বৃহস্পতিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৮

।। চন্দ্র-বিন্দু।।
/১/
জগতে প্রেম যে কি সর্বনাশা বস্তু তা আজকাল সর্বত্রই প্রতীয়মান। যুবক যুবতী, কীট পতঙ্গ, দেব দেবী, পাখি জানোয়ার, কিছুই এই দুরূহ বিষয় থেকে বিরত থাকতে পারেনা। আগে তবু যুবক যুবতী পার্কের আড়ালে নীরব কোণ খোঁজার চেষ্টায় মত্ত থাকত। ইদানিম প্রৌঢ় প্রৌঢ়া আবার কিশোর কিশোরীরাও সেই মাদক রসে সম্পৃক্ত হয়ে উন্মাদ। তাদের বিরহ যাতনা এতই প্রবল, যে, দেশের আইনানুগ ব্যবস্থা অব্দি বদল করতে বাধ্য হতে হয়। সেই প্রেম কে বিষয় বস্তু করে শিল্পও যেন আজকাল উপচে পড়ছে। কলকাতা শহরে অবশ্য এইরূপ চিত্রনাট্য থেকে বিরত দুটি ব্যতিক্রম বাস করছিল।

*প্রথম আলাপ*
একাডেমী তে নাট্য সৃজন পরিকল্পনা উপলক্ষ্যে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সারাদিনে তিনটি নাটকের সবকটি প্রেম বিষয়ক। নায়িকা হয় বিরহ বেদনাতুর হয়ে সজল নয়নে অপেক্ষারত নাহয় নায়ক বিরহে দুঃখকাতর হয়ে মদ্যপ। শেষ নাটকে দেবদাস রূপী নায়ক যখন মদের বোতল হাতে নায়িকার উদ্দেশ্যে soliloquy আওড়াচ্ছে, আমাদের গল্পের ব্যতিক্রমী যুবক দুম করে বলে ফেলেন, "অসহ্য!"
পাশ থেকে কেউ বলে, "বীভৎস!"

 সেই প্রথম আলাপ ঐ দুই ব্যতিক্রমী যুবক যুবতীর। যারা প্রেমরূপ মাদকতা থেকে শত হস্ত দূরে। দুজনের অভিব্যক্তি একসাথে প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় একে অপরের দিকে ফিরে তাকাল। মঞ্চ থেকে আসা সামান্য আলোকেও যুবক অপরিচিতা যুবতীর চেহারায় সুলক্ষণগুলি যেন স্পষ্ট দেখতে পেল।

"প্রেম এর জন্যে বিহ্বল হয়ে এতটা বাড়াবাড়ি অতিনাটকীয় ব্যাপার নয়? বাস্তব যে আরও অনেক বেশী রূঢ়! আমি চন্দ্র। আপনি?" যুবক বলে।

"অবশ্যই অতিনাটকীয়। এইসব ন্যাকামী আমার পোষায় না। আমি বিন্দু।" পাশেই চেয়ারে বসা অপরিচিতা যুবতী উত্তর দেয়।

"বাবা! আমি চন্দ্র আপনি বিন্দু। এই আলাপ আরও গাঢ় হলে ভালো।"

"অবশ্যই।"

"একটা কথা বলে রাখি। আমি কিন্তু প্রেম মানিনা।"

"আমিও মানি না"

"বাঃ! এইতো চাই। নাটকের শেষে চা খাবেন?"

"বেশ চলুন। চা খাওয়া যাক!"

চন্দ্র ও বিন্দুর পরিচয় গাঢ় হল।

/২/
*এক মাস পর*

চন্দ্র বলল, "দেখো বিন্দু, এই জগতে প্রেম হল সব নষ্টের মূল। যে বা যারা প্রেম করছে, তারাই মরছে।"

"আমিও একমত।" কফি হাউসের ধূমায়িত কফিতে সাবধানে চুমুক দিতে দিতে বিন্দু বলে।

"বিবাহিত জীবনের প্রয়োজন আসলে ব্যয় সংকোচ করে যাতে দুটি মানুষ জীবন অতিবাহিত করতে পারে। সন্তানাদি হলে বংশ বৃদ্ধি পাবে। নাহলে, কিই বা যায় আসে। কিন্তু হায় রে দুনিয়া, পরিণতি দেখো। সংসার করতে ঢুকেই স্বামী স্ত্রী প্রেম করবার অহর্ণিশ চেষ্টায় মত্ত হয়ে ওঠে। একেবারে ধিক্কার জনক ব্যাপার।"

"আমিও তাই মনে করি। প্রেম আর ক্ষুধা। এই দুটি জিনিস না থাকলে, মানুষের জীবন কত সুখের হত? তাই না বল?"

"শুধু চমৎকার? স্বর্গ বলে কোন কাল্পনিক জায়গার কথা চিন্তাও করত না মানুষ। খুব সাবধান! তুমি কিন্তু আবার এই প্রেমে পরে যেও না!"

"সে বিষয়ে তুমি নিশ্চিত থাক। আমি আধুনিকা, নারীবাদী। ফেসবুকে আমার পোস্টগুলি পরে দেখো! সব কটি প্রেম বিদ্বেষী।"

"আমি ব্যয় সঙ্কোচের জন্য বিবাহ নামক ভবিতব্য কে মেনে নিতে রাজি আছি। কিন্তু প্রেম করতে নয়।"

"আমিও তাই।"

/৩/
*তিন মাস পর*
নন্দন চত্বরেই একটি পাথুরে বেদীর ওপর বসে গরম চানাচুর আর চা সহযোগে আড্ডা দিচ্ছিল চন্দ্র আর বিন্দু। আসে পাশে যাতায়াত করা লোকজন তাদের দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে, কারণ তাদের প্রেমিক প্রেমিকা বলে মনে হলেও, আচরণে কেমন যেন গাফিলতি নজরে পড়ছে।

চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই বিন্দু 'উফফ!' বলে ওঠে।

"কি হল আবার?" চন্দ্র জানতে চায়।

"এত গরম চা। জিভ পুরে গেল।" বিন্দু নিজের জিভের অগ্রভাগ প্রদর্শন করে।

"আহা! তাড়া তো কিছু নেই। তুমি জিরিয়ে নিয়ে খাও।" চন্দ্র চায়ের দাম মিটিয়ে চাওয়ালা কে কিঞ্চিৎ রক্ত চক্ষু প্রদর্শন করে।

"আচ্ছা চন্দ্র। তুমি তো প্রেম নিয়ে অনেক কিছু জানো। বলতে পারবে এর উপসর্গ গুলি কি কি?"

"কি নয় সেটাই বলা সহজ। প্রেমের মূল উৎপাত হল দেখতে না পেলে মন কেমন করা। এই যে তুমি আর আমি। রোজ তো দেখা করি। কিন্তু একটু দেরী হলে কি মন খারাপ করে?"

বিন্দু চায়ের কাপে চুমুক দেয়। কথাগুলি বোধহয় গিলতে সুবিধা হল খানিক। তারপর আলতো করে বলে , "আর?"

"আর যেমন ধর নিয়ন্ত্রণ করা। আমি যে এত সিগারেট খাই। তুমি নিয়ন্ত্রণ করনা। এই জন্য তোমার সাথে মিশি।"

বিন্দু আবার চায়ের কাপে চুমুক দেয়। সেবার টুকিটাকি রেস্তোরা তে খেতে গিয়ে চন্দ্র পাঁচ প্লেট মোমো খেয়ে ফেলেছিল। আজ বিন্দু নিজের হাতে মোমো বানিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই কথা ভুলতেই বসেছিল। ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্স বার করতে গিয়ে বলে,
"আর কি কি?"

"কি আর আবার। নিজের ক্ষতি করে অন্যের ভালো করবার চেষ্টা। রাত করে স্বামী বাড়ি ফিরলে না খেয়ে বসে থাকা। হাত পুড়িয়ে ভালো মন্দ রান্না করা। ছেলেদের তো আর অত মুরোদ নেই। বড়জোর সিগারেট বিড়ির খরচ বাঁচিয়ে বৌ এর জন্য টুকটাক উপহার কিনে আনা।"

কথা গুলো শুনেই কেমন যেন খাবি খেল বিন্দু। ব্যাগের মধ্যে টিফিন বাক্সটা আবার ঢুকিয়ে রাখতে গিয়েছিল। কিন্তু বিধির বিচার আটকায় কে। চন্দ্র টিফিন বাক্স দেখে ফেলেছে।

"আরে ওটা কি? কই দেখি?"

টিফিন বাক্স হাত বদল হল।

"মোমো? তুমি টিফিন খাওনি আজ অফিসে?"

প্রসঙ্গ পরিবর্তনের সুযোগ পাওয়া গেল। বিন্দু হেসে বলে, "না আসলে কাজের চাপে খাওয়া হয়নি।"

চন্দ্র অতি বেয়াক্কেল। দিব্য টিফিন বাক্স খুলে একটা মোমো মুখে পুরে ফেলেছে।

"আরে বাঃ! এতো পুরো টুকিটাকি মোমো দোকানের মতন খেতে হয়েছে! চাটনি দেয়নি? আরে তুমি নাও একটা? কিছু খাওনি তো!"

নিজের হাতের কেরামতি টুকিটাকি দোকানের প্রশংসার মধ্যে দিয়েই আত্মস্থ করে নিল বিন্দু। ঠোঁটের আড়ালে আলগা একটা হাসি লুকিয়ে নিজেকে সামান্য বাহবা দিল। পরক্ষণেই মনকে সতর্ক করল। পা পিছলে গেল বুঝি।

/৪/
*ছয় মাস পর*
কলকাতা শহরে মেসে থাকার থেকে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়া ভালো। আধুনিক Live Together কে অনুকরণ করে চন্দ্র তাই বিন্দুর সাথে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার পরিকল্পনা করে নিল। কিন্তু উভয় পক্ষের পারিবারিক মত বিরোধ হতে পারে এই রকম সম্ভাবনার কথা অনুমান করে বিন্দু কিছু দিনের জন্য ঠিকানা বদল স্থগিত করে দেয়। কিন্তু চন্দ্রের নতুন বাড়িতে আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। এক রবিবার সকালে বাড়িতে এসে বিন্দু অবাক।

"কি অবস্থা করে রেখেছ ঘরের? জানলায় ash tray। চায়ের কাপে সিগারেটের ছাই। অর্ধেক বাসন না মেজে ফেলে রেখেছ বেসিনে। চাদর বদলাও নি কত মাস কে জানে। জামা কাপড় কিভাবে ছড়িয়ে রেখেছ। বিছানায় তুমি শোও কোথায়? বই পত্র ফাইল এগুলো কি?"

ঘরের কোণে ঘাড় গোজ করে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে চন্দ্র হেসে বলে, "ওই আর কি। আলসেমি!"

"তুমি যাও এখন। বাজার থেকে কিছু সব্জি ডিম কিনে নিয়ে এসো। আমি ঘরটা একটু গুছিয়ে ফেলি।"

সকাল থেকে একটু একটু করে ঘরের চেহারা পাল্টে ফেলে বিন্দু। লক্ষ্মী শ্রী যেন এতদিনে ঘরের চারদিকে। দুপুরে সরু চালের ঝরঝরে ভাত, ঝিরি ঝিরি করে কাটা আলুভাজা, মুশুর ডাল আর ডিমের ঝোল রান্না করে দুজনে মিলে খায়। চন্দ্র বাজার করে ফিরে এসে নিজের ঘর দেখে নিজেই চিনতে পারেনি।

দুপুরে খাওয়া দাওয়া করে বিছানায় শোয় দুজন। একটাই বালিশ থাকার কারণে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে দুজন। পাখার হওয়ায় বিন্দুর চুলগুলি এলোমেলো হয়ে উড়ছে। চন্দ্র পাশ থেকে সেই চুলের মিষ্টি গন্ধ উপভোগ করছে।

"তুমি এইবার চলে আসো। আর মেসে থেকে কি হবে?"

"তাই আসতে হবে দেখছি। আর তুমি এবার সিগারেট কমাও। এত পয়সা জমলে একটা নিজের ফ্ল্যাট হয়ে যেত।" সিগারেট এর কথা বলেই জিভ কাটে বিন্দু। তারপর সামলে নিয়ে বলে, "পাশের ঘরে একটা খাটের বন্দোবস্ত করো। আমি আসছে মাসেই চলে আসব।"

"সেই ভালো। আমরা তো আর প্রেম করছিনা যে লোকে কি ভাবলো তাই নিয়ে মাথা ঘামাবো।"

সেদিন বিকেলেই দুজন মিলে একটা সিঙ্গেল বেড আর ঘর সাজাবার কিছু সামগ্রী কিনে নিয়ে আসে।

/৫/
*এক বছর পর*
চন্দ্র আর বিন্দু এখন এক সাথেই থাকে। দুটো বেডরুমে আলাদা থাকা, যে যার নিজের মত। চন্দ্র কোন অধিকার দেখায় না। তবে বিন্দু মাঝে মধ্যেই ঝাটা ও নেতা নিয়ে চন্দ্রের ঘরে হামলা চালায়। তখন জরুরি ফাইল, বই, খবরের কাগজের কাটিং সিগারেটের বাক্স হারিয়ে যায়। কিন্তু বিন্দু যথারীতি এসে সেইটা খুঁজে পায়। এক হাড়িতে ভাত হলেও যে যার নিজের পছন্দ মত রান্না করে নেয়। একে অপরকে একটু আধটু ভাগ দেয়। কিন্তু আজ অব্দি তারা প্রেম করেনা।

রোজকার নিয়ম মত চন্দ্র রাত আটটার সময় অফিস থেকে ফেরে। বিন্দু এখন একটা স্কুলে পড়ায়। কাজেই সন্ধ্যে ছটার মধ্যেই সে ঘরে ফিরে আসে। তারপর ডাইনিং রুমে বসে ছাত্র ছাত্রীদের পড়ায়। সেদিন সকালে পুরনো ডায়রির পাতা উল্টে দেখছিল চন্দ্র। এক বছর আগে একটা থিয়েটার দেখতে গিয়ে আচমকাই আলাপ হয়েছিল দুজনের। মনে মনে একটা মতলব করে অফিস চলে যায় সে। সন্ধ্যে বেলা আচমকাই 6টার মধ্যে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়ি ভর্তি তখন ছাত্র ছাত্রী। চন্দ্র মতলব করেই গিয়েছিল। চকোলেটের বাক্স খুলে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে সবাই কে ছুটি দিয়ে দেয়। সোৎসাহে সবাই ছুটি ছুটি করে বাড়ি ফাঁকা করে দিয়ে চলে যায়। বিন্দু অবাক হয়ে এগিয়ে আসে।

"এটা কি হল?"

চন্দ্র প্রথাগত নিয়ম ভেঙে আচমকাই বিন্দুর কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নেয়। তারপর ব্যাগের সাইড চেন থেকে একটা ছোট বাক্স বের করে।

"তুমি সিগারেটের টাকা বাঁচিয়ে বাড়ি কেনার টাকা জমানোর বুদ্ধি দিয়েছিলে মনে আছে?"

"হ্যাঁ। মনে আছে।" চন্দ্রের এমন আচরণে একটু অবাক হয়েছে বিন্দু। কিন্ত খারাপ ও লাগছে না।

"একটা খামের মধ্যে করে গত তিনমাস আমি সিগারেট কেনার টাকা জমিয়েছি। কত টাকা হয়েছে আন্দাজ কর তো?"

"কত আবার হবে? হাজার দুয়েক!"

চন্দ্র যেন খানিকটা হতাশ হল। কাছেই একটা চেয়ারে হতাশ হয়ে বসে পরে বলল।

"আমায় তুমি এত ভালো করে চেনো। আর এইটুকু আন্দাজ করতে পারলে না?"

বিন্দু কাছে এগিয়ে আসে। তাহলে?
 চন্দ্র বিরস মুখে হাতের ছোট্ট বাক্সটা তুলে ধরে। বিন্দু সেইটা হাতে নিয়ে একটা অসম্ভব সম্ভাবনার কথা ভেবে কাঁপতে থাকে। বাক্সটা খুলতেই।

"আংটি? তুমি আমায় আংটি দিলে?"

"কেমন হয়েছে বললে না?"

বিন্দুর গলা কাঁপছে। চরম উত্তেজনায় তার চোখের কোণে জল।

"খুব ভালো হয়েছে। কিন্তু আংটি?"

"বিয়েটা ভাবছি করেই ফেলি। তোমার সাথে বিবাহের সম্পর্কে লাভ আছে। ক্ষতি নেই।"

বিন্দু হতাশ ভাবে চন্দ্রের কোলেই বসে পরে। চন্দ্র আংটি টা নিয়ে বিন্দুর আঙুলে পরিয়ে দেয়।

"কিন্তু আমরা যে প্রেম করবনা বলেছিলাম?"

"প্রেম করব না বলেই তো বিয়েটা করে নিচ্ছি।"

"কিন্তু!" বিন্দুর চোখে জলের ফোঁটা বড় বড় হয়ে ফুটে ওঠে।

"আবার কিন্তু কিসে?"

"আমি যে। আমি যে তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।"

চন্দ্র এইবার একটু বিপাকে পরে। কিন্ত সে যেন এই কথার জন্য প্রস্তুত ছিলই।

"একটা কথা বলব শুনবে?"

"কি গো?"

"কানে কানে বলছি শোন।"
বিন্দু কান নিয়ে এগিয়ে আসে। চন্দ্র আসতে স্বরে বলে,
"এই একই সমস্যায় আমিও পড়েছি।" বলেই সম্পূর্ন অযাচিত ভাবে বিন্দুর গালে একটি চুমু খায়।

ব্যাস! আর কি এই ভাবেই চন্দ্রের কোলে বিন্দু কলকাতা শহরের একটি ব্যতিক্রমী জুটিকেও প্রেম বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলল। এইভাবেই আরেকটি প্রেম বিরোধী চিন্তাধারার ওপরেও চন্দ্রবিন্দু বসে গেল।

‌‌‍ঁপাগলাদাশু প্রয়াস

সোমবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৮

।।বাঘ বন্দী।।

/১/
সরকারী চাকরি পাওয়ার জন্য ঘুষ দেবোনা। এই বিষয়ে বাবার সাথে বিশেষ রকম বচসার পরে ফস করে একদিন যখন বেসরকারি একটি সংস্থায় চাকরি পেয়ে গেলাম। বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম হাজারীবাগ। একটি সিমেন্ট কারখানায় Q&A দপ্তরের চাকরি। কচি বয়স হিসেবে যে টাকা মাইনে পাই, যথেষ্ট। কাজের চাপ পুরোদস্তুর থাকলেও বিরাম এর অভাব হয়না। দ্বিতীয়ত কলকাতা শহরের মত এখানে অত বিনোদনের সুব্যবস্থা না থাকায় অত খরচ ও হয়না। কিন্তু বিনোদন তো একটা প্রয়োজন। মানুষ বড় আবেগ তাড়িত। তাকে বিনোদনের উপকরণ না দিলে সে মানসিক ভাবে পর্যদুস্ত হতে শুরু করে। আমিও সেই দিকে ধাবিত হচ্ছি সেটা বোধহয় আমাদের কোম্পানির ম্যানেজার নোটিশ করেছিলেন। তাই একদিন তাঁর বাংলোয় নিমন্ত্রন করে একটি ক্যামেরা উপহার দিলেন। Canon eos 1300D. তাঁরই ব্যবহার করা ক্যামেরা। উনি বর্তমানে নতুন একটি ক্যামেরা কিনবেন বলে আমায় দিলেন।

ছবি তোলার বিশেষ কোন শখ আমার কোন কালেই ছিলনা। কিন্তু ওনার বন্ধু দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য (উনি সত্যি একজন ফটোগ্রাফার, আর আমি তাঁর অযোগ্য এক ছাত্র) এর কাছে এক মাস ক্লাস করে যে আগ্রহ পেলাম, সেটা আমার বিনোদন জগৎ নিজের মত করে বানিয়ে নেওয়ার পাথেয়। কলকাতার কিছু বন্ধু DSLR ক্যামেরা নিয়ে অনেক কারুকাজ করে ঠিকই। বর্তমান ফেসবুকের দয়ায় সেইসব কাজ নজরেও পরে। কিন্তু আমি ক্যামেরা নিয়ে চলে যেতাম বনে জঙ্গলে। সেখানে প্রতিটি গাছ থেকে সামান্য নুড়ি পাথরও যেন ক্যামেরায় নিজেদের নতুন নতুন ভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করত। প্রতিদিন সকালে উঠে ভগবান যেন প্রতি মুহূর্তে রঙ তুলি দিয়ে চিত্রপট পরিবর্তন করতেন। সেই খেয়ালেই একদিন দেবাশীষ ভট্টাচার্য্য এর সাথে তাঁর বাড়ি গেলাম তাঁর আরণ্যক জীবনের কিছু ছবি দেখতে। উনি বলতেন যা আমাদের জীবনে নিত্যদিন ঘটে চলেছে। তাকে আমরা কম গুরুত্ব দিতে শুরু করি। যেমন সূর্যাস্ত প্রতিদিন হয়। কিন্তু কজন আমরা ছাদে গিয়ে বা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্যকে উপভোগ করি? করিনা, কারণ সময়ের সাথে আমরা বাধ্য তাল মিলিয়ে চলতে। তাই বলে কি প্রকৃতি একই রকম? মোটেই না। সে রোজ পাল্টায় নতুন নতুন রূপে। তাকে ক্যামেরা বন্দী করে রাখাই মজা। এই মজার খোঁজ পেতেই একদিন কাজের জায়গায় ছুটি নিয়ে চলে এলাম কলকাতা।

/২/
কলকাতা থেকে যাওয়ার আগে বাবা আমার চাকরির জন্য যে ঘুষের টাকা জোগাড় করেছিলেন, সেটা FD করে দিয়ে যাওয়ায় তিনি বেশ খুশি। বেশ ভালো অংকের একটা সুদ ঘরেও আসছে বাড়তি। সেই টাকার কিঞ্চিৎ খরচ করে বাবা একটি উপহার কিনে দিলেন, canon এর একটি lens যা দিয়ে wild life photography করা যায়। পুরোনো album থেকে বাবার তোলা কিছু ছবিও বেরোলো। নিজের মধ্যে ছবি তোলার প্রতি আগ্রহ দেখে যে বিস্ময় জেগেছিল, তা প্রশমিত হল একটু। কারণ রক্ত হয়ত কিছুটা হলেও এই আকর্ষণের কারণ।

যে ছবিটি বিশেষ ভাবে আমার নজর কারল, সেটা সুন্দরবনের একটি বাঘের ছবি। 2004 সালে, সুনামির পরপর বাবার অফিস থেকে একটি দল ত্রাণ নিয়ে সুন্দরবন গিয়েছিল। সেই সময় তোলা। বাঘটা একটা ভাঙা নৌকার ওপর উবু হয়ে বসে জুলু জুলু চোখে তাকিয়ে আছে নদীর পাড়ে মোটরবোট গুলোর দিকে। বাঘের মেজাজ যেন পুরো রাজপুত্র। পেল্লায় চেহারা, প্রতিটি পেশী যেন স্পষ্ট বীরত্বের ইঙ্গিতবাহি। চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট ও প্রবল। ভাবটা এমন যেন মানুষের এইখানে আসার ধৃষ্টতা দেখে সে ভারী আশ্চর্য হয়ে হয়ে গেছে। ছবিটা দেখেই ঠিক করে ফেললাম সুন্দরবন যাবো। অন্তত একটি বাঘ ক্যামেরাবন্দি না করলে আমার জীবন বৃথা।

/৩/
দুদিন পরেই সব ব্যবস্থা করে রওনা দিলাম সুন্দরবনের দিকে। কলকাতা থেকে গাড়ি করে প্রথমে গদখালী বা বাসন্তী যেতে হবে। সেখান থেকে মোটরবোট করে সুন্দর বনের কোর অঞ্চলে। পারমিশন যা নেওয়ার কলকাতা থেকেই ব্যবস্থা করে এসেছি তবে একটু off route ঘুরবার বাসনাও মনে ছিল। গদখালী থেকে বোট পেতে পেতে দুপুর হয়ে যাওয়ায় সেদিনটা আর কোন কাজ হলনা। পাখিরালা গিয়ে ওখানেই রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা হল। বোটের মধ্যেই থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা থাকায় হোটেল খুঁজতে হয়নি। সন্ধ্যের কিছু আগে আমি আর আমার ড্রাইভার কাশীরাম পাখিরালা বাজারে গিয়ে কিছু খাবার কিনে নিলাম। সেখানে এক জিলিপির দোকানে বসে জিলিপি আর সিঙ্গারা খাচ্ছি এমন সময় একটা বেটে খাটো লোক এসে বলল,
"নমস্কার, আমার নাম আশরাফুল মোল্লা, আমি বাঙালী আছে।"

আমিও প্রতি নমস্কার জানাতে সে আমাদের বেঞ্চের সামনে মাটিতে গিয়ে বসল। তার গালে একটা হাসির বেয়াড়া উপস্থিতি যেন বিরক্তিকর ভাবে লেগে আছে। তবু সে গদগদ হাসিটা দূর করতে পারছে না। জিজ্ঞেস করলাম,

"কিছু খাবেন?"

"সবই মালিকের ইচ্ছে।"

কবে তার মালিক হলাম আমি জানিনা কিন্তু জিলিপি আর সিঙ্গারার অর্ডার দিলাম।

আশরাফুল এর খাওয়ার ভঙ্গিও বড় বিচিত্র। একসাথে একটা গোটা জিলিপি মুখের ভিতর পুরে ফেলতে সে অবলীলায় সক্ষম। গোটা চারেক জিলিপি সাবার করে এক ঢোক জল খেয়ে সে আমাদের দিকে না তাকিয়েই বলল,
"কত্তা বাঘের ছবি তুলবেন বলে এসেছেন না?"

এখানে হওয়ায় কথা চাউর হয় বুঝলাম। অগত্যা হ্যা বললাম।

আশরাফুল বেশ তুখোড় লোক বুঝলাম। তার ভাষায় শহুরে পালিশের একটু অভাব হলেও সে বন জঙ্গল ও বিশেষ করে বাঘ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখে। সে মহা উৎসাহে বাঘের নানা কেচ্ছা শোনাতে লাগল। বাঘের বয়স কত, লম্বায় কত, বৌ বাচ্চা আছে কিনা, সবই তার নখদর্পণে।  সব শুনে টুনে তাকে সঙ্গে নেওয়াই সঙ্গত বলে বিবেচনা করলাম। পরদিন ভোরবেলা তাকে আসার কথা বলে মিষ্টির দোকানে দাম মিটিয়ে চলে এলাম ঘাটের কাছে। এসে দেখি সে ও আমাদের পিছু নিয়েছে। চোখা চুখি হতেই সে গদগদ ভাবে এগিয়ে এসে বললে আজকের রাতটা সে যদি নৌকায় কাটায় আমার আপত্তি আছে কিনা। কি আর করা। নৌকার মাঝিদের সাথে কথা বলে আশরাফুল কে নৌকায় তুলে নিলাম। দেখলাম মাঝিরাও তাকে চেনে। বছর খানেক আগে মধু চুরি করতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়েছিল। সেই থেকে মাথাটা একটু বিগড়েছে। কাজ কাম কিছু করেনা বিশেষ তবে এই ট্যুরিস্ট পেলে দুপয়সা কমিয়ে নেয়।

/৪/
পরদিন সকালবেলা আমরা তিনজন বেড়িয়ে পড়লাম। মাঝিরা বাঘ দেখার ব্যাপারটা নিয়ে অতটা গুরুত্ব দিচ্ছিল না। তারা বলল দবাঁকি বলে একটা খাড়ির কাছে বাঘ দেখার আশা রয়েছে। প্রায় 2ঘন্টা উজান বেয়ে আমাদের নৌকা এসে দবাঁকি পৌছালো। এইবার দেখলাম আশরাফুলের খেলা। সে হঠাৎ মাঝিদের বুঝিয়ে বাঝিয়ে বোটের মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে রওনা দিল। কাশীরাম ভীতু লোক। সে এসে ডাকাতের খপ্পরে পড়লাম নাকি সেই ভয় জানাল। পড়লেই বা কি। আমাদের কাছে টাকা পয়সা সেরকম নেই কিছু। কাজেই ভয় পাওয়ার ও কিছু নেই।

মাইল খানেক পেরিয়ে একটা দ্বীপের কাছে এসে আশরাফুল বোট পাড়ে ভিরাতে বলল। দূর থেকেই কিছু ভাঙা বাড়িঘর চোখে পরেছিল। একটা প্রায় ভেঙে যাওয়া বাঁশের জেটিও দেখলাম। কিন্তু সেদিকে না গিয়ে একটু আড়ালে একটা জায়গায় সে বোট পারে লাগাতে বলে। মাঝিরা একটু প্রতিবাদ করায় আশরাফুল ওদের কিছু বলে। তখন ওদের একজন এসে আমার কাছে অনুমতি নিয়ে তক্তা পারে লাগায়। বেশ কিছু খাবার দাবার নিয়ে আশরাফুল, কাশীরাম আর আমি সেই দ্বীপে নামলাম।

এক হাঁটু কাদা পেরিয়ে বাঁধের ওপর উঠে দেখলাম এটা একটা পরিত্যক্ত দ্বীপ। সম্ভবত সুনামির পরে এই জায়গা ছেড়ে লোকে চলে গেছে। দশ বারোটা টালির ঘর চোখে পড়ল। জঙ্গল এখন এইসব বাড়িগুলি নিজের দায়িত্বে নিয়েছে। গ্রামের মধ্য দিয়ে কিছুটা এসে একটা মুটামুটি আস্ত ঘরের সামনে এসে আশরাফুল দাঁড়ালো।

"আজ রাত্তিরে এই বাড়িতেই থাকব।"

কাশীরাম প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল, কিন্তু আমি বাধা দিলাম।

"এই দ্বীপে বাঘ আছে?"

"আজ্ঞে না।" খুব স্বাভাবিক স্বরেই আশরাফুল বলল।

"তাহলে এখানে থাকব কেন?" আমি রীতিমত বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম।

সে জানালো আমার কোন ক্ষতি হবেনা। উল্টে লাভ হবে। অচেনা জায়গায় কি আর করার। তাকেই বিশ্বাস করলাম। কারণ বাঘের অমন ছবি না তুলে আমার শান্তি নেই। যে বাড়িটা আমাদের রাতের আস্তানা হিসেবে নির্বাচন করেছে আশরাফুল সেটা একটা মাটির ঢিবির ওপর বানানো ঘর। টালির চাল আর মেটে দেওয়াল। শক্ত গাঁথুনির জোরেই বাড়িটা এখনো টিকে রয়েছে বোঝা যায়। কিন্তু যে দরজা তাকে আগলে রেখেছে সেটা বাঘ কেন একটা বেড়াল ও ঠেলে আসতে পারে। সঙ্গে থাকা মালপত্র সেই ঘরে রেখে আমরা দ্বীপটা ঘুরে দেখব বলে বেরোলাম। দুটো ক্যামেরা সঙ্গে করে এনেছিলাম। আর দুসেট করে ব্যাটারি। দ্বীপটা সত্যি ক্যামেরা বন্দী হওয়ার উপযুক্ত সম্ভার নিয়ে প্রস্তুত। গ্রাম পেরিয়েই একটা মাঠের কাছে এসে পড়লাম আমরা। আশরাফুল বলল, মরিচঝাঁপি ঘটনার সময় কিছু মানুষ পালিয়ে এসে এই দ্বীপে বাসা করেছিল। কিন্তু বছর পাঁচেকের মধ্যেই তারা চলে যায় এই গ্রাম থেকে। প্রথম কারণ ছিল খাবার জলের অভাব। তারপর ম্যালেরিয়া আর বাঘ। সেই থেকে জায়গাটা এরকমই রয়ে গেছে।

প্রায় দুঘন্টা আমরা দ্বীপটা চষে বেড়ালাম। চিত্তগ্রাহী অনেক দৃশ্য ফ্রেম বন্দিও করলাম। শেষে দ্বীপটার পশ্চিম প্রান্তে এসে আমরা বিশ্রামের জন্য বসলাম। ফ্লাস্কে চা আর সঙ্গে বিস্কুট আনা হয়েছিল। তাই দিয়ে বিকেলের টিফিন করছি, এমন সময় একটা সোনালী আলো চোখে এসে পড়ল। বিদ্যাধরি নদীর জলে সূর্যের প্রতিফলন। সত্যি সূর্যাস্ত কখনো পুরোনো হয়না। খান দশেক সূর্যাস্তের ফ্রেম দখল নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি, গ্যাক গ্যাক করে একটা শব্দ কানে এল।  আমাদের থেকে বিশ কি ত্রিশ গজ দূরে পারে কয়েকটি হরিণ।

জীবন সার্থক বলে মনে হয়েছিল সেই দৃশ্য দেখে। সূর্যাস্তের সোনালী আলোয় হরিনের গায়ের রঙ যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে। ক্যামেরা হাতে করে ধীর পদক্ষেপে সেদিকে চললাম। ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল গুলি বেরিয়ে এসেছে ভাটার কারণে। তাদের মধ্যে দিয়ে অত্যন্ত সাবধানে একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া। কাশীরাম নিজের কোডাক ক্যামেরা বের করে নিয়েছে। সেও প্রস্তুত ছবি তুলতে। নদীর পার ঘেঁষে কাদা মাটি দিয়ে মোটামুটি একটা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে কয়েকটা ছবি নিলাম। এরকম ছবি তোলার সময় সাধারণত শাটার স্পিড বাড়িয়ে নিতে হয়। Drive mode এ রাখলে পর পর অনেকগুলো ছবি চলে আসে। আমিও সেই মতোই চলছি কিন্তু এমন সময় খেয়াল হল পায়ে কিছু ঠেকছে।

আমি ভেবেছিলাম গাছের গুড়ি বা ঐ জাতীয় কিছু। কিন্তু তার ওপরে পা রাখতেই সেটা একটা হ্যাচকা টান মেরে আমায় প্রায় ফেলে দেওয়ার উপক্রম। কোন মতে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি একটা পেল্লায় হাঁ আমার দিকে তেড়ে আসছে। ভুল করে কুমিরের লেজ মাড়িয়ে ফেলেছি। এখন এক খাবলা মাংস তাকে ভূর্তুকি দিতেই হবে। প্রায় কিং কর্তব্য বিমুঢ় অবস্থা। কিন্তু কামড় খেলাম না। আশরাফুল একটা লাঠি ছুড়ে কুমিরের হা আপাতত বন্ধ করিয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে সক্ষম হয়েছে। আমিও সুযোগ পেয়ে কয়েক পা পিছিয়ে আসতে যাবো কিন্তু কাদার দুর্বিপাকে ভাগ্য সহায় দেয় না। নরম মাটিতে পা ঢুকে গিয়ে একেবারে দুম করে পড়ে গেলাম। কুমিরটি প্রাপ্ত বয়স্ক হলেও আকারে বিরাট নয়। তার কামড়ের দৌরাত্ব বড়জোর একটি বড় সাইজের কুকুরের সমান হবে। কিন্তু যাই হোক কুমির তো। কুমির টা আমাকে ভয় টয় পাইয়ে দিয়ে এমন বেমক্কা আছাড় খেতে দেখে একটু যেন ফিচ করে হেসে ফেলল। ইতিমধ্যে কাশীরাম আমার কাছে চলে এসেছে। আশরাফুল ও একটা গাছের ডাল দিয়ে কুমিরটিকে জলের দিকে মুখ ঘোরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এইসব ঘটনায় যেটা খেয়াল করা হয়নি সেটা হল পার বরাবর এরকম বেশ কয়েকটি কুমির শুয়ে আছে। তাদের কারো মুখ খোলা, কেউ বা মুখ বন্ধ করেই নিরুপদ্রব বিশ্রাম নিচ্ছে। এদেরই একটি কুমির জলের মধ্যে সড়াৎ করে ডুব দেওয়ায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ হল।

কাশীরাম আমায় হাত ধরে টেনে তুলল। কিন্তু পা এমন ভাবে মচকেছে, সোজা ভাবে দাঁড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ক্যামেরা দুটো পরীক্ষা করে দেখলাম তারা আস্তই আছে। তখন নিশ্চিন্ত হয়ে কুমিরদের একটু ফ্রেম বন্দি করে নিলাম। হরিণ বাবাজিরা ততক্ষণে উধাও।

/৫/
আসার পথে একটা ছোট খাড়ি নজরে পড়েছিল। সেখানে জল বেশ পরিষ্কার। তাতেই নেমে নিজের গায়ে ও জামায় লাগা কাঁদা ধুয়ে একটু পরিষ্কার হলাম। এইসব ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূল বেশ ভয়ানক। বাঘের আচরের মতোই তারা ক্ষত করতে সক্ষম। হয়েছেও তাই। বাঁ পায়ের গোড়ালির কাছে বেশ কিছুটা কেটেছে। কি আর করা। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই আস্তানার দিকে ফিরে চললাম। সন্ধ্যের পরেও এখানে অপেক্ষা করা মানে বাঘকে নৈশভোজে নিমন্ত্রন করা।

সন্ধ্যের সময় পারের দিক থেকে বোটের আওয়াজ পেলাম। সময় হয়ে গেছে তাই এখন পাখিরালা ফিরে যাবে বোট। কাশী আর আশরাফুল কে পাঠিয়েছিলাম আমার ওষুধের বাক্স আনার জন্য। রাত্রের খাবার ও নিয়ে আসবে তারা। একটা ফোল্ডিং টুল পেতে আমি ঘরের বাইরে বসে সন্ধ্যার নীরবতা উপভোগ করছি। আস্তে আস্তে বোটের আওয়াজ ক্ষিণ হয়ে এল। সন্ধ্যে যেন এখানে ঝপ করেই নেমে যায়। আলকাতরা মাখানো চারটে দেওয়াল যেন আমায় ঘিরে ধরেছে। মাঝে মাঝে টুকরো কিছু জোনাকির আলো টিম টিম করছে। টর্চের আলো দিয়ে মাঝে মধ্যে এদিক ওদিক দেখে নিচ্ছি। শুকনো পাতার খসখসে আওয়াজ, গাছের ডালের মধ্যে দিয়ে বন্য হওয়ার মত্ত সঞ্চালন। এইসব কিছুই আমার কাছে নতুন। ঘরের দালানে বসে আজকের সংগ্রহ করা ছবিগুলি দেখছি। এমন সময় শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। কেউ বা কিছু যেন আমায় অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছে। সুযোগ পেলেই হামলে পড়বে। মানুষের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সব সময় মিথ্যে বলেনা। ঘরের কোন দিয়ে একটা ঝোপের কাছে এক জোড়া জ্বল জ্বলে চোখ নজরে পড়ল। তার স্থির দৃষ্টি আমার দিকে। কেমন যেন একটা সম্মোহনী ব্যাপার আছে জঙ্গলের নীরবতায়। আমি প্রায় আসক্ত হয়ে পড়েছি এমন সময় কাশিরামের গলা শুনলাম। বনের মধ্যে থেকে তারা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। আমায় অমন ভাবে ঝোপের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আশরাফুল টর্চের আলো ফেলল সেদিকে। একটা শুয়োর বা বুনো শুয়োর আস্তে করে ঝোপের আড়ালে চলে গেল।

"কত্তা কি ভয় পাইসিলেন নাকি?"

"না না। ভয় কিসের?"

"এইটা বোদহয় ব্যাটার ডেরা আসিল। আমরা দখল নিসি দেইখ্যা চইলা গেল। জ্বালাইব না।"

রাতে ক্লিক স্টোভে আশরাফুল নিজেই রান্না করল। দেশি মুরগির মাংস আর গরম গরম রুটি। রান্নার হাত বেশ ভালোই তা প্রক্রিয়া দেখলেই আন্দাজ পাওয়া যায়। কিন্তু রাত যত বাড়ল, আমার পায়ের ব্যথাও বাড়ল। বিশেষ করে কেটে যাওয়া জায়গাটা এতক্ষনে দগদগে হয়ে উঠেছে। ডেটল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আঘাতটা বেশ ভালো। সন্ধ্যা আটটার মধ্যেই রান্না বান্না শেষ। তিনজনে মিলে খেতে বসে গেলাম।

"আচ্ছা আশরাফুল। তুমি যে বোট ফেরত পাঠিয়ে দিলে, এখন যদি কোন বিপদ হয় কি করবে?"

"আজ্ঞে এখানে বিপদ তেমন নাই। তবে ভুতের ভয় আসে। সাপ বা অন্য কিসুতে ভয় নেই। বোট এইখানে থাকলে পুলিশে ধরব। তাই পাঠায় দিলাম।"

"জঙ্গলে জানোয়ারের ভয় নেই, ভুতের ভয় আছে?"

"আজ্ঞে তা আসে। এই গ্রামে কম লোক মরে নাই। তাগো ভুত এইখানেই রয়ে গেসে।"

বুঝলাম আশরাফুল এখন ভুল বকছে। রান্না করার সময় একটা বাজে গন্ধ পেয়ে খেয়াল করেছিলাম পানীয়ের বোতলটি। খাঁটি দিশি চোলাই।

খাওয়া দাওয়া শেষ হলে শুতে যাওয়ার আগে একটা ব্যথার ওষুধ খেয়ে নিলাম। কিন্তু কাটা জায়গার ব্যথা কিছুতেই আরাম দেয়না। সেটা ক্রমেই দগদগে হয়ে উঠল। আশরাফুল এই সময় একটা কান্ড করল। একটা মোমবাতির ওপর চামচ গরম করে তাতে খানিকটা বরোলিন ফেলে দিল। চড়চড় করে সেই বরোলিন গলতে শুরু করল। আশরাফুল অপেক্ষা না করেই সেই গরম ফুটন্ত বরোলিন ঢেলে দিল আমার পায়ের কাটা জায়গাতে।

এক মুহূর্তের জন্য মনে হল এখুনি ব্যাটার চুলের মুঠি ধরে মুন্ডুটা আলগা করে দেই। ব্যথার চোটে প্রাণ যেন এখনই বেরিয়ে যাবে। চিৎকার দিয়ে ওঠায় আসে পাশে গাছপালা থেকে কিছু পাখি উড়ে পালাল। আশরাফুল নির্বিকার। সে আবার চামচ গরম করতে ব্যস্ত। দ্বিতীয়বারের মত সে গরম বরোলিন নিয়ে এগিয়ে আসতেই আমি তাকে সাবধান করে দিলাম। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সে আবার ঢেলে দিল আরেক প্রলেপ গরম বরোলিন।

ব্যথা কিন্তু কমল। কাকাবাবুর সেই ফেমাস ডায়লগ মনে পড়ে গেল তখন। এইসব জায়গায় এলোপ্যাথি হোমিওপ্যাথির থেকে সিমপ্যাথি চলে বেশি। আমায় শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ে কাশী আর অসফারুল পাশের একটা ঘরে চলে গেল। সেখানে তারা পালা করে জেগে পাহারা দেবে। আমি দরজাটা যতটা সম্ভব ভালো করে লাগিয়ে দিয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। এরকম পরিবেশে চট করে ঘুম আসেনা। অনেক্ষন ধরে এপাশ ওপাশ করে ঘুম না আসায় উঠে একটা সিগারেট ধরালাম। মোমবাতিটা শেষ মুহূর্তের আলো দিতে খাবি খাচ্ছিল। ওই আগুনেই সিগারেট ধরিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসলাম। বাজে গুমোট একটা গরম এই ঘরে। ক্যামেরার ব্যাগ থেকে ম্যানুয়াল এর বইটা নিয়ে হওয়া খাচ্ছি এমন সময় ঘরের কাছেই একটা চাপা মেঘ গর্জনের মত আওয়াজ শুনলাম। জীবনে প্রথমবার বাঘের ডাক শোনার অভিজ্ঞতা হল। সে যেন গম্ভীর ভাবে হুমম!! বলে গেল। জানান দিলো, 'তুমি এসেছ আমি জানি। কাল দেখা হবে।'

/৬/
কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। শেষ রাতের দিকে হঠাৎ ঘরের মধ্যে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসলাম। দেখলাম নিভে যাওয়া মোমবাতিটার পাশেই একটি কুমির ওৎ পেতে বসে আছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কোন রকম শব্দ করবার ও ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছি। ওঠার চেষ্টা করতে গিয়েও দেখলাম নড়াচড়া করবার ক্ষমতাও নেই। মন্ত্র অবিষ্টের মতোই জড় পদার্থ হয়ে পড়ে রয়েছি। শুধু দেখতে পাচ্ছি কুমিরটা বিরাট হা করে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখে প্রতিহিংসার আগুন স্পষ্ট। বিকেলের অপমান সে ভুলতে পারেনি বলেই খুঁজে খুঁজে এতদূর এসেছে।

কোনরকমে হাতটা তুলে তাকে বাধা দিতে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সে মরণ কামড় দিল আমার হাতে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে কুমিরের শিকার ধরবার কায়দা অনেকবার দেখেছি। হাতটা দেহ থেকে ছিড়ে নেওয়ার জন্য সে ঝাকুনি দিতে শুরু করল।

"কি হল? দাদা ওঠেন?"

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কাশীরাম দেখি অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে ডান হাতের ওপর চাপ দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সেই ব্যাথাটা মনে মনে স্বপ্নে দেখলাম কুমির কেটে নিচ্ছে। দুঃস্বপ্নের কথা ভুলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কি হল?

/৭/
ভোরএর আলো সবে দেখা দিয়েছে। ক্যামেরা হাতে নিয়ে আমরা রওনা দিয়েছি গতকাল যে খাড়ির দিকে গিয়েছিলাম সেদিকে। মাঠ পেরিয়ে খাড়ির কাছাকাছি আসতেই বোটকা গন্ধটা নাকে লাগল। এই গন্ধ নাকি বাঘের উপস্থিতি জানান দেয়। অসফারুল ও দেখলাম সতর্ক নজর রাখছে এদিক ওদিক। এমন সময় হঠাৎ, মাঠের উল্টোদিকে হাত পঞ্চাশেক দূরে একটা চৌমাথা মত জায়গায় বাঘটা দেখা গেল। রাজকীয় চালে সে একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার দৃষ্টির সামনে নিজেদের বড় অসহায় ও বেকুব বলে মনে হল। সিংহ বনেদিয়ানার জোরে পশুরাজের খেতাব পেলেও আভিজাত্যের দিক থেকে বাঘ কিছু কম নয়। সে যেন আগে থেকেই জানত আমাদের উপস্থিতির কারণ। আমাদের ঔদ্ধত্বে সে খুবই আশ্চর্য হয়েছে কিন্তু সাহসের তারিফ না করেও পারছে না।

বাঘের মতিগতি কিছুটা আন্দাজ করে ক্যামেরা তুলে শাটার মারতেই বাঘ সামনের একটা ঝোপে লুকিয়ে গেল। কিছুক্ষন নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর অসফারুল এগোবার নির্দেশ দিল। মাঠের উত্তর দিক বরাবর এগিয়ে চলেছি আমরা। সূর্য তখন সবে উকি দিয়েছে। একটা ছোট জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে আবার বাঘের দেখা পাওয়া গেল। ঠিক আমাদের বাম পাশ দিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে সে যেন নজর রাখছে। একটু সময়ের জন্য দাঁড়িয়ে ছবি নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সে গুড়ে বালি। বাঘ চোখে ধরা দিলেও ক্যামেরায় আসতে নারাজ।

অসফারুল বললে, "ভারী লাজুক বাঘ!"

লাজুক বাঘ? আমরা কি বাঘের ভাশুর ঠাকুর নাকি যে বাঘ দেখে লজ্জা পাবে!

অসফারুল এর নির্দেশ মত আবার এগোলাম। এইবার কিছুক্ষন পরেই দেখা গেল। তবে বাম দিকে নয়, ডানদিকের একটা ঝোপে। এর মধ্যে এপার ওপার করল কখন? দুটো বাঘ নেই তো!
পাশ থেকে ফলো করছে। তারপর সুযোগ পেলেই ঘাড়ের ওপর ঝাঁপ দেবে!

অসফারুল বলল না একটাই বাঘ। এই বাঘের চেহারা তার চেনা। বাঘ খুব ছুপা রুস্তম হয়। মদ্দ শিকারের সাথে এরকম একটু দিললগী করে।

বাঘ দিললগী করে! আচ্ছা মুশকিল। বাঘের এমন ইয়ার্কি মোটেই ভালো জিনিস নয়। সতর্ক দৃষ্টি রেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। খাড়ির কাছে পৌঁছে পুব দিকের পারে একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে ক্যামেরা তাগ করে বসে রইলাম।

ভোর সাতটা নাগাদ ক্যামেরার শাটার সশব্দে নিজের কাজ করে গেল। উদিত সূর্যের নতুন আলোয় খাড়ির স্বচ্ছ জলের পাশে তিনি দেখা দিলেন। একসময় জলের ধারে এসে অল্প কিছু সময়ের জন্য হলেও জলে তার মুখ ছোয়ালেন। অবশেষে আমার অভিপ্রায় সফল হল। আমার ক্যামেরাতে বাঘবন্দী হল।

একটি পাগলাদাশু প্রয়াস।