শুক্রবার, ১৬ জুন, ২০১৭

Alarm Clock

                                                                      //১//

মিনিটের কাটা ছয়ের ঘরে আসতেই তারস্বরে চিৎকার শুরু করে দেয় অ্যালার্ম ঘড়িটা। সাড়ে পাঁচটা বাজে। চোখ কচলে উঠে বসে সিদ্ধার্থ। ঘড়ির চিৎকার বন্ধ করে বিছানা থেকে নামে। তার শোবার ঘরের জানালাটা দক্ষিণ দিকে। পুবের আকাশের ঘোলাটে আলোটা বেশ উপভোগ্য বলে মনে হয় এই সময়টায়। আর পুকুর পার upথেকে ভেসে আসা ঠান্ডা হাওয়াটা, ঘুমের আমেজ কাটিয়ে দিনের শুরুটা বেশ ফুরফুরে করে দেয়। পড়ার টেবিল থেকে চশমাটা চোখে নিয়ে বাথরুমের দিকে যায়। নতুন একটা দিনের শুরু।


Shave করে, দাঁত মেজে, স্নান সেরে নেয়। মোটামুটি সোয়া ছ'টার মধ্যে প্রাথমিক কাজগুলি সারা হয়ে যায়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে চুল আচড়াচ্ছে, এমন সময় doorbell বেজে ওঠে।

কাগজওয়ালা এসেছে। দরজা খুলে কলাপ্সিবল গেটের গায়ে বেঁধে দিয়ে যাওয়া কাগজ আর দুধের প্যাকেটটা নেয়। একই সময় ও'পাশের ফ্ল্যাটের তারক বাবুও দরজা খোলেন। আজ প্রায় চার বছর তারা প্রতিবেশী। কিন্তু দু'জনের দেখা সাক্ষাৎ ওই সকালের কাগজ নেওয়ার সময় টুকুই। একগাল হাসি নিয়ে সিদ্ধার্থ good morning wish করে। তারক বাবুও হাই জড়ানো আলসে একটা প্রত্যুত্তর দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। 

Sports shoe পরে নেয় সিদ্ধার্থ। সকালের বেড়াতে যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। বন্ধুর দিয়ে যাওয়া দার্জিলিং চা আর টোস্ট দিয়ে breakfast সেরে আধা ঘন্টা মত jogging করে নেয়। বিলাসপাড়ার মাঠে গিয়ে একটু free hand exercise.

তারপর পলটু-দার দোকানে আরেক কাপ চা খেয়ে বাড়ি ফিরে আসে। কাজে বেরোবার আগে তখনো এক ঘন্টা সময় থাকে হাতে। এই সময়টা কাগজ পরে, অফিসে নিয়ে যাওয়ার টিফিন বানিয়ে, আর বারান্দায় শুকোতে দেওয়া গত দিনের জামা কাপড় তুলে পেরিয়ে যায়। নিয়ম মাফিক আটটা পঁয়তাল্লিশের metro ধরে সিদ্ধার্থ। সাড়ে আটটা তে বেরোলেও পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু ঘড়ি ধরে সোয়া আটটার মধ্যেই সে বাড়ি থেকে বেরোয়। অফিসের ব্যাগ, টিফিনের ব্যাগ আর একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে laundry তে দেয়ার জামা কাপড় নিয়ে সে বেরিয়ে পরে।


টিকিট কাটবার প্রয়োজন পরেনা কারণ smart card করা আছে। Escalator দিয়ে উঠে বাঁদিকে ঘেসে এগিয়ে গিয়ে যে বড় টিভি-টার নিচে বেঞ্চ রাখা। সেখানে গিয়ে বসে অপেক্ষা করে নির্দিষ্ট train এর জন্যে। এই বেঞ্চে বসার কারণ, এখানকার TV টা খারাপ হয়ে গেছে কয়েকদিন যাবৎ। Metro কতৃপক্ষ এখনো না সারিয়ে ভালোই করেছে। এই ঘ্যান ঘ্যান শব্দ একদম ভালো লাগেনা সিদ্ধার্থর। আপেক্ষিক কিছু মুহূর্তের রঙিন প্রক্ষেপন। আর তাই নিয়েই লোকের মাতামাতি। নরেন্দ্রপুর এ থাকা কালীন একটা কথা শিখেছিল সিদ্ধার্থ। আকাশের দিকে তাকিয়ে চলাই যায়। কিন্তু নজর ওই ফুটপাথে থাকা ভালো। কারণ, দৈনিক জীবনটা ওখানেই সীমাবদ্ধ। ঠিক সময়ে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকে যায়। নিত্যদিনের অফিস যাত্রীদের ভিড় ইতিমধ্যে জমে গেছে। বহু পরিচিত মুখের ভিড়েও একলা একক সিদ্ধার্থ নিজের আরেকটি দিনের যাত্রা শুরু করে। মেট্রো রেলের দরজাগুলো খুব চেনা বলে মনে হয়। তার জীবনের ঘটনাগুলিও যেন ওই মেট্রোর দরজার মত একই ভাবে, একই ছন্দে, একই কাজে অবিরাম ঘটে চলেছে। আর সে নিজেও ওই ভিড়ের মত নিয়ামক দরজার হিসেব বুঝে একবার ঘটনার মধ্যে আরেকবার বাইরে যাতায়াত করে চলেছে।


                                                                 //২//
"Thank you soooo much. You're such a darling. Thanks again."


এত মিষ্টি করে কেউ তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে কি? কিছুক্ষন ভেবেও ইতিহাসের পাতায় এমন ঘটনার সাক্ষ্য প্রমাণ না দেখে শেষে নিজের desk এর দিকে রওনা দেয় সিদ্ধার্থ। অফিসের এই মেয়েটির প্রতি তার আগ্রহ কোনকালে ছিলনা। গত মাসে sales figure গুলো manager এর ঘরে জমা দিতে গিয়ে এই মেয়েটির সাথে আলাপ। আগে Salt lake branch এ ছিল, সম্প্রতি বদলি হয়ে এখানে এসেছে। আলাপের সময় নিজের নাম বলতে গিয়ে একটু তোতলা হয়ে গিয়েছিল সিদ্ধার্থ। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে একটু থুতুও বোধয় ছিটকে বেরিয়েছিল। সেই দেখে মেয়েটি যা হেসে ফেলেছিল। সিদ্ধার্থ আজও সেই হাসির কথা ভেবে নিজে হেসে ফেলে। 

"Hi." এক গাল হাসি আর মিষ্টি একটা গন্ধ মাখা পরিবেশ সৃষ্টি করে এগিয়ে এসেছিল মেয়েটি আলাপ করতে। Manager এর ঘর তখনো ফাঁকা। ঘরের কোণে রাখা Aquarium এর মাছগুলির সাথে খেলা করছিল মেয়েটি। হঠাৎ করে সিদ্ধার্থ ঘরে ঢুকে পড়ায় তাকেই ম্যানেজার ভেবেছিল বোধয় মেয়েটি। আর সেই কারণেই হয়ত  ঐভাবে আলাপ করতে এগিয়ে এসেছিল। 

"Hello" একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরেই উত্তর দেয় সিদ্ধার্থ। 

"Am Payel. Payel Mitra."

"আমি সি....দ দ ধার্থ।" অন্য সময় এরকম হয়না। কিন্তু সেদিন হয়ে গিয়েছিল। আর পায়েল খিলখিল করে হেসে ফেলেছিল। ঢিলে হয়ে যাওয়া চশমা, হাতের ভর্তি ফাইল আর তোতলা হয়ে গিয়ে ঠোঁটের বেসামাল থুতু। সব কিছুর জেরেই একটু বিব্রত হয়ে পরেছিল সিদ্ধার্থ। 

পরে অবশ্য একবার আলাপ হয়েছিল। ক্যান্টিনে সিদ্ধার্থ একা একটা ফাঁকা টেবিলে বসে lunch করে। সেদিন পায়েল এসে বসেছিল সাথে। বলেছিল তারও নাকি ভিড় একদম পছন্দ নয়। বিকেলে অফিস থেকে বেরোবার সময় সিদ্ধার্থ দেখেছে। পায়েল একটা স্কুটি নিয়ে অফিসে আসে। ওঠার আগে গায়ে একটা লাল রঙের জ্যাকেট চাপিয়ে নেয়। খুব মিষ্টি লাগে মেয়েটিকে লাল রঙে। Kiosk এর আড়াল থেকে, কফি মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে, কিংবা ছোটেলাল এর বিড়ি কর্নার থেকে উঁকি দিয়ে মাঝে মধ্যেই পায়েল কে দেখত সিদ্ধার্থ। নিজের যে কোন বাসনা থেকে এই কাজ সে করত, তা কিন্তু মোটেও নয়। কিন্তু দেখতে ইচ্ছে করত।


                                                               //৩//
"কি হে ভায়া! আজ তোমার এত দেরী?" এই প্রথম উল্টোদিকের ফ্ল্যাটের তারক বাবুর গলার আওয়াজ শুনল সিদ্ধার্থ। 

না, আজ সত্যি খুব দেরী হয়ে গেছে। অন্যান্য দিন হাজরায় নিজের অফিসে সাড়ে ন'টার মধ্যে ঢুকে যায় সিদ্ধার্থ। সেখানে আজ সে দশটার পরে বাড়ি থেকেই বেরোচ্ছে। 

"ওই আরকি। অ্যালার্ম ঘড়িটা ঠিক সময় বাজেনি বোধয়।" দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে বলে সিদ্ধার্থ। 

"আর তোমার অ্যালার্ম। বাবা!! ওইটের নাম নিও না।  ভোর রাত্তির থেকে তোমার অ্যালার্ম ঘড়ির চিৎকারে সত্যি ঘুমোনো দায় হয়ে যায়।"

"ভোর রাত্তির?" অবাক হয় সিদ্ধার্থ। সত্যিই, এই জন্যেই বাঙালির উন্নতি হয়না। সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে না উঠলে দিন শুরু হয় নাকি? একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে চাবি পকেটে নিয়ে lift এর দিকে এগোয় সে। তারক বাবুও সঙ্গে আসেন। 

"তোমার অফিস কোথায় হে?"

 "হাজরা।" অফিসের ব্যাগে বিশেষ খাপে ঘরের চাবিটা ঢুকিয়ে পিঠে নিয়ে নেয় ব্যাগটা। অন্য দিনের মত আজ আর টিফিন বা laundry তে দেওয়ার কাপড় জামা নেই। কাজেই হাত ফাঁকা। 

"বাহ্! বেশ তো। চলো তোমায় একটা lift দিয়ে দিচ্ছি। আমার গাড়ি তো রাসবিহারী হয়েই যাবে। "

"আজ্ঞে না-না। তার প্রয়োজন হবে না। আমি metro তে যাই।"

"আরে চলো চলো। এখন মেট্রোতে শ্বাস ফেলার ও জায়গা পাবে না। আমার গাড়িতে সুন্দর যাবে। রাসবিহারী থেকে তারপর অটো ধরে নিলেই হবে। 

অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারক বাবুর প্রস্তাবটা নিতে বাধ্য হয় সিদ্ধার্থ। গাড়িতে বসার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় তারক বাবুর প্রশ্নবাণ। চার বছরের জমিয়ে রাখা সব কৌতূহল যেন আজকেই মিটিয়ে নিতে চান। 

"তা ভায়া যা বলছিলাম। অত রাত অব্দি জেগে তুমি করটা কি?"

"আমি তো বেশি রাত অব্দি জাগিনা?" একটু বিরক্ত ভাব এনেই বলে সিদ্ধার্থ। 

"বলো কি? তোমার উল্টো দিকের ফ্ল্যাট, Mr. দেব তো এই সেদিনও বললেন। তুমি নাকি সারারাত আলো জ্বেলে রেখে দাও। ওনার বেডরুম আবার সেটা। পর্দা না লাগালে ঘুমোনোই যায়না। এখন শীতকাল তাই বাঁচোয়া। গরমে জালনা বন্ধ করে পর্দা টেনে ঘুমোনো সত্যি শাস্তি।"

"আপনার কথাগুলির কোন মানেই বুঝলাম না। ওনার অসুবিধা হয়, সেটা আমায় না জানিয়ে আপনাকে বলতে গেলেন কেন?"

"তুমি ভায়া একদিনও কমিটি মেম্বারদের মিটিঙে এসেছ? আর তোমার টিকির নাগাল পাওয়া যায়?"

"আপনি কি কমিটি মিটিংয়ের গল্প শোনাবেন বলে আমায় গাড়িতে তুলেছেন?"


"আরে না ভাই না। সেই কারণে কেন হবে? কোন কারণেই নয়। তা বিয়ে শাদী যে করোনি দেখেই বোঝা যায়। মা-বাবা?"

"দেশের বাড়িতে থাকেন।"

"তুমি এক ছেলে?"

"বোন আছে। কলেজে পড়ে।"

"তা বেশ! প্রেম-টেম করোনা বোধয়?"

"আজ্ঞে প্রয়োজন মনে হয়নি। আর কিছু?"

"আহা  বিরক্ত হচ্ছ কেন? আসলে একটু খোঁজ খবর নিচ্ছি কারণ, আমার স্ত্রীর আবার তোমায় বেশ পছন্দ। আমার ছোট শালীর মেয়ে সবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে কলেজে উঠেছে। তাই একটা।....."

"আরে !!" গাড়ির জালনা দিয়ে কিছু দেখে মন্তব্য করে সিদ্ধার্থ। "গাড়ি থামান, গাড়ি থামান।"

"কি? কি দেখলে?"

"ভালো সিঙ্গাপুরি কলা বিক্রী হচ্ছে ওই দোকানটায়। আজকের টিফিনে।..." কথা শেষ না করেই গাড়ি থেকে নেমে পরে সিদ্ধার্থ।

"আমার জন্যেও এক ডজন নিয়ে এসো তো! টাকা দিয়ে দেব?"

"আজ্ঞে না লাগবে না।" গাড়ি থেকে নেমে দরজা লাগিয়ে পিছন থেকে আসা গড়িয়াহাট যাওয়ার একটা Auto তে উঠে পরে সে। ভোম্বল হয়ে গাড়ির জালনা দিয়ে তার চলে যাওয়া লক্ষ্য করেন তারক বাবু।


                                                                    //৪//
"তোমার মত ছেলেদের এই মেয়ে দেখলেই ছুকছুকানি স্বভাবটা বড্ড বিরক্তিকর। How could you imagine যে আমি তোমার সাথে সিনেমা দেখতে যাবো?" বিষোদগারের মত পায়েলের কথাগুলি নীলবর্ণ করে দেয় সিদ্ধার্থ কে।


"আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করবেন।" আমতা আমতা করে বলে সিদ্ধার্থ।

"আর একটা কথাও শুনতে চাইনা। Please এখান থেকে চলে যাও।"

"Am Sorry" ক্ষমাটা আদৌ চাইবার প্রয়োজন ছিল কি-না বুঝে পায়না সিদ্ধার্থ। সে তো কোন অন্যায় করেনি। সিনেমায় যাওয়ার কথা আজ নাহয় সে জানিয়েছে। কিন্তু নতুন কোন সিনেমা আসলে, আগে থেকে টিকিট কাটিয়ে, এতদিন পায়েল তো নির্দ্বিধায় তার সঙ্গ নিয়েছে।

আজ হঠাৎ অফিসের লোকজনের সামনে এমনভাবে scene করবার কোন কারণ তো ছিল না। তার মানে এই সিনেমাটা কি ভালো নয়? সে তো পায়েলের সাথে অভব্য আচরণ করেনি কোনদিন? নিজের প্রশ্নগুলির কোন সদুত্তর খুঁজে পায়না সিদ্ধার্থ। মাথা নিচু করে তার অপদস্ত হওয়া দেখে হাসতে থাকা মুখগুলির ভিড় থেকে নিজেকে আড়ালে নিয়ে চলে যায়।

অফিস ছুটি হওয়ার পরে parking lot এ একজায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল সিদ্ধার্থ। পায়েল কে আসতে দেখে এগিয়ে যায়।

"তুমি? আবার কি চাই?" খুব বিরক্তির সাথে বলে পায়েল।

"আমি কি কোন ভুল করে ফেলেছি? যদি আমার অজান্তে কিছু ভুল করে থাকি, ক্ষমা করবেন।"

"ভুল? You scoundrel. তুমি অফিসে বলে বেড়িয়েছো আমি তোমার girlfriend? আমি তোমার সাথে movie যাই, dinner করতে যাই?"

"আমি girlfriend এর কথাটা কাউকে বলিনি, সিনেমা দেখতে যাওয়ার কথা বলেছি। কিন্তু?...."

"আর তাতেই আমি তোমার girlfriend হয়ে গেলাম? Moron!"

"আপনি এইভাবে react করছেন কেন? আপনি তো আমার সাথে movie দেখতে গিয়েছেন?"

"So what? আমি তোমার girlfriend  হয়ে গেছি? তুমি যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াবে?"

"কিন্তু আমি কি বলেছি সেটাই তো বুঝতে পারছি না?"

"Listen, you son of a bitch.. তোমার মা তোমায় কি শিক্ষা দিয়ে বড় করেছেন আমি জানিনা। But better এর পর থেকে তোমার মুখটা যেন আমায় দেখতে না হয়।"

স্কুটি চালিয়ে বেরিয়ে যায় পায়েল।

শেষ কিছু কথা মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে শুরু করে সিদ্ধার্থর। Auto করে রাসবিহারী অব্দি এসে অটোয়ালা খুচরো চাইতেই দুম করে বলে ফেলে, "So what? You Son of a bitch."  অটোয়ালা তো নেমে এসে এই মারে কি সেই মারে। সহযাত্রীদের সাহায্যে সেই যাত্রা রেহাই পেয়ে যায়।


                                                                     //৫//

দিন ভালো যাচ্ছিল না সিদ্ধার্থর। পায়েল এর সাথে সে কি করেছে, নিজেও জানে না। কিন্তু অফিসের অভ্যন্তরীন পরিবেশ ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কলিগ থেকে শুরু করে বেয়ারা অব্দি সবাই, তাকে হীন চোখে দেখে আজকাল। আজ মালিক পক্ষের মিটিঙে তার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। খবর পেয়ে জেনেছে, আগামী মাসেই হয়ত তাকে নোটিশ দেওয়া হবে। বাড়িতে অসুস্থ বাপ-মা, একটা ছোট বোন।তাদের সম্পূর্ণ দায়িত্ব প্রায় সিদ্ধার্থর কাঁধে। এই এবস্থায় চাকরী গেলে আবার চাকরী পাওয়া যে কতখানি সমস্যার। সম্বল বলতে যা কিছু, তা ওই LIC policy আর PF এর টাকা কিছু। মরে গেলে সেই টাকা দিয়ে বছর দু-এক চালিয়ে নিতে পারবে মা-বাবা। বোনের নামে যে policy টা সে করে রেখেছে, সেটা mature করলে বিয়ের খরচ উঠে যাবে। তাহলে কি suicide করবে? Suicide করলে কি Insurance অফিস থেকে টাকা দেবে? নাকি accidental death হলে?


কলেজ পাশ করবার পর থেকে একদিনের জন্যেও নিজেকে সময় দেয়নি সিদ্ধার্থ। বাড়ি-অফিস আর বোনের চিন্তায় কাজ করে গেছে। বিয়ে করা দূরে থাক, সামান্য প্রেমটুকু করেনি খরচ বাঁচাবার জন্যে। একটি মেয়েকে সামান্য ভালো লেগেছিল; তাও মেয়েটি তাকে সময় দিয়েছিল বলেই। আর আজ কোন একটা কথার ওপর ভিত্তি করে এমন scene তৈরী হল অফিসে, যে তার চাকরি যেতে বসেছে।

যতীন দাস পার্ক metro station টা ন'টার সময় বেশ ফাঁকা হয়ে যায়। স্টেশনের শেষ প্রান্তে একটা বেঞ্চে বসে এইসব কথাই ভাবছিল সিদ্ধার্থ। অন্ধকার গুহা থেকে একটা দমকা হওয়ার ঝলক আসায় টের পায় সময়ের হিসেব। একটা ট্রেন আসছে। উঠে দাঁড়ায় সিদ্ধার্থ। লাইনের কাছে এগিয়ে যায়। হলুদ লাইনটা প্রায় পেরিয়ে গেছে। ঐতো! গুহার ভিতর থেকে আলো দেখা যাচ্ছে। মুক্তির আলো! সময় বুঝে, ট্রেন টা স্টেশনে ঢোকার মুহূর্তেই ঝাঁপ দেয় সিদ্ধার্থ।

ঘুমটা ভেঙে যায়। একরকম ধড়ফড় করেই উঠে বসে বিছানায়। জামাটা ঘামে ভিজে জবজবে।

অন্ধকারে কোনমতে জলের বোতলটা খুঁজে নিয়ে বেশ খানিকটা জল খেয়ে নেয় সে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। একটু ধাতস্ত হলে জালনার ধারে গিয়ে বসে। একটা সিগারেট যেই ধরিয়েছে, অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে ওঠে। নিজের ঘড়ির শব্দে নিজেই চমকে উঠেছিল সিদ্ধার্থ। ঘরের আলো জ্বালিয়ে বিছানার পাশে টেবিলটায় রাখা অ্যালার্ম ঘড়িটা বন্ধ করে। রাত এখন তিনটে ত্রিশ। এই সময়ে অ্যালার্ম তো সে দেয় নি? ধন্দটা কাটিয়ে অ্যালার্ম এর কাটা ঘুরিয়ে সাড়ে পাঁচটায় করে দিয়ে আবার শুতে চলে যায়। আধ খাওয়া সিগারেট টা ashtray তে ধোয়ার কুন্ডলি বানাতে বানাতে শেষ রাতের নির্ঘন্ট কে আরো খানিকটা ধোঁয়াশা করে দিয়ে যায়।


                                                                   //৬//
"কি হে সিদ্ধার্থ? তোমার patient কেমন আছে এখন?"

"না স্যার, We are losing him. Acidosis টা যে level এ বেড়েছে, patient survive করলে হয়।"

"Creatinine কত এখন?"

"Rising স্যার। Last count 7.8 cross করে গেছে।"

"Renal function তো তার মানে?" Report গুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেন ড: পার্থ সারথী।


"Wait করছি sir. Relatives রা mentally prepared. আমরাও অপেক্ষা করছি।"

"চলো, কি আর করা যাবে। You've tried your best."

নিজের চেষ্টার গাফিলতিগুলি আরেকবার ঝালিয়ে নেয় সিদ্ধার্থ। না, সেই ভাবে কোন ভুল বা খামতি তার চিকিৎসা পদ্ধতিতে ছিল না। কিন্তু তবুও একটা patient আজ তার হাতে মারা যাবে। যমদূত যেন একরকম ছিনিয়ে নিয়ে গেল রুগীকে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যান ড: পার্থ। ঘন্টা খানেক এর অপেক্ষা আর। Critical unit এ কম করে হলেও একশোর উপর রোগী মৃত্যু দেখেছেন তিনি। House staff থাকাকালীন প্রথমবার একজন রুগীকে মারা যেতে দেখে প্রায় এক মাস সময় লেগেছিল নিজেকে সামলে নিতে। .আজকাল ডাক্তারদের সবাই পেশাদার খুনী বলে মনে করে। কিন্তু একজন চিকিৎসাধীন রুগীর মৃত্যু যে মানসিক ভাবে একজন ডাক্তারের কাছে কতখানি পীড়াদায়ক, কেউ বুঝতে পারবেনা। Junior doctor সিদ্ধার্থ কে দেখে তাই নিজের পুরোনো দিনগুলির কথা মনে পরে যায় ড: পার্থর।


OPD থেকে রুগী দেখে ফেরার আগে একবার ward visit এ গিয়েছিলেন তিনি। বেরোবার সময় সিদ্ধার্থকে দেখেছিলেন। Corridor এ একজন ভদ্রমহিলা সিদ্ধার্থর জামার কলারটা খিমচে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।  বুঝতে বাকি থাকেনা, কোন bed এর রুগীকে একটু বাদেই সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে মর্গে নিয়ে যাওয়া হবে। আর তারপর তুলে দেয়া হবে পরিবারের লোকের কাছে।


                                                                       //৭//
বারবার কলিং বেলের শব্দে ঘুমটা ভেঙে যায় সিদ্ধার্থর। উঠে গিয়ে দরজা খুলতে, সামনে কতগুলি অচেনা মুখ দেখতে পায়।

"বাবু, আজ প্রায় তিন মাস হয়ে গেল। আমাদের বাকি টাকাগুলো।....." সমবেত ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে।

"কিসের টাকা?" আড়মোড়া ভেঙে, আধ বোজা মুখে একটা অসম্পূর্ন হাই তুলে প্রশ্ন করে সিদ্ধার্থ।

"আমি খবরের কাগজ বাবদ প্রায় পাঁচশ টাকা।" ...... "আর আমি সতেরোশো টাকা, দুধের দাম বাবদ।"

"এখন তো বাবু নেই। কাল এসো। আমি টাকা রেখে দেব। "

কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই দরজা লাগিয়ে আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে সিদ্ধার্থ। আধঘন্টাও পেরোয়নি, অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দে আবার ঘুমটা ভেঙে যায়। খুব বিরক্ত ভাবেই অ্যালার্ম বন্ধ করতে গিয়ে সময়ের দিকে চোখ যায়। উঠে পরে বিছানা থেকে। তারপর brush করে shave করে, স্নান সেরে নেয় ঝটপট। পোশাক পাল্টে morning walk এ বেরিয়ে যায়।



"আজকাল আর এদিকে আসেন না? খুব ব্যস্ত নাকি?"

পলটুর কথায় ভার থেকে খানিকটা গরম চা ছলকে পরে যায় নতুন কেনা গেঞ্জিতে।

"এহে হে!! সাদা জামাতে চা পরে গেল? জল দিন শিগ্গির।" জলের কেটলিটা নিয়ে পলটু নিজেই এগিয়ে আসে।

জল দিয়ে চা পরে যাওয়া অংশটুকু ধুয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয় সিদ্ধার্থ। আজ আবার south এর ট্রেন বন্ধ থাকবে নাকি। Metro তে ভিড় হবে খুব। ফ্ল্যাট এ পৌঁছে সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় উল্টো দিকের flat এর দেব বাবুর সাথে দেখা।

'এই যে। আপনার সাথে দেখা করব বলেই এসেছিলাম। এতক্ষন অপেক্ষা করেও কেউ দরজা খুলছে না দেখে ফিরে যাচ্ছিলাম।' বেশ কিছুটা তিক্ত স্বরেই কথাগুলি বললেন Mr. দেব।

'আসুন।' নিজের ঘরের সামনে এসে দরজা খোলে সিদ্ধার্থ। আগত প্রতিবেশী কে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই অ্যালার্ম ঘড়ির শব্দ শুনতে পায়।

'এই! এই বিরক্তিকর শব্দের জন্যেই আপনার কাছে ছুটে আসা সিদ্ধার্থ বাবু।' দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন দীপক দেব।

শোবার ঘরে ঢুকে অ্যালার্ম ঘড়ি বন্ধ করে সিদ্ধার্থ। আটটার সময় অ্যালার্ম দেওয়া। সে তো নিজে কখনো এই সময় অ্যালার্ম দেয় না। তাহলে? বেশ ধন্দের মধ্যে পরে যায় সিদ্ধার্থ। বাইরের ঘরে এসে দীপক বাবুকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভিতরে আসতে বলে। তারপর কিচেনে গিয়ে চা-এর জল চাপিয়ে দেয়। "চা খাবেন তো?" কিচেন থেকে প্রশ্ন করে সিদ্ধার্থ।

'তা, হলে মন্দ হয়না। আমার আবার দুধ চিনি ছাড়া কিন্তু।' ঘরের মধ্যেকার আসবাব আর ছবিগুলো দেখছিলেন দীপক বাবু। ডাইনিং টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন।

একটা tray তে দুটো কাপে গরম জল, টি-ব্যাগ আর সুগার কিউব নিয়ে আসে সিদ্ধার্থ।


'আমার পাশের ফ্লাট এর তারক বাবুও একই কথা বলছিলেন আমায়। আপনি কমিটি মিটিঙে নাকি এই নিয়ে বলেছিলেন।' একটা কাপে টি-ব্যাগ ফেলে এগিয়ে দিয়ে বলে সিদ্ধার্থ।

'বিশ্বাস করুন। অত্যন্ত বিরক্ত হয়েই আমি মিটিঙে আলোচনার প্রসঙ্গটা এনেছিলাম।' কাপে চুমুক দিয়ে একটা স্বস্তি সূচক নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করেন দীপক বাবু।

'তারক দার সাথে আপনার ব্যাপারে কথা হচ্ছিল। তখন তিনি বললেন, আপনি নাকি বলেছেন আমায় নিজে এসে দেখা করে complain জানাতে। আপনার  সাথে আলাপ তো আমার সেই ভাবে কোনদিন হয়নি। তাই ভয় পেলাম। আপনি সব শুনে কেমন ব্যবহার করবেন ভেবে।' আরেক বার চা-এ চুমুক দিয়ে বলে চলেন। 'অনেকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলাম আসব আপনার ফ্লাট এ। কিন্তু ভয়ে আসতে পারিনি।'

'ভয়? আমাকে? হঠাৎ?'

'দেখুন মশাই। কলকাতায় আমি নতুন। ফ্লাট কালচার সম্পর্কে অনেকেরই অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আমি শুনেছি। বেকার বেকার ঝামেলায় জড়িয়ে কি লাভ বলুন? তাই আর কি।'

'না এই সমস্যাটা আমার কাছেও নতুন। আমি নিয়মমাফিক অ্যালার্ম দিয়ে রাখি সাড়ে পাঁচটার সময়। যেদিন হাতে সময় থাকে ভোর ছটার সময় দিয়ে রাখি। কিন্তু এই আটটার সময় অ্যালার্ম আমি দেইনি।'

'কি বলছেন মশাই? মাঝরাত থেকে অ্যালার্ম এর ধমক শুরু হয়। আড়াইটে, তিনটে, সাড়ে চারটে। কিছুই বাকি থাকে না। আপনার কি ডিজিটাল অ্যালার্ম?'

'পাতি অজন্তা ঘড়ি।'

'একটা গল্প পড়েছিলাম। মুরারীবাবুর টেবিল ঘড়ি। আপনারও কি সেই দশা নাকি?'

'ভৌতিক ঘড়ি বলছেন? কিন্তু আমিই শুনতে পাইনা। আর এদিকে রাজ্য শুদ্ধ সবাই শুনতে পাচ্ছে। এইটা কোন কথা হল?" চা-এর ফাঁকা কাপগুলো ট্রে-তে তুলে নিতে নিতে বলে সিদ্ধার্থ।

"কে বলল আপনি শোনেন না? আপনার জালনা থেকে আমার জালনার দূরত্ব বড়জোর দশ ফিট। সেদিন রাতে আমি নিজে দেখেছি আপনি উঠলেন, অ্যালার্ম বন্ধ করলেন। তারপর হাত-পা নেড়ে অনেক কসরৎ করলেন।'

দীপক বাবুর কথাগুলো বড়ই অবান্তর শোনাচ্ছিল সিদ্ধার্থর কাছে। সে তার কল্পনাতেও মাঝরাতে উঠে অ্যালার্ম বন্ধ করে হাত পা নেড়ে কসরৎ করেছে বলে মনে পরে না।

'আপনার বোধয় কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি মাঝরাতে উঠে যোগ-ব্যায়াম করিনা।'

'তাহলে মশাই আলোটা জ্বালিয়ে রাখেন কেন? জালনার ধারে বসে সিগারেট খেতে আমি নিজে চোখে আমি আপনাকে দেখেছি। কখনো বা বই হাতে নিয়ে বুলি আওড়াতে। আমার স্ত্রী-এর ধারণা, আপনি বোধয় থিয়েটার করেন। তার পার্ট মুখস্ত করেন ঐভাবে।'



'অসম্ভব।' একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করে কাপের ট্রে নিয়ে উঠে কিচেনের দিকে যায় সিদ্ধার্থ।

'আমি মিথ্যে বলছি না। আপনার এই সব কিছুই খেয়াল থাকেনা?' সিদ্ধার্থর পিছু পিছু কিচেনের দিকে আসেন দীপক দেব।

'আজ্ঞে না! আমি জ্ঞানত এইরকম কাজ করেছি বলে আমার মনে পড়ছে না।'

'আজ ভোর রাত থেকে এই নিয়ে চারবার অ্যালার্ম বেজেছে। কয়েকদিন ধরেই তক্কে তক্কে ছিলাম। আজ চতুর্থবার অ্যালার্ম বাজতে শুরু করা মাত্রই আমি ছুটে আসি। দরজা বন্ধ, কেউ খুলছে না দেখে আমি  ফিরেই যাচ্ছিলাম। আপনি চলে এলেন।'

'এইটা হয়ত একটা accident, আমি কোনদিন এই সময়......" কথা ফুরোনোর আগেই তারস্বরে অ্যালার্ম ঘড়ি বাজতে শুরু করে। ক্ষোভ, বিস্ময়, আর রাগ এর মিশেল একসাথে মুখের ওপর যে নির্মম ছায়া বিন্যাস করে। সিদ্ধার্থর মুখেও সেরকম কিছু প্রত্যক্ষ করে কিচেন থেকে বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে এগিয়ে যান দীপক বাবু।

"আপনার বোধয় অ্যালার্ম ঘড়িটা খারাপ। একবার দোকানে নিয়ে দেখান। আজ আসি। ঠিক আছে?" দরজা বন্ধ করে দিয়ে চলে যান দীপক বাবু। হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকে সিদ্ধার্থ কিচেনে। আর অন্যদিকে অ্যালার্ম ঘড়ি বেজেই চলেছে নিজের মত। "টি টি তিতিক, টি টি তিতিক"


                                                                      //৮//

"স্যার! স্যার! চব্বিশ নম্বর কেবিনের বাড়ির লোক আপনার সাথে একবার দেখা করতে চায়।"

কোন উত্তর না পেয়ে দরজা ঠেলে ভিতরে এসে সিস্টার আরেকবার কথাগুলি বলে।

"কে? কে দেখা করবে?"

"চব্বিশ নম্বর কেবিনের patient এর বাড়ির লোক। ডেকে দেব?"

ড: সরকারের অন্যমনষ্কভাবের সাথে পরিচয় না থাকার কারণেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন সিস্টার। পুনরুক্তি করে বিষয়টি জানবার পর, আদেশের অপেক্ষায় ঘরের এক কোন গিয়ে দাঁড়ায়।

টেবিলে রাখা কাগজগুলির দিকে চোখ রেখেই প্রশ্ন করেন ড: সরকার।

"কে এসেছেন? ওর মা?"

"হ্যা স্যার! আমি কি পরে আসতে বলব?" ড: সরকার যে মোটেই এখন দেখা করতে ইচ্ছুক নন, বোধয় আন্দাজে বুঝতে পেরেছিলেন সিস্টার। টেবিলে ছড়িয়ে থাকা case file গুলি সাজিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ান ড: সরকার। উল্টোদিকের দেওয়ালে টাঙানো আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে নিলেন একবার। অবিন্যস্ত চুল গুলি আঙ্গুল দিয়ে ঠিক করতে করতে বলেন,

"আমায় এক কাপ কফি এনে দেবেন  সিস্টার?"

রোগীর বাড়ির লোকের সাথে আপাতত দেখা করবার কোন সম্ভাবনা নেই বুঝে সিস্টার কফি আনবার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে নীরবে বেরিয়ে যায়। দরজার বাইরে থেকে বাড়ির লোকেদের উৎকন্ঠা ভরা কিছু প্রশ্ন শ্রুতিগোচর হলেও, সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য করলেননা ড: সরকার। পকেট থেকে ছোট চিরুনি বের করে আয়নার দিকে এগিয়ে গেলেন। চব্বিশ নম্বর কেবিনের রোগীর সমস্যা এবং তার চিকিৎসার বিস্তার, যে অগোছালো ভাবে তাঁর মনে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো সাজিয়ে নেওয়ার মতই যেন নিজের কথাগুলো সাজিয়ে নিতে চেষ্টা করলেন ড: সরকার। এর আগে রোগীর বাড়ির লোকের সাথে দেখা করতে কখনো এতটা উদ্বেগ বোধ করেননি। কিন্তু আজকের বিষয় আলাদা।


                                                                     //৯//
"আপনি যে ক্রমাগত নিজের মনের জালে নিজেই জড়িয়ে পড়ছেন, সেটা লক্ষ্য করেছেন?"


"আপনার কথা আমার বিশ্বাস হয়না ড: ব্যানার্জি। লোকটা acute MI নিয়ে ভর্তি হল আমাদের emergency তে। হাতে তখনো সময় ছিল। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারলাম না। এটা আমার দক্ষতার অভাব নয়?"

"বেশ! মানলাম আপনি যথেষ্ট দক্ষ চিকিৎসক নন। কিন্তু সেই মুহূর্তে আপনার পাশে দাঁড়িয়ে, আপনাকে সাহায্য করবার মতন আর কেউ উপস্থিত ছিল কি সেখানে?"

"না; Not a single person."

"তাহলে রোগীর মৃত্যুর জন্যে কেবল নিজেকে দায়ী করছেন কেন? আপনি তো আপনার যথা সাধ্য চেষ্টা করেছিলেন?"

টেবিলের ওপর একটা সশব্দ চর বসিয়ে প্রতিবাদ করেন ড: রায়। "কিস্যু করিনি। আমি কিস্যু করতে পারিনি। Infarction, hypoperfusion আর তারপরেই cardiac arrest. আমি শুধু monitor এর screen এ তাকিয়ে দেখলাম অশান্ত ecg এর রেখাগুলি, কেমন হঠাৎ শান্ত ভাবে সরলরেখায় চলতে শুরু করে দিল।" টেবিলের ওপর মাথা রেখে বসেন ড: রায়।


নিজের চেয়ার থেকে উঠে ড: রায়ের দিকে এগিয়ে আসেন ড: ব্যানার্জি।

"নিজেকে শান্ত করুন ড: রায়। আত্মবিশ্লেষন ভালো জিনিস। কিন্তু নিজেকে দায়ী করে দোষী সাব্যস্ত করবার চেষ্টা তো মূর্খামি। মানুষ মাত্রেই ভুল করে। আর এইখানে তো আপনার করবার কিছুই ছিলনা? একজন নামি cardiologist এর কাছেও হয়ত case টা most difficult হয়ে উঠত। আর তা-ছাড়া।....."

কথার মাঝেই বাধা দিয়ে নিজের চেয়ার থেকে উঠে পড়েন ড: রায়। "না ড: ব্যানার্জি। ভুলে যাওয়া এত সোজা নয়।"
দেওয়ালের কাছে গিয়ে বার তিনেক মাথা ঠুকে বলে চলেন, "ভাবতে পারেন ড: ব্যানার্জি? সাতচল্লিশ বছরের একজন ভদ্রলোক। শক্ত সমর্থ চেহাড়া। বুকে সামান্য ব্যাথা হল। আর তাতেই।......"

আবার নিজের চেয়ারে এসে বসেন ড: রায়। তার পাশে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতে, মুখ তুলে বললেন,

"ভদ্রলোকের মেয়েটি কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃত্যু সংবাদটা দিতে হয়েছিল আমাকে। করুণ দুটো চোখ তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। আমার প্রতিটি শব্দ তাকে লক্ষাধিক ছুরির আঘাতের চেয়েও নির্মম ভাবে আহত করছিল। কিন্তু সে নির্বাক হয়ে অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল। ভেবেছিল আমি বুঝি ঠাট্টা করছি। তার বাবাকে আমি নিশ্চই বাঁচিয়ে দেব।"

টেবিলের ওপর হাত রেখে তাতে মুখ গুঁজে বসে বলেন ড: রায়।

"নিষ্পাপ ওই চোখ দুটোয় আমি একজনের প্রতিফলন দেখেছিলাম ড: ব্যানার্জি। আমার।  একজন ব্যর্থ ডাক্তারের প্রতিফলন। একজন প্রবঞ্চকের প্রতিফলন। আমি ডাক্তার নোই। না-না কোন যোগ্যতাই নেই আমার।"

"আমায় যদি বন্ধু মনে করেন, একটা পরামর্শ দেব?"


মুখ তুলে তাকালেন ড: রায়।

"Emergency থেকে দিন কয়েকের ছুটি নিন। আমি কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি, খেয়ে দেখুন, মন শান্ত হবে। আর আপনার মানসিক ও শারীরিক, উভয়েরই একটু বিশ্রামের প্রয়োজন।"

"বিশ্রাম? পরিশ্রম কোথায় আমার, যে বিশ্রামের প্রয়োজন হবে?"

"মানছি, মানছি আপনি পরপর অনেকগুলি রোগীর মৃত্যু চোখের সামনে দেখেছেন। তাদের বাড়ির লোকের কাছে সেই মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দিয়েছেন। সেই থেকে এরকম একটা মানসিক বিপর্যয় আসা এমন কিছু অস্বাভাবিক নয়।" নিজের চেয়ারে এসে বসলেন ড: ব্যানার্জি। "ডাক্তার হলেও, আপনার মনের সূক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ জায়গাগুলি এখনো শিশুর মতোই সরল। আর তার থেকেই এরকম অবস্থা। কিন্তু তাই বলে নিজের এত কষ্ট করে বানানো career টা নষ্ট করে ফেলবেন?"

"আজ একমাস হল আমার ভালো ঘুম হয়না। দু'চোখের পাতা এক করলেই রোগীদের মুখগুলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মৃতের পরিবারদের চেহারা। তাদের কান্নার শব্দ।... উফফ!" হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে বসেন ড: রায়।

"দিন কয়েকের জন্য ছুটি নিন। বন্ধু-বান্ধবের সাথে একটা plan করে কোথা থেকে ঘুরে আসুন। আর এই ওষুধগুলো খান, মনটা শান্ত হবে।"

Recorder এ এখানেই কথোপকথন শেষ। সকালে  ড: রায়ের session টা মোবাইলএ record করে নিয়েছিলেন ড: ব্যানার্জি। এখন case file টা ready করতে বসে, recorder play করে বারবার শুনে নিচ্ছিলেন। এমন সময় ফোনটা আসে। call টা receive করতেই ওপার থেকে একটি ভারী কন্ঠস্বর শোনা যায়।

"ড: ব্যানার্জি কথা বলছেন?"

"হ্যা, বলছি।"

"আমি সোনারপুর স্টেশনের RPO থেকে  কথা বলছি। কিছুক্ষন আগে আমাদের স্টেশনের কাছে ট্রেন accident এ একজন মারা গেছেন। তাঁর পকেটে আপনার prescription টা শুধু পাওয়া গেছে। মৃতের নাম......."


পুরোপুরি শোনা হয়নি কথাগুলো। চোখের সামনে যেন অন্ধকার নেমে আসে ড: ব্যানার্জির। কোন রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ারে ধপ করে বসে পড়েন।

                                                                             //১০//
"আর আপনার ধারণা, অফিসের সবাই আপনাকে হীন চোখে দেখে?"


"এটা আমার ধারণা নয়। আমি জানি। সবাই ভাবে আমি নিজের শরীর বেঁচে promotion নিয়েছি। অফিসের সামান্য clerk গুলো অব্দি আমায় slut ভাবে।"

"দেখুন miss মিত্র; corporate অফিসগুলোতে সব জায়গাতেই কম-বেশি একই গল্প।"

"না-না! সব জায়গায় নয়। My friends are also acting like that. আমি যে MBA করেছি, আমার performance যে সবার থেকে ভালো। এগুলো কোন matter করেনা এদের কাছে। All they care about is an one night stand?"

"আপনার বাড়ির লোক কি জানেন এইসব?"

"Bloody hell! তারা জানতে পারলে আমি আর কোনদিন কাজ করতে পারবো ভেবেছেন? তাদের সেই এক কথা। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিয়ে দাও। It seems like, no cares about what I wanna do! আমি কি চাই, সেটা কেউ বুঝতে চায়না কেন বলতে পারেন?"

"আপনি কোন relationship এ আছেন? প্রেমিক বা boyfriend কেউ আছেন?"

"See Dr. Banerjee, I didn't came here to discuss such rubbish. আপনিও কি আমায় propose করবার plan করছেন?"

"মোটেই না! আমি নিজের চেহারা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল মিস মিত্র। আপনার মত সুন্দরীকে propose করবার মত ঔদ্ধত্ব আমার নেই।"

"কে বলল আপনি খারাপ দেখতে? You are quite handsome. শুধু, dressing sense একটু অভাব। বুড়োটে মার্কা!"


"বলছেন? তাহলে আমারও chance আছে?"

"Why not? By the way. আপনি এখনো বিয়ে করেন নি? কোন girlfriend?"

"এই হাসপাতালের চৌহদ্দি পেরোলেই লোকে আমায় দেখে পাগলের ডাক্তার বলে। এই দুর্নাম নিয়ে কি আর ওই স্বাদ উপভোগ করা যায় বলুন? পাগলের ডাক্তারের প্রেমে কে-ই বা পড়বে?"

"Wait a sec! are you riding on me?"

"আমিতো আপনাকে আগেই বলেছি মিস মিত্র। আমি নিজের সীমারেখাগুলি ভালো করেই চিনি।"

"You better try some red on you. It will suit you."

"বলছেন?"

"Of course! ভালো কোন movie এসে থাকলে চলুন না দেখে আসি। তারপর shopping করা যাবে। I will help you to select some shirts. আমার ও কিছু কেনাকাটার দরকার ছিল। You know what? I look sexier in red dress. I have a red lingerie. I can show you...." মিস মিত্রর চোখে-মুখে একটা প্রগলভতা যেন ঝিলিক দিয়ে যায়। সুপ্ত যৌন ইচ্ছেগুলির বাসনা যেন চেহারায় ফুটে ওঠে।


"এখানে তো সিনেমা দেখবার সুযোগ নেই মিস মিত্র।"

"হুমম!" হঠাৎ যেন নিজের অবস্থানের কথা মনে পরে যায়। এদিক ওদিকে একবার দেখে নিয়ে বলে, "Such a boring place.  কিভাবে যে আপনারা এখানে থাকেন কে জানে।"

"আপনি এখানে কেন এসেছেন জানেন?"

"না! জানি না। Mom n dad came yesterday. They were acting like আমি যেন অসুস্থ।"

"আপনার দু'হাতের কাটা দাগগুলো দেখেছেন?"

নিজের হাতের আঘাতের চিন্হগুলির দিকে চোখ যেতেই যেন ঝলসে ওঠে মিস মিত্র।

"Oh my God! Must be my sister. She's such a crazy bitch. I'll kill her." পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা Nurse  তখনই এসে মিস পায়েল মিত্রকে শান্ত করে। Mobile এর recording ও এখানেই শেষ।


পায়েল মিত্র, একটি কর্পোরেট অফিসের চাকুরিরতা। Salt lake branch এ floor coordinator এর post থেকে promotion পেয়ে হাজরার অফিসে transfer হয়। লাল রঙের প্রতি একটা obsession থেকে সমস্যার শুরু। Parental support এর অভাব সত্ত্বেও, নিজের চেষ্টায় পদোন্নতি তার আত্ম-প্রত্যয় বাড়িয়ে দেয়। এই self-satisfaction আর confidence থেকে একটা mania দেখা দেয়। Obsessive disorder গুলো ক্রমে বাড়তে শুরু করে। German ভাষায় যাকে Schadenfreude বলা হয়। সেই লক্ষণ দেখা দেয় পায়েলের মধ্যে। আর তারপর থেকেই paranoid schizophrenia এর দিকে shift করে।


নিজের ঘরের দেওয়াল লাল রঙ করবে বলে নিজের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ছুরি দিয়ে কেটে কেটে দেওয়াল রং করেছিল। হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেই যাত্রা প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু রোগটা মনের মধ্যে থেকেই যায়। সম্প্রতি এক রাত্রে, ঘুমন্ত ছোট বোনের হাত ও গলা কেটে রক্ত নিয়ে দেওয়াল রঙ করতে বসেছিল পায়েল। বোনের চিৎকার শুনে ঠিক সময়ে  এসে পড়েছিলেন পায়েলের বাবা-মা। তাই সে যাত্রা পায়েল এর বোনকে বাঁচানো যায়। কিন্তু শেষ অব্দি নিজেদের কাছে পায়েল কে রাখা আর নিরাপদ নয় ভেবে এই asylum এ দিয়ে গেছেন।


                                                                   //১২//
রাত আড়াইটার সময় অ্যালার্ম বেজে ওঠে। আধ বোজা চোখে ঘুম থেকে উঠে কোন মতে হাতড়ে ঘড়ির নাগাল পেয়ে বন্ধ করে সিদ্ধার্থ। Bedside টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে খানিকটা জল খেয়ে নেয়। খুব পরিচিত একটা গন্ধ পেয়ে তন্দ্রা ভাবটা কেটে যায়। ঘরের আলো নেভানোই ছিল। একফালি আলো দরজার ফাঁক দিয়ে এসে বিছানার উল্টোদিকের দেওয়ালে পড়ছে। বাইরের ঘরের আলো কি তবে নিভাতে ভুলে গিয়েছিল সে? পিছন ফিরে দরজার দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে। কার একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে।

শুকিয়ে যাওয়া গলা দিয়ে আধ বোজা একটা কন্ঠস্বর শোনা যায়। কোন মতে প্রশ্ন করে সিদ্ধার্থ।

"কে?"

"ঘুমিয়ে পড়েছিস ভাই? একটা সিগারেট দিবি?"

"আর্য ? তুই, এখানে?"

"বিকেল থেকে একটাও সিগারেট জোটেনি ভাই। একটা দে না?"

"আয় ভিতরে আয়?"

দরজা ঠেলে ঘরে আসে আর্য। কলকাতায় আসার পরে সে আর আর্য, দুই বন্ধু মিলে এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিল। তারপর থেকে একসাথেই থাকে। আর্যর এই এক স্বভাব। বড্ড রাত করে বাড়ি ফেরে। অনেকবার বলেও কোন সুফল হয়নি। এদিকে যে মদ্যপান করে বেহেড হয়ে আসে, তা-ও কিন্তু নয়। মদ সম্পর্কে আর্যর কোন আসক্তি নেই। তবে তার মতে "A non-বেহেড is more accepted in a group of all বেহেডস।"

ঘরের এল জ্বালিয়ে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় আর্য। "একি? সব এমন বন্ধ করে রেখেছিস? ঘরটা গুমোট হয়ে রয়েছে তো?" বলেই সে জালনাগুলো খুলে দিতে শুরু করে।

"খুলিস না!" সিদ্ধার্থ বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে আসে।

"কেন বে? কি হয়েছে?"

প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরায় সিদ্ধার্থ। আরেকটা সিগারেট আর্যর দিকে বাড়িয়ে দেয়।

"আজ সকালে ওপাশের ফ্ল্যাট থেকে এসে complain করে গেছে। রাত্রে আলো যায়, শব্দ যায়। তাই আজ বন্ধ করে শুয়েছি।"

"বাল শালা! আমি আমার ফ্ল্যাটে কিভাবে থাকব তা-ও কি পাশের বাড়ি থেকে permission নিয়ে থাকতে হবে নাকি?"

"আস্তে বল। শুনতে পাবে।"

"শুনুক গে! আমি কাউকে পরোয়া করি নাকি? মাস গেলে বাড়ি-ভাড়ার বরাদ্দ টাকা কি ওই বোকাচোদা এসে দিয়ে যায়?"

"তুই আজ মাল খেয়েছিস? তোর কথা তো স্বাভাবিক লাগছে না!"

রান্নার ঘরে নাড়ু চুরি করতে গিয়ে ধরা পরে গেলে বাচ্চারা যেমন হাসি দেয়। ঠিক সেইরকম একটা হাসি দিয়ে আর্য বলে, "আজ একটুস খেয়ে ফেলেছি মাইরি। রাগ করিস না!"

"এই অভ্যেসটাও ধরে ফেললি? তোর কি মাথাটা পুরোপুরি গেছে?"

"বিশ্বাস কর। আমি নিজে খেতে চাইনি। ওরা জোর করল বলেই, একটু।....."

"কারা?" সিগারেট এর বাকি অংশটা জানলা দিয়ে ফেলে দিয়ে প্রশ্ন করে সিদ্ধার্থ।

"আজ আমি একটা দারুন সত্যি কথা জানতে পেরেছি ভাই। মদটা খেয়ে তাই নিজেকে সামলে নিলাম।" জালনার কাচে বার কয়েক টোকা দিয়ে কথাটা বলে আর্য।

"কি সত্যি কথা?"

"বাদ দে! বেকার পুরোনো স্মৃতি ঘেটে লাভ নেই। আমি যাই, তুই ঘুম দে!"

"কি সত্যি কথা বলে যা!"

"আমার আজ এই পরিণতির কারণ কে, সেটা জানতে পেরেছি।" চোখে মুখে একটা চাপা রাগের অভিব্যক্তি ফুটে ওঠে আর্যর।


"কার কথা বলছিস?" অবাক হয়ে জানতে চায় সিদ্ধার্থ।

"সেদিন মেট্রোর সামনে আমায় ঝাঁপ দিতে কে বাধ্য করেছিল, ভুলে গেলি?" আক্রোশ যেন এক নিমেষে সমস্ত হাসি উধাও করে দেয় আর্যর মুখ থেকে।

"তুই? মেট্রোতে? আরে!!" হঠাৎ যেন সব ছবি মনে পরে যায়। মাস কয়েক আগেই যতীন দাস পার্ক মেট্রোতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল আর্য। নিজে গিয়ে সেই মৃতদেহ দেখে এসেছিল সে। ঠান্ডাটা যেন হঠাৎ খুব বেড়ে যায় ঘরের ভিতর। খোলা জালনা দিয়ে একরাশ হাওয়া যেন ঘরের মধ্যে সঞ্চিত সমস্ত উত্তাপ সরিয়ে দিয়ে কয়েক পারদ তাপমাত্রা নামিয়ে দিয়েছে। গলার কাছে শক্ত কিছু একটা যেন আটকে গিয়েছে সিদ্ধার্থর।  কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে। একটু একটু করে আর্য তার দিকে এগিয়ে আসছে সমস্ত পুরোনো হিসেবে মিটিয়ে নেবে বলে। এক পা এক পা করে সে ও পিছিয়ে যাচ্ছে ক্রমে জালনার দিকে। আর্যর কথাগুলো খুব পরিচিত বলে মনে হয়।

"কে আমায় প্রথম থেকে ভুল বুঝিয়ে এসেছিল, যে আমিও পারব এই corporate office এর নিয়ম মেনে এগিয়ে যেতে? কে আমায় ভুল বুঝিয়েছিল, যে মেয়েটাকে আমি ভালোবাসতাম, তার থেকে সরে আসতে? তুই সিদ্ধার্থ। তুই। প্রতি মুহূর্তে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলি আমি যে গরীব। আমার চাওয়া পাইয়ে থাকতে নেই। ইচ্ছে থাকতে নেই।"


"এসব কি বলছিস তুই?"

"ঠিকই বলছি। ভাস্কর কে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখে কে ঠেলে দিয়েছিল? পায়েল তো একটা বাচ্চা মেয়ে। তার মাথাটাও তুই চিবিয়ে খেয়েছিস। আজ বেচারি পাগলাগারদের মধ্যে পঁচে মরছে। একটা promising career কে কিভাবে নষ্ট করে দিয়েছিস তুই।"

পরিস্থিতির চাপে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে যেমন লাগে। সিদ্ধার্থর ও যেন একই অবস্থা। এক সময় পিছোতে পিছোতে হঠাতই যেন জমির সাথে সমস্ত সংযোগ ছিন্ন হয়ে যায়। অনেক উঁচু থেকে পরে যেতে থাকলে যেমন মনে হয়। এ যেন ঠিক সেই অভিজ্ঞতা।


                                                                            //১৩//
"আপনার ছেলের সাথে দেখা করলেন?" ড: সরকারের প্রশ্ন শুনে বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ান আরতী দেবী। চোখের জল মুছে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে 'না' বললেন।

"চলুন দেখা করে আসা যাক।" আরতী দেবী আর ড: সরকার 24 নম্বর কেবিনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

Ward boy এসে কেবিনের দরজা খুলে দিয়ে যায়। জালনার ধারে লোহার শিক গুলো ধরে সিদ্ধার্থ দাঁড়িয়ে।

"তোমার মা এসেছেন সিদ্ধার্থ। কেমন আছো আজকে?"

জালনার বাইরে তাকিয়েই স্বগোতক্তির মতন করে বলে সিদ্ধার্থ। "মা? কার মা?"

"তোমার মা। চিনতে পারছো না?" ড: সরকার এগিয়ে আসেন।

"কে উনি? আমি চিনি না! আপনিই বা কে?"

"আমি এখানকার একজন ডাক্তার। তুমি আমার ছাত্র ছিলে। মনে পরছেনা কিছু?" ড: সরকার গিয়ে সিদ্ধার্থর পিঠে হাত রাখেন। আড় চোখে একবার ড: সরকার আর আরতী দেবীর দিকে দেখে বলে।

"বাড়িভাড়া এখন দিতে পারবোনা। মাইনে হয়নি এখনো। আমার ATM card, pass book সব হারিয়ে গেছে। টাকা পয়সা কিচ্ছু নেই। আমি পারবো না।"

"আমি তোমার কাছে বাড়িভাড়া চাইতে আসিনি সিদ্ধার্থ।"

"তাহলে? Loan এর emi? উনি কি bank এর লোক?" আরতী দেবীর দিকে দেখিয়ে বলে সিদ্ধার্থ।

"আমরা কেউ তোমার কাছে টাকা চাইতে আসিনি সিদ্ধার্থ। "

"মিথ্যে কথা। আমি সব জানি। আমাকে এখানে আটকে রেখে দিয়ে, কাজ করতে না দিয়ে আবার টাকা চাইতে আসা হয়েছে। সবাই কে চিনি।" হঠাৎ করেই যেন ক্ষেপে ওঠে সিদ্ধার্থ। নিজের মা-এর দিকে তেড়ে এগিয়ে যায়। তারপর চিৎকার করে বলে, "আপনার manager কে গিয়ে বলে দেবেন। আমি একটা টাকাও দেবোনা। যা করতে হয় করে নিক। ইয়ার্কি পেয়েছে সব।"

চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পরে সিদ্ধার্থ। জোরে জোরে শ্বাস পড়তে থাকে। ড: সরকার ঘরের বাইরে চলে আসেন। আরতী দেবী একবার ছেলের কাছে গিয়ে মাথায় হাত রাখবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বেরিয়ে আসেন। Ward boy এসে ঘরের দরজা বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেয়।

"নিজের ফ্ল্যাটের জালনা দিয়ে পরে গিয়ে, ওর মাথায় যে আঘাত লেগেছে তাতে স্মৃতির অনেকটা অংশই মুছে গিয়েছে সিদ্ধার্থর। ওর প্রতিবেশীরা অবশ্য বলছে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল সিদ্ধার্থ, কারণ বহুদিন থেকেই ওর মধ্যে কিছু পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল।"

"হঠাৎ এমন করল কেন ডাক্তার বাবু?"

"সিদ্ধার্থর স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গেলেও, ওর সাথে যে কটা counselling session এ আমি বসেছি। সেগুলি tally করে দেখলাম। ওর under এ যে চার জন patient ছিল। তাদের case গুলো নিয়ে বেশ involved হয়ে পড়েছিল সিদ্ধার্থ। রাত জেগে পড়াশোনা করা। নিয়মিত ওদের সাথে বসে কথা বলা। এই সবের মধ্যে এতটাই জড়িয়ে পড়েছিল, হয়ত নিজের normal life style থেকে অনেকটা বেরিয়ে এসেছিল ও। তারপর যখন ড: ভাস্কর রায়, আর্য সেনগুপ্ত suicide করে। সেই shock টা সিদ্ধার্থর কাছে irreversible হয়ে যায়। নিজেকেই দায়ী করতে শুরু করেছিল may be."

"আমরা তো কিছুই আন্দাজ করতে পারিনি ড: সরকার? ফোনে যখন কথা বলত দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক।"

"প্রাথমিক অবস্থায় এইসব patient এর বাহ্যিক আচরণ দেখে রোগের আন্দাজ পাওয়া খুবই difficult. কোন particular trigger point এদের ক্ষেত্রে কাজ করে। প্রথম দিকে সেগুলো long duration এ accessed হয়। তাই সুস্থ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়। এই রোগটাকেই আমরা dissociative identity disorder বলি। একজন মানুষ যখন নিজের সত্ত্বার বাইরেও অন্যের সত্ত্বা কে incorporate করে নেয়, আর সেই হিসেবে life lead করে।"

"মাথায় চোট লাগার কারণেই কি?"

"আমার মনে হয়না। মাথার চোট হয়ত ওর স্মৃতিগুলোকে খানিকটা ঘোলাটে করে দিয়েছে। তাই ও নিজের অস্তিত্বকে চিনতে পারছে না। ও যা সব কথা বলে, সব কথাই ওর patient দের। এই যেমন ধরুন টাকা, বা ব্যাঙ্ক নিয়ে ওর যে আক্রোশ। আসলে এই সমস্যাটা ছিল আর্য নামে সিদ্ধার্থর একজন patient এর। আর্য একজন manic depression এর patient ছিল। lack of confidence থেকে isolated from society, family. তারপর প্রেমের দিক থেকে আঘাত পেয়ে আরো depression এ চলে যায়। যার ফলে delusion এ ভুগতে শুরু করে।"

"এর কি কোন চিকিৎসা নেই ডাক্তারবাবু?"

"আমি চেষ্টা করছি Mrs. ব্যানার্জি। তবে ওর trigger point টা যে কি! সেটাই বিস্ময়। ওর notes খাতা কিছু আমার হাতে এসেছে। সেগুলো follow করতে গিয়ে একজায়গায় দেখলাম, সিদ্ধার্থ লিখেছে আর্য না-কি ওর সাথে থাকবে বলে বাড়ি ভাড়া share করে থাকতে এসেছে। রোজ রাত দুটো-আড়াইটে নাগাদ করে নাকি আর্য বাড়ি ফিরত। আর সিদ্ধার্থ কে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলে দিয়ে আসতে হত। কিন্তু তারিখগুলো দেখতে খেয়াল হল, আর্য তার একমাস আগেই মারা গিয়েছে।"

অবাক হয়ে কথাগুলোর গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করেন সিদ্ধার্থর মা।

"আমাদের সবার আড়ালে একটু একটু করে সিদ্ধার্থ মানসিক রোগের শিকার হয়েছে। কিন্তু কেউ বুঝতেও পারিনি।"

এমন সময় ward এর কোন ঘর থেকে অ্যালার্ম ঘড়ি বেজে ওঠে। ড: সরকার ward boy এর দিকে তাকাতে সে এগিয়ে এসে বলে,

"ড: ব্যানার্জির ঘরে অ্যালার্ম বাজছে স্যার।"

"অ্যালার্ম ঘড়ি? কোথা থেকে পেলো?"

"আমাদের টেবিলে একটা রাখা ছিল স্যার। সেদিন বিকেলে বাগান থেকে ঘুরে ফেরার পথে ড: ব্যানার্জি ঘড়িটা চাইলেন। বললেন, সকালে উঠে morning walk এ বেরোতে হয়। অ্যালার্ম ঘড়িটা দাও। আমিও না করিনি।"

Ward boy এর কথাগুলি যেন আরতী দেবীর মনের কোনে আরো শক্ত আঘাত হানে। কান্নায় ভেঙে পড়েন নিজের ছেলের এমন শোচনীয় পরিণতির কথা শুনে। ড: সরকার একজন nurse কে ডেকে আরতী দেবী কে নিয়ে যেতে বলেন। তাঁর এত বছরের ডাক্তারি জীবনে এরকম জটিল সমস্যার মুখে তিনি কখনো পড়েননি। নিজের সব থেকে প্রিয় ছাত্রের এই পরিণতি দেখে তিনি নিজেও হতাশ হয়ে পড়েছেন। ধীর পদে ward থেকে বেরিয়ে আসেন ড: সরকার।


                                                                                //১৪//

জালনার বাইরে তাকিয়ে একমনে বলে চলেছিল সিদ্ধার্থ। "আমি জানি ওরা রোজ কেন আসে। টাকা। টাকা চাইতে আসে। আমায় পাগল করে দেবে এরা।"

এমন সময় অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে ওঠে। Bed এর ওপর পরে থাকা একটা রুমালের দিকে চোখ যায় সিদ্ধার্থর। সেটা হাতে নিয়ে গন্ধ শুকতেই মাথার পিছন দিকে একটা তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করে। চোখের দৃষ্টিও ঘোলাটে হয়ে আসে কিছুটা। "মা!" অনুচ্চ কিন্তু স্পষ্ট করে নিজের কন্ঠস্বর শুনতে পে সিদ্ধার্থ। "মা এসেছিল? মা! মা!" দরজার দিকে ছুটে যায় সে। পর পর কয়েকবার দরজার ওপর ধাক্কা দেয়। চিৎকার করে ডেকে ওঠে, "মা! ও মা! ড: সরকার! স্যার!"


"আপনাকে তো এখন এখানেই থাকতে হবে ড: ব্যানার্জি।"

পরিচিত এক কন্ঠস্বর শুনে চমকে ফিরে তাকায় সিদ্ধার্থ। জালনার পাশে দুজন দাঁড়িয়ে তারই দিকে চেয়ে হাসছে। একটু এগিয়ে যেতে চিনতে পারে দুজনকে।

"ড: রায়? আর্য ? আপনারা?"


                                             - ---------------  সমাপ্ত  --------------------












All characters in this story are imaginary. Any resemblance to any person living or dead is completely coincidental and unintentional.

(C) Google images for the applied pictures as illustrations.

Acknowledgments to
Agantuk.
A Das
R. Dutta











    

কোন মন্তব্য নেই: