পা দিয়ে আমি অনেক কথা বলে ফেলেছি তার কাছে। এখন আফসোস হয় নিজের অল্পবয়সের খামখেয়ালি গুলোর কথা ভাবলে।"

"Income tax এ ফাঁকি দেয়া থেকে শুরু করে, গোপনে সোনার কারবার চালানো, এই সবকিছুর প্রমান তাদের হাতে এসে গেছে?"

"আপনি আমায় বাঁচান শচীন বাবু। আমার বাবা সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধ। আমার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর এক সন্তান আছে। সে-ও এখন বড় হয়েছে, বুঝতে শিখেছে। আমার আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোন পথ নেই। পুলিশে ওপর মহলে আমার চেনা শোনা আছে। আপনি চাইলেই আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি। কিন্তু এই বিপদ থেকে আমায় উদ্ধার করুন।"

"তাহলে পুলিশের সাহায্যই নিতে পারতেন। ব্যাপারটা সরকারি শিলমোহর পেত ?"

"ক্ষমা করবেন। আমি ভুল করে বলে ফেলেছি।"

"সুবীর আপনাকে একটা mobile দিয়ে দেবে। 'শরীরের' লোভে সেটি আবার শত্রূপক্ষের হাতে তুলে দেবেন না। আজকের পর থেকে আমাদের সব কথা এই mobile মারফত হবে। আর কাজ ফুরিয়ে গেলে mobile টা ফেরত দিয়ে দেবেন।"

"নিশ্চই"

"আগামী পরশু রাত সাড়ে নটা নাগাদ আপনার কাছে call যাবে। চেষ্টা করবেন সেই সময় শত্রূ সীমার বাইরে আর পরিষেবা সীমার মধ্যে থাকার।"

"বেশ বেশ! আর আপনার mode of payment টা ?"

"সবটাই cash এ হবে, আর এখন বারো হাজার টাকা advance দিয়ে যেতে হবে।"

"মোটামুটি আন্দাজ কিরকম খরচ পরবে?"

"আপনিই আন্দাজ করুন না! দেখি অঙ্কটা মেলে কি-না?"

"সত্যিই যদি আপনি success পান Mr. সামন্ত। Am ready to pay you any amount."

"বাহ্! তাহলে তো মশাই আপনাকে আমারও blackmail করার একটা সুযোগ আছে দেখছি।"

সমবেত তিনজনেই হেসে ওঠে শচীনের কথায়।

"আপনি ঠাট্টা ভালোই করেন Mr. সামন্ত। Seriously. আপনি নিজের প্রয়োজন মাফিক সমস্ত খরচ পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমার কাজটা ঠিক মত হয়ে যাওয়া চাই।"

আরো টুকটাক কাজের কথা হলে, দ্বিতীয়বার চা-পর্ব শেষ করে ভদ্রলোক বেরিয়ে যান। দু'হাজার টাকার ছ'টা নোট সঙ্গে নিয়ে আমিও বেরিয়ে যাই খুচরো করিয়ে আনতে। আমাদের কাজে, লোকে নিজের রোজগারের টাকা কম দেন, বদলে কালো টাকাগুলি চালিয়ে নেন বেশি।

                                                                            //৩//
প্রায় সাতটা দোকান ঘুরে এক এক জায়গায় একটা করে নোট ভাঙিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম, শচীন সোফায় আধশোয়া অবস্থাতেই ঘুমিয়ে গেছে। বিরক্ত না-করে তার ঘরে ঢুকে, টাকাগুলো নিয়ম মাফিক জায়গায় সাজিয়ে স্নান-খাওয়া সেরে নিলাম। এ'বার কলকাতায় মাত্রাতিরিক্ত গরম পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরোতেই অভক্তি আসে। শচীন আবার খুচরো কাজ করতে ভালোবাসে না। তাই এ'সব দিকগুলো আমাকেই সামলাতে হয়। আর কেষ্ট আমাদের পরিত্রাতা। সময়মত খাবার আর চা-এর যোগান থেকে শুরু করে laundry থেকে কাপড় আনা। একেবারে গুছিয়ে করে দেয়। আমি আসার পর থেকে শচীনের আলসেমি আরো বেড়ে গেছে। আগে তবু নিজে সিগারেট কিনতে যেত। এখন সেটাও আমার দায়িত্বে।

পোশাক পাল্টে আলো নিভিয়ে শুয়ে আজকের case টা নিয়ে ভাবছি, এমন সময় মাথার কাছে একটা ছায়া দেখে চমকে উঠলাম। অন্ধকারে কোন অবসরে শচীন যে আমার মাথার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি।

"ঘুমিয়ে গেলে চলবে?" ঘরের বাতি জ্বালিয়ে আমার laptop টা নিয়ে আসে।

"বাহ! নিজে নাক ডাকিয়ে পাড়া কাপালে এতক্ষন?"

"ভদ্রলোক চুটিয়ে facebook করেন।"

"কি ভাবে বুঝলে?"

"কথা বলার সময় ওনার mobile এর fb messenger এর পিড়িং পিড়িং আওয়াজ শুনে। এই নাও।"

laptop টা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় শচীন।


"ওনার profile টা hack করে দিয়েছি। এবার নির্মলা মল্লিক, আর রাকেশ রাজু, এই দুজনের ছবিগুলো পটাপট save করে নাও। তারপর print করে নাও।"

"বেশ! তারপর?"

"আমার কাজের জায়গা, আর পদ্ধতি সম্পর্কে একটা খসড়া বানানো হয়ে গেছে। কাল থেকে নেমে যাবো।"

"বা বা এর মধ্যেই?"

"সামান্য কাজে বেশি সময় নষ্ট করে লাভ কি বল?"

"সামান্য? আমার তো মনে হয় ভালোই কাঠ-খড় পোড়াতে হবে এই কাজে।"

"কাঠ-খড় পুড়িয়ে রান্নাও করা যায়, মরাও পোড়ানো যায়। এই কাজে রান্নার মতো কাঠ-খড় জোগাড় হলেই হবে। "

" কোথায় যাওয়া হবে, সেটা বলবে?"

"কাল রাতে সব বলব। এখন কাজগুলো সেরে ঘুমিয়ে পর।"

                                                                   //4//

শচীনের সাথে কাজ করা ছাড়াও আমার নিজের একটি ছোট dispensary আছে। মাঝে মধ্যে সেখানে এসে বসি। টুকটাক জ্বর-পেট খারাপের রুগী দেখে ওষুধপত্র দেই। শচীনের অবশ্য সেদিকে বালাই নেই। একবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মানে আর ওদিকে ফিরেও তাকাবে না। পারিবারিক পিছুটান নেই কারণ শচীনের দাদা একাই সেদিক সামলায়।   আমি নিখাদ ভবঘুরে। ডাক্তারি পাশ করে শহরে এসেও কোন ফল না পেয়ে গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম। বাড়িতে বিয়ের তাগাদা শুরু হতেই পালিয়ে এলাম কলকাতা। শচীন একদিন দেখা করে নিজের একটা business idea share করে। নেমে পড়লাম ওর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। একটু যে বিপথে চালিত হতে শুরু করেছিলাম নিজের ethics বা বিবেকের থেকে। টের পেলেও, নেশায় মত্ত মানুষ যেমন আবেগ ভুলে ডুবে থাকে। আমাদেরও সেই পরিণতি হয় অবশেষে।

চেম্বার বন্ধ করে তালা লাগাচ্ছি, এমন সময় শচীন এসে দাঁড়ায়। হাতে একটা pendrive নিয়ে লুফতে লুফতে বলে,

"Mr. মল্লিকের যৌবন জীবনের লীলাময় চলচিত্র আর স্থিরচিত্রের সম্ভার।"

অবাক হয়ে প্রশ্ন করলুম "এ জিনিস কোথায় পেলে?"

"শত্রূদের হাতিয়ার, শত্রূ শিবির ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে বল?"

"রাকেশ এর সাথে দেখা করেছিলি?"

"আগে চা খাওয়া? তারপর সব বলছি। আজকে তোর ভালোই আমদানি হয়েছে, বুক পকেট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।"

আমদানিই বটে। সাকুল্যে বারোশো টাকা পকেটে এসেছে ছয় বছর ডাক্তারি শিখে, আর চার বছর ভাগ্যের উপহাস সহ্য করে। তাও হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে। কলকাতা শহরে ডাক্তারি করার অনেক বিড়ম্বনা। আধুনিক শিক্ষিত মানুষের Net বুদ্ধির ফলে, আমাদের নেট দুর্বিপাকের সীমা নেই। জ্বরের ওষুধের সাথে antibiotic দিলেও, একশ প্রশ্নের জবাবদিহি।

যাক সেসব। কাজের কথায় আসি। চা খেতে খেতে শচীনের কাছে যা শুনলাম, তার সংক্ষেপ হল,

Facebook থেকে যে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল, রাকেশ এখন ছবি তোলার পাশেও একজন DJ র সাথে কাজ করে। DJ আবার এক নারী চরিত্র। মেয়েটির সাথে রাকেশের যে গোপন সম্পর্ক রয়েছে, তা ছবি দেখে আন্দাজ করলেও শচীন সে সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য দেয়। আজ একটি pub এ রাকেশের যাওয়ার কথা, facebook events এ সেই উল্লেখ ছিল।


 অর্থহীন কিছু গানে, অর্থহীন beat সংমিশ্রণ করে অহেতুক পরিবেশন করাই এখনকার হাল fashion. আর তাতেই উন্মত্তের মত নেচে যায় তরুণ-তরুণী। Pub এর এক কোণে বসে beer খাচ্ছিল রাকেশ। চতুর্থ বোতল শেষ করবে বলে চুমুক দিয়েছে, শচীন গিয়ে তার পাশের chair এ বসে।


"সৌগত মল্লিক কে শুনলাম ভালোই বিপাকে ফেলেছেন?"

তিক্ত তরলের খানিকটা উজিয়ে ওঠে রাকেশের। বিষম খেয়ে যায়। একটু সামলে নিয়ে

"কে আপনি?"

"আমায় আপনি চিনবেন না। তবে আমরা দুজনেই যে opportunist সেটা বলতে পারি।"

"Scoundrel, তুমি জানো আমি কে?"

"বিলক্ষণ জানি! পরস্ত্রীদের কাছে ছদ্ম-সুখের পণ্য ব্যবসায় আপনার দোসর কি আর কেউ আছে বলুন?"

"মেরে এই pub এর এক কোণে ফেলে রেখে দেব, কেউ বাঁচাতেও আসবে না। আমায় রাগিও না বলে দিচ্ছি।"

"চোরের ওপর বাটপারি করার মজাই আলাদা। তবে, এটুকু বলতে পারি, আমি আপনার উপকার করতেই এসেছি।"

"তার মানে?"

রাকেশের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে শচীন বলে, "নির্মলা দেবী যে আপনার আর ওই মেয়েটির সম্পর্কের কথা জানতে পেরে গেছেন, সে খবর রাখেন?"

কিছু বলার চেষ্টা করে রাকেশ, তাকে প্রায় থামিয়ে দিয়েই শচীন বলে, " নির্মলা দেবী যে সেই দুঃখে আপনাদের দুজনের সব কথা নিজের স্বামীর কাছে বলে দিয়েছেন সেই খবর রাখেন?"

"What da.......!"

ফোন  নির্মলার নম্বর dial করতে যায় রাকেশ। শচীন আবার বাধা দেয়।

"কোন লাভ নেই।"

"মানে?"

"আপনার থেকে দূরে যাওয়ার জন্যেই মল্লিক বাবু সস্ত্রীক বাইরে যাচ্ছেন।"

"কোথায়?"

"জানাতে আমার কোন দ্বিধা নেই, কিন্তু আমার মুনাফার দিকটাও তো দেখতে হবে?"

"কি চাই আপনার?"


"মল্লিকের company এর অর্ধেক মালিকানা তো আপনি পাচ্ছেন। আমায় যদি সেই  সাপেক্ষে সামান্য কিছু অর্থ দেন, আমি আপনাকে মল্লিকের বিষয়ে অনেক গোপন তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারি।"

"দেখ boss! আমার সাথে এ'সব চালাকি কোরো না!"

"ছি ছি! আমি নবীন মানুষ। আপনার এলেমের সাথে আমার তুলনা চলে? আপনি রাজি হলে, দুজনের লাভ ছিল। আপনার যখন এতই মেজাজ, তখন নাহয় থাক।" টেবিল থেকে উঠে আসার সময় শচীনকে বাধা দেয় রাকেশ।

"কি কি ছবি আছে তোমার কাছে?"

"ব্যবসার কথা কি আর এ'সব জায়গায় বসে হয় বলুন?"

চা পর্ব শেষ করে আমরা হাটতে হাটতে বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছিলাম।

Pub এর ঘটনা শোনার পরে আমি প্রশ্ন করি।

"রাকেশ সব ছবি তোমায় দেখালো?"

"শুধু দেখানোই নয়, নিজে সব কিছু বুঝিয়ে বের করে দিয়েছে। মানে এখন আর মল্লিকবাবু কে blackmail করার মত কোন সামগ্রী ওর হাতে নেই।"

"ওকে manage করলে কিভাবে? পরে তো তোমার খোঁজ করবেই?"

"আগামী আটচল্লিশ ঘন্টার আগে ওর ঘুম ভাঙলে হয়।" শচীন আবার pendrive নিয়ে লুফতে শুরু করে।


"আবার সেই drug abuse?"

"না করলে উপায় কি বল?" হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায় শচীন।

                                                                 //৫//
কথা মত পরের দিন মল্লিক বাবুর হাতে train এর টিকিট আর ছবি সমেত pendrive পৌঁছে দিয়ে আসি। রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ phone করে সব কিছু বুঝিয়ে দেয় শচীন। অবশ্য, plan এর সিঁকিভাগ বলা চলে।
শচীনের plan মাফিক মল্লিকবাবুর প্রাথমিক কর্তব্য ছিল, সস্ত্রীক আলিপুরদুয়ার চলে যাওয়া। সেখানে হোটেল শিপ্রা-আলয় এ ওঠা এবং সেখানকার দোতলার কোন ঘরেই যাতে room পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করা। Train এর টিকিট জোগাড় ও পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বে ছিলাম আমি। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ ছিল জিনিসপত্র গুছিয়ে, contacts জোগাড় করে north bengal যাত্রা।

NJP থেকে গাড়ি ভাড়া নিয়ে সৌগত মল্লিক ও নির্মলা দেবী আলিপুরদুয়ার আসেন। হোটেল শিপ্রা-আলয়ে ১০৫ নম্বর ঘরে থাকার বন্দোবস্ত হয়। এতটা পথ আসার ধকল সামলাতে ঘরেই বিশ্রাম নেন সারাদিন। বিকেলে নিচে হোটেলের canteen এ বসে চা খাচ্ছেন, এমন সময় পিঠের ওপর একটা চর খেয়ে চমকে ওঠেন। মল্লিক বাবুর কলেজ জীবনের বন্ধু অনিমেষ চক্রবর্তী ছুটি কাটাতে এবার এসেছেন North Bengal. গত পরশুদিন অনিমেষ সপরিবারে এসে পৌঁছেছেন আলুপুরদুয়ার। আজ সকালে মাথাভাঙ্গা, জলদাপাড়া হয়ে ফুন্টশিলিং দেখে এইমাত্র ফিরেছেন। Canteen এ বিকেলের টিফিন আর চা order দিতে এসে পুরোনো বন্ধুর সাথে দেখা।

"তারপর কি খবর বল?" চায়ের কাপে সশব্দ চুমুক দিয়ে, চায়ের কাপ টেবিলে রেখে প্রশ্ন করেন অনিমেষ।

"এই চলে যাচ্ছে।" সিগারেট ধরিয়ে বলেন মল্লিকবাবু।

"ব্যবসার খবর কি?"

"Politics আর economy একসাথে হা-ডু-ডু খেলতে শুরু করলে ব্যবসা কি আর ভালো থাকে, বল?"

"সে আর নতুন কি? আগেও ছিল, এখনো আছে।" চা শেষ করে নিজেও সিগারেট ধরান অনিমেষ।

"সেই আরকি। মন-মেজাজ ভালো নেই। তাই চলে এলাম।"

"ভালো করেছিস। আজকেই এলি?"

"হ্যা! কাল রাতে তৎকালে টিকিট পেয়ে গেলাম। চলে এলাম।"

"কোথায় কোথায় যাবি কিছু ভেবেছিস?"

"না না! সুযোগ পেলাম কোথায়। এই চা খেয়ে ভেবেছিলাম, হোটেলের  ম্যানেজার এর সাথে একটা plan বানিয়ে গাড়ি ভাড়া নেব।"

"বেশ তো! আমাদের সাথে চল। কাল আমরা গরুমারা হয়ে যাবো সাঁতালেখোলা। খুব ভালো জায়গা।"
জানলা দিয়ে বাইরের বাগানে সিগারেটটা ফেলে বলেন অনিমেষ।

"আমার আবার!" একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন সৌগত বাবু। একটু ভেবে নিয়ে বলেন, "নির্মলা আবার অন্য কোন plan ভেবেছে কি-না!"

"আহা! বৌদিকে সে ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। আছিস কোন room এ?"

"একশো পাঁচ।"

"বোঝ! আমরা আছি একশো সাতে। ভালোই হল, চল বৌদির সাথে আলাপটা সেরে আসি।"

"এখনই যাবি? আচ্ছা চল?"

"তুই কি নতুন বৌ নিয়ে আবার honeymoon করতে এসেছিস নাকি?"

চমকে ওঠেন মল্লিক বাবু। "মানে?"

"পুরোনো বন্ধুর সাথে বেড়াতে যাবি, এত ইতস্তত করার কি আছে বুঝিনা! নতুন বিয়ে করলে লোকে নাহয় privacy খোঁজে।"

একগাল হেসে পরিস্থিতি কিছুটা সরল করবার চেষ্টা করেন মল্লিকবাবু। তারপর চা-এর দাম মিটিয়ে, reception এ কালকের জন্যে দু'টো গাড়ি book করে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির কাছে আসেন।

"তুই room এ যা বুঝলি। Fresh হয়ে নে।  আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।"

"কেন, কি হল?"

কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে সিগারেট কিনতে যাওয়ার কথা বলে বিদায় নেন সৌগত বাবু। হোটেল থেকে বেরিয়েই শচীনকে ফোন করার চেষ্টা করেন মল্লিক বাবু। এদিকে ফোনে নেটওয়ার্ক নেই দেখে কোনভাবেই যোগাযোগ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। অগত্যা একটা চা-এর দোকান দেখে সেখানেই গিয়ে বসেন।

"বাবু আপনার চা!" একটা বাচ্চা ছেলে চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরে। নিজের চিন্তায় একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন মল্লিক বাবু। বাচ্চাটার ডাকে সম্বিৎ ফেরে।


"Mobile এর roaming service টা off আছে বোধয়। Settings এ গিয়ে ওটা on করে দিন।" পাশে বসা এক ভদ্রলোকের মন্তব্য শুনে একটু হকচকিয়ে যান মল্লিক বাবু।

"আপনি কে?"

"শচীন সামন্তর মক্কেল তো আপনি?"

"আজ্ঞে?"

"আমি শচীন-দার agent. এখনো অব্দি যা যা হয়েছে, সবই শচীন দার plan মাফিক। সাঁতালেখোলা যাওয়ার plan টাও ছিল। কাজেই আগামীকাল বন্ধুর সাথে আপনি সাঁতালেখোলা যাচ্ছেন।"

"কিন্তু আমার কাজ?"

"কালকেই হয়ে যাবে। আজ রাতে বন্ধুকে নিজের ঘরে dinner এ নিমন্ত্রণ করুন। যে ছেলেটা খাবার পৌঁছতে যাবে, তাকে বকশিস দেওয়ার নামে উঠে যাবেন বাইরে। তারপর শচীনদার বলে দেওয়া amount এর টাকাটা ওর হাতে দিয়ে দেবেন।"

"শচীন বাবু কি এসেছেন এখানে?"

"তা আমিও জানিনা। আমায় যা বলতে বলেছিল। বলে দিলাম।"

ভদ্রলোক চা-র দাম মিটিয়ে বেরিয়ে যান।

                                                                        //৬//

সাঁতালেখোলা সত্যি ভারি সুন্দর জায়গা। এক জায়গায় গাড়ি পার্ক করে প্রায় এক কিলোমিটার মত হাটা পথ পেরিয়ে ঝর্ণার কাছে যেতে হয়। একটা ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে ওপারে একটা বাংলোর কাছে যেতে হয়। বেশ ভালোই ভিড় হয় এখানে। গাড়ি পার্কের জায়গায় অনেকগুলি ছোটখাটো খাবার দোকান রয়েছে। সেখানে নেমে মোমো খাওয়া হয়। তারপর খাঁটি দার্জিলিং টি এর চা খেয়ে রওনা দেন ঝর্ণার দিকে। বেশ খানিকটা পথ ঢাল বেয়ে নেমে গেছে। এক পাশে খাদ আর জঙ্গল। পাহাড়ের চুড়োর দিকে সাদা মেঘগুলো লেগে আছে। নির্মলা সেই দেখে বলে পাহাড়গুলো নাকি শ্যাম্পু করে আছে।
অনিমেষের স্ত্রী এবং নির্মলার মিল হয়েছে ভালো। দুজনেই বেশ গোটা রাস্তা নিজেদের ছবি তুলতে তুলতে আসছে। অনিমেষের ও ছবি তোলার বাতিক। DSLR নিয়ে এখানে সেখানে নানা রকম ভঙ্গিতে ছবি তুলে যাচ্ছে। নির্মলাকে আজ ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে।


অনিমেষের দুই ছেলে। বড়োটি সবে স্কুল ফাইনাল দিয়েছে, আর ছোট ছেলেও এক বছর বাদে স্কুল ফাইনাল দেবে।  নির্মলা কোনদিনও মা হতে পারবেনা জেনে খুব আফসোস হত মল্লিকবাবুর। অন্যদিকে প্রথম পক্ষের স্ত্রী তাকে একটি ফুটফুটে সন্তান দিয়েছিল। নিজের খামখেয়ালির জন্যে সেই সম্পর্ক নষ্ট করেছেন মল্লিকবাবু। সুমিত্রার সাথে divorce এর সময় ছেলের যাতে কোন অসুবিধা না হয় সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন মল্লিকবাবু। নিজের ব্যবসার অর্ধেক মালিকানা দিয়েছিলেন প্রথম স্ত্রীর হাতে। শর্ত ছিল, ছেলে কলেজে উঠলে ব্যবসার ভার নেবে। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে ওঠার পর সুমিত্রা তার ছেলেকে নিয়ে এসেছিল বালিগঞ্জের অফিসে। কয়েক যুগ আগে নিজের চেহারার সাথে একদম এক প্রতিফলন দেখে মনটা বড় দুর্বল হয়ে পড়েছিল মল্লিকবাবুর। কেবল মাত্র নিজের স্বার্থের কথা ভেবে যে ভুল করেছিলেন। আজ সেই ভুল যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে পরিহাস করছে।

ছেলেকে দেখার পর থেকেই নির্মলার প্রতি একটা চাপা রাগ জন্মেছিল মল্লিকবাবুর। যার জন্যে সব সুখ সে জলাঞ্জলি দিয়েছিল একদিন। আজ সেই নির্মলাই এক পর-পুরুষের সাথে ফন্দি করে তাকে বিপাকে ফেলতে চাইছে। যে সম্পর্কের শুরুই হয়েছিল অসহায়তার সুযোগ নিয়ে, তার পরিণতি আর কিই বা হতে পারে।

পকেটের মধ্যে তার দুর্বল মুহূর্তের ছবি ভরা pendrive টা মুঠোয় চেপে ধরেন মল্লিক বাবু। খাদের ধারে দাঁড়িয়ে নানা রকম মুখভঙ্গি করে নির্মলা selfie তুলছিল। Pendrive এর ছবিগুলো মল্লিকবাবু আসার আগেরদিন দেখেছেন। নিজের নগ্নতা বোধয় খুব অপ্রিয় হয়ে যায় একসময়। নির্মলার মুখের হাসি এখন বিষাক্ত ছোবল ছাড়া আর কিছু মনে হয়না। সমস্ত আবেগ, প্রেম, ভালোলাগা মুছে গিয়ে শুধুই মনে আসে এক ধাক্কা মেরে যদি খাদে ফেলে দেওয়া যেত নিজের ভুল কাজের মূর্ত প্রতীক কে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটা সংযত রাখার চেষ্টা করেন মল্লিক বাবু।

"মাকড়শার জালটা দেখেছিস?' অনিমেষের কথায় চিন্তার বুহ্য থেকে বেরিয়ে আসেন মল্লিকবাবু।


DSLR তাগ করে, লেন্সের শেষ সীমা ব্যবহার করে মাকড়শার জালের ছবি তুলছে অনিমেষ। সত্যি ভারী আশ্চর্য শিল্প এই প্রাণীর। দুটো গাছের গুঁড়ির মাঝে একটু একটু করে ফাঁদ বানিয়ে রেখেছে। শিকার একটু অন্যমনস্ক ভাবে উড়লেই এসে জড়িয়ে যাবে জালে। তারপর সেই ফাঁদে পেয়ে একের পর এক জলক বিস্তারে ঘিরে ধরবে শিকারী। সামান্য দম নেওয়ার অবকাশটুকু দেবে না। নিজের পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্য দেখেই বোধয় রাগটা মাকড়শার জালে গিয়ে পরে মল্লিকবাবুর। পকেট থেকে পেনড্রাইভ টা বার করে ছুড়ে মারেন জালটার দিকে লক্ষ্য করে। অব্যর্থ নিশানা। মাঝ বরাবর দুভাগে ছিড়ে যায় শিকারির পাতা ফাঁদ।

ছবি তুলতে গিয়ে হঠাৎ এমনভাবে জালটা ছিড়ে যাওয়ায় লেন্স থেকে চোখ সরিয়ে মল্লিকবাবুর দিকে তাকান অনিমেষ। চাপা রাগ তখন সারা শরীরে খেলছে যেন।

"তুই ঢিল মারলি?" মল্লিক এর কাছে এসে দাঁড়ান অনিমেষ। "উফ! সৌগত। তোর স্বভাব আর পাল্টালো না। এখনো কুকুর বিড়াল দেখলে তেড়ে যাস?"

"না এমনিই।" সামান্য হেসে নিজেকে সামলে নেন মল্লিকবাবু।

"তোমরা কি ওখানেই থাকবে?" দলের বাকিরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। অনিমেষ আর মল্লিকের দেরি দেখে প্রশ্ন করেন অনিমেষের স্ত্রী।

আবার চলা শুরু করে দুই বন্ধু। পথটা এখন খাড়াই অনেকটা উঠে গেছে। আগে যে এখানে গাড়ি যাতায়াত ছিল রাস্তা দেখলে বোঝা যায়। পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট খাটো ঝর্ণা এসে পড়েছে রাস্তায়। আবার রাস্তা পেরিয়ে নেমে গেছে খাদে। ব্রিজের কাছে এসে ঝর্ণার রূপ দেখে সব অভিমান রাগ যেন মুছে যায়। পকেট থেকে ফোন বার করে ছবি তুলতে শুরু করেন মল্লিক বাবু।


নির্মলা আর অনিমেষের স্ত্রী ঢাল বেয়ে ঝর্ণার কাছে নেমে গেছে। অনিমেষের দুই ছেলেও এক পাথর থেকে অন্য্ পাথরে লাফিয়ে জলের স্রোতের সাথে খেলছে। অনিমেষ এক পাশ দিয়ে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে ছবি নিচ্ছে।

"এই শুনছ! আমার একটা ছবি তুলে দাওনা প্লিজ।" নির্মলা ডেকে বলে।

ঝর্ণার বিভিন্ন এক এক জায়গায় স্রোত এক এক রকম। সেইভাবে background নিয়ে খান কতক ছবি তুলে দিলেন মল্লিক।



প্রায় আধ ঘন্টা এইভাবে কেটে গেল টের পায়নি কেউ। একটা ছেলে চা নিয়ে আসায় সবাই মিলে বসা হয়। অবশ্য অনিমেষের স্ত্রী বা নির্মলা নিজেদের ছবি তুলতেই ব্যস্ত ছিল। Resort এর এক ঢালে কিছু বেঞ্চ আর চেয়ারের ব্যবস্থা আছে। সেখানে বসে দুই বন্ধু মিলে চা নেয়।

"বাবু ছবি তুলবেন?" একটি অল্পবয়সী ছোকরা গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।

"আমাদেরই তো ক্যামেরা আছে?" অনিমেষ বলে।

"একটা ছবি তোলান না সাহেব। মাত্র কুড়ি টাকা। Instant photo."

"বাহ্ বাহ্! এখন এখানেও এই ব্যবসা? পুরী-দীঘা ছেড়ে এখন পাহাড়েও?" অনিমেষ মল্লিকের দিকে তাকিয়ে বলে।

"কুড়িটা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে না বাবা?"

"এই করেই তো রোজগার সাহেব। কুড়ি টাকায় আজকাল ভালো চাল ও পাওয়া যায়না।"

"তো আর কোন ধান্দা করতে পারো তো?" অনিমেষ বলে।

"মা-এর দোকান আছে ওই parking lot এ। এই সকালেই আমাদের যা ব্যবসা সাহেব। সন্ধ্যেবেলা তো কেউ আসে না। আমি এখন ছবি তুলি। মা দুকান সামলায়।"

"আহ ছাড়ো না অনিমেষ।" অনিমেষ আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মল্লিক বাধা দিয়ে বলে ওঠে।

"শোন ছোকরা। আমাদের দুই বন্ধুর ভালো দেখে পাঁচটা ছবি তুলে দাও দেখি। ভালো হলে তবেই টাকা দেব।"

ছেলেটি বিভিন্ন জায়গায় দাঁড় করিয়ে, পাথরে বসিয়ে ছবি তুলে দেয় পাঁচটা। ছবি হাতে নিয়ে দাম মেটানোর সময় অনিমেষের স্ত্রীর চিৎকার শোনা যায়। Mobile এ ছবি তুলতে তুলতে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল নির্মলা। সবার চোখের আড়ালেই চলে গিয়েছিল প্রায়। একজন tourist হঠাৎ জলে কিছু পড়ার শব্দ শুনে এগিয়ে গিয়ে দেখে নির্মলা ভেসে যাচ্ছে স্রোতের টানে। ঐদিকে কেউ যায়না কারণ স্রোত বেশি। পাথরগুলোতেও শ্যাওলা জমে আছে। পা স্লিপ করে তাল সামলাতে না পেরে জলে পরে গিয়েছে নির্মলা। ছবি তোলার ছেলেটা সৌগতর কাছে ফোনটা চায় পুলিশে ফোন করবে বলে। সৌগত নিজের ফোনটাই দিতে গিয়েছিল, কিন্তু tower নেই দেখে ছোট ফোনটা দেয়। অনিমেষ এগিয়ে গিয়েছিল অনেকটা। ফোনটা হাতে নিয়ে আমি নিজের টুপিটা খুলে বললাম, "আপনার কাজ হয়ে গেছে সাহেব।" ব্রিজ পেরিয়ে আসার সময় একবার ফিরে দেখেছিলাম। হতভম্ব হয়ে একই ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন সৌগত মল্লিক। সাঁতালেখোলার রূপ আর বন্ধুর সঙ্গ পেয়ে বোধয় ভুলেই গিয়েছিলেন আমাদের ওপর দেওয়া দায়িত্ব।


                                                                          //৭//
কলকাতার অনেকগুলি কাগজেই খবরটা বেরিয়েছিল। "Accidental death of Nirmala Mullik". কাগজটা নামিয়ে শচীনের দিকে তাকাতে দেখি সে অতি কষ্টে কুঁজো হয়ে বসে পা-এর নখ কাটতে ব্যস্ত।

"সেদিন মল্লিকবাবুর অভিব্যক্তিটা দেখার মত ছিল। আমি তো সামনেই ছিলাম। উনি বোধয় expect করেননি এইভাবে আমরা কাজটা করে দেব।"

"তাহলে শ্মশানে মল্লিকবাবুর অভিব্যক্তিটা দেখলে কি বলতি?"

"তুই গিয়েছিলিস শ্মশানে?"

"বা-রে! যাবোনা? নিজের কুকীর্তির প্রমাণপত্র আগুনে পুড়ে ছাই হল কিনা চাক্ষুস করব না?"

"কি দেখলি?"

ডান পায়ের নখ কাটা শেষ করে বাম পায়ের নখগুলো কাটতে কাটতে বলে,

"মল্লিকবাবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নির্মলা দেবীর শরীরটার সামনে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে একবার নিচু হলেন। তারপর নির্মলা দেবীর কপালে নিজের ঠোঁট ছুঁয়ে ফিসফিস করে কিছু বললেন। সমবেত সবাই ভাবল আহা কি ভালোবাসা। তবে....."

"তবে?

"সত্যি চোখের জল ফেলতে দেখলাম আরেকজনকে।"

"কে?"

"রাকেশ যাদব"

"সে-ও গিয়েছিল নাকি?"

"এক কোণে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও মল্লিকবাবুর কাছেও ব্যাপারটা এখনো shocking."

"আর যোগাযোগ করেছিলেন?"

"না না! পাগল নাকি? একটা জিনিস যেটা বুঝলাম এই কাজটা করে..."

"কি বুঝলি?"

"দ্বিতীয় পক্ষ ব্যাপারটা বেশ রসের। কি বলিস?"

"ব্যোমকেশ থেকে dialogue ঝেপে বলছ ভায়া? এদিকে আমাদের পিছনে যে কোন টিকটিকি কবে লাগবে তার নেই ঠিক।"

"সে কি আর লেগে নেই ভাবছিস? তাই বলে সেই রসে বঞ্চিত থাকাটাও কি জরুরি?"

"আরে বাবা! তুই কি বিয়ের মতলব আটছিস নাকি?"

"পাগল! যা কাজ করি, কবে আমাকেই পটল তুলতে হবে তার নেই ঠিক। খামোকা একটা মেয়েকে কষ্ট দেব?

আমি আবার কাগজে মন দি। এমন সময় শচীনের mobile এ একটা ফোন আসে। নখ কাটতে ব্যস্ত থাকায় আমায় ইশারা করে ফোনটা ধরার জন্যে।

"হ্যালো"

"কৌস্তভ আছে?" ওপার থেকে এক নারী কন্ঠস্বর ভেসে আসে।

আমি অবাক হয়ে শচীনকে বললাম, কৌস্তভ কে চাইছে। প্রায় ছোঁ মেরে ফোনটা আমার হাত থেকে নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। নতুন মক্কেল, না কৌস্তভের প্রেমিকা, আমি জানিনা। শুধু খবরের কাগজে একটা ছবি দেখে সেদিনের কথা মনে পরে গেল। নির্মলা আর অনিমেষবাবুর স্ত্রী ব্রিজটাকে background করে দাঁড়িয়ে আছেন। আর দুই বন্ধু মিলে ছবি তুলছেন। শচীন নিজের location এ পৌঁছে গেছে। আমিও মেক-আপ নিয়ে মল্লিকদের আশেপাশে ঘুরছি। সেই মুহূর্তের তোলা নির্মলা দেবীর একটা ছবি কাগজে বেরিয়েছে।














গল্পের সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবে কারো সাথে কোন ঘটনার মিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয়। 

সহকারী: আগন্তুক। 
 কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Google images .












কোন মন্তব্য নেই: