দন্ত - বিহঙ্গ
//১//
গাড়ি থেকে নেমেই দৌড় দেয় ফটিক। ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম থেকে সবে গতি নিয়েছে। এই ট্রেন ফস্কে গেলে আজ আর চেম্বার করা হবে না। ব্যাগ ভর্তি দাঁত তোলার সরঞ্জাম, সেই ভার নিয়েই দৌড় দেয় সে। ফটিকের তুলকালাম দৌড়ের সাথে তারাও কলতান জুড়েছে। ঝনঝন, ঠুনঠুন, আরো কত রকম শব্দের বিন্যাসে ফটিকের দৌড়ের cinematic background তৈরী করছে। সিনেমার নায়কের মত ধীর-প্ৰক্ষেপণে কল্পনা করে নিজেকে। কপালের ঘাম বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে। শ্বাস-প্রশ্বাসে নিখাদ নায়কোচিত রাগের আলাপ। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন Olympicএর professional দৌড়বাজদের মত। শেষ কামরার শেষ দরজার হাতল ধরে লাফ দিতেই confidence টা একটু ঘোলাটে হয়ে যায় ফটিকের। টিকিট তো কাটা হলনা? ঢং করে একটা আওয়াজ হল মাথার ওপর। তারপর ছলাৎ করে আঁশটে গন্ধওয়ালা জল ভিজিয়ে দিল ফটিকের ঘামে ভেজা জামাকে আরো কয়েক প্রস্থ। কামরার পা-দানিতে সঠিক সময় পা রাখা হলনা। গেটের পাশে ঝুলে থাকা এক মাছওয়ালার হাড়িতে লাফ দেবার সময় গুতিয়ে ফেলেছে সে। আর তাতেই ঢং, আর তৎ পর ছলাৎ। ট্রেনের গতির সাথে খানিকটা দৌড়েও ভরবেগ সমান রাখতে পারেনা। পিঠের বোচকা ভারি ব্যাগটা অকালকুষ্মান্ডের মত সামনে এগিয়ে ভারকেন্দ্রের পরিবর্তন ঘটায়। আর তাতেই হুমড়ি খেয়ে একেবারে পপাত চ। ধুলিকৃত প্ল্যাটফর্মে খানিক গড়িয়ে ও খানিক ডিগবাজি খেয়ে আপাত গতিবেগ রুদ্ধ হয়। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষন ঐভাবেই পরে থাকে মেঝেতে। মাছের গন্ধে গা ঘিনঘিন করছে তার। আজকের দিনটাই খারাপ। সকাল সকাল এমন কান্ড প্ল্যাটফর্মে বেশ শোরগোল ফেলে দেয়। কিছু নেতা ও আঁতেল গোছের কাকু এগিয়ে আসেন 'আহা আহা!!' করে।
"অমন বেয়াক্কেলের মত ঝাঁপ দিতে গেলেন কেন? Running ট্রেনে ঐভাবে কেউ ওঠে?" একজন ষণ্ডা মতন লোক ফটিককে হ্যাচকা টানে তুলে পাশের বেঞ্চিতে বসিয়ে প্রশ্ন করে। কয়েকজন সমব্যাথী ব্যাগ থেকে ছিটকে পরা যন্ত্রপাতি কুড়িয়ে এনে দেয়।
"আপনার ব্যাগটা একবার দেখে নিন মশাই। সবকটা screwdriver আর plus আছে কিনা।"
নাকে ধুলো আর মেছো জল ঢুকে বন্ধ হয়েছিল বলে ফোতফোঁৎ করে নাক ঝাড়ছিল ফটিক। তার দাঁত তোলার সরঞ্জামের এ'হেন্ নামকরণ শুনে খানিকটা ধুলো নাক দিয়ে টেনে ফেলে ভুল করে। তারপর অবাক দৃষ্টিতে উপস্থিত সবার দিকে ক্ষণিক তাকিয়ে থেকে "যাছ্যাৎ!" শব্দে বিকট ভাবে হেঁচে ফেলে। উপস্থিত ত্রাতাদের মধ্যে কয়েকজন চমকে উঠে নিজের জিভ কামড়ে ফেলে। প্ল্যাটফর্মের এক কোণে বসে এক ভিখিরী খুচরো পয়সা ভর্তি বাটি ঝাকিয়ে ভিক্ষে করছিলো। হাঁচির শব্দে চমকে ওঠায়, সব খুচরো পয়সা ছিটকে পরে বাটি থেকে। তাদের মিলিত পতন যেন গোটা প্ল্যাটফর্মে করতালির মত শোনায়। একটা বাচ্চা বেঞ্চির একপাশে বসে বরফজল খাচ্ছিলো। হাঁচির শব্দে ভয় পেয়ে গোটাটাই হাত থেকে পরে যায় বলে কান্না জুড়ে দেয়।
"মশাই তো হাঁচির জন্যে ভারতরত্ন পেতে পারেন দেখছি।" সহমর্মীদের একজন মন্তব্য করে বসে।
এমন সময় কিছু সহৃদয় ব্যক্তি স্টেশন মাস্টারকে ধরে নিয়ে আসেন। ট্রেন থেকে পরে একজন গুরুতর আহত এই মর্মে। শারীরিক আঘাত তেমন গুরত্বপূর্ন না হলেও, ট্রেন মিস করে মানসিক ভাবে খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল ফটিক। তার ওপর স্টেশন মাস্টারকে দেখে ভয় এসে কাঁধে চাপে। স্টেশন মাস্টার অবশ্যি খুবই সজ্জন ব্যক্তি। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে জিজ্ঞেস করলেন,
"এত তাড়াহুড়োর কি ছিল মশাই। আধ ঘন্টা অন্তর তো ট্রেন। একটা নাহয় মিস হত। এমন ভাবে কেউ ঝুঁকি নেয়?"
"এত তাড়াহুড়োর কি ছিল মশাই। আধ ঘন্টা অন্তর তো ট্রেন। একটা নাহয় মিস হত। এমন ভাবে কেউ ঝুঁকি নেয়?"
"আজ্ঞে না।" মুখ কাচুমাচু করে বলে ফটিক। "আধ ঘন্টা নয়, আবার এক ঘন্টা পর ট্রেন।"
"বাহ্! যাবেন কোথায় আপনি?" স্টেশন মাস্টার আরেকবার নিজের কপালের জমা ঘাম মুছে নেন।
"আজ্ঞে ক্যানিং যাবো।" ফটিক আবার কাচুমাচু মুখ করে বলে।
"ভারি আজব মানুষতো আপনি। যাবেন ক্যানিং এ, এদিকে আছাড় খেলেন নামখানা লোকাল থেকে? কোন ট্রেনে উঠছেন দেখেন না?"
এবার সত্যিই নিজেকে বুৰ্বক বলে মনে হয় ফটিকের। নিজের আক্কেল দেখে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হয়। অবশ্য নিজের আক্কেল সম্পর্কে কোন কালেই খুশি নয় সে। নইলে এই মরা বাজারে কেউ দাঁতের ডাক্তার হয়? উচ্চ-মাধ্যমিকের পর যে উৎসাহে দন্তচিকিৎসক হবে বলে দাঁত-কারী কলেজে ভর্তি হয়েছিল, সব উৎসাহ নিমের পাচনের মতই তেঁতো এখন। চারিদিকে এত দাঁতের ডাক্তার যে দন্ত চিকিৎসক হয়েও কলকাতার বাজারে দাঁত ফোটাতে পারলো না সে? সাধে কি আর ক্যানিং মেচেদা ছুটে বেড়াতে হয়।
//২//
"ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?" চেম্বারের বাইরে কেউ বলে ওঠে।
"একটু দাঁড়ান, আসছি।" ফটিক জবাব দেয় চেম্বারের ভিতর থেকে।
কিছু পরেই প্রায় নীলবর্ণ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে ফটিক। একদম চাতালে এসে কুঁজো হয়ে দম নেয়।
আগত ব্যক্তি ডাক্তারের এমত অবস্থা দেখে সংকিত হয়ে এগিয়ে আসেন।
"কি ব্যাপার? শরীর খারাপ নাকি?"
"আজ্ঞে না। ভিতরে ধূপ জ্বেলে পুজো দিচ্ছিলাম। আমার আবার ধুলো ধোঁয়ায় বড় এলার্জি কিনা! তাই দম আটকে পুজো করি।"
চেম্বার খোলার পরে নিত্যকর্ম পদ্ধতি পড়ে পুজো দেওয়ার অভ্যেস ফটিকের। পুজোর বিষয়ে বাকি সব কিছুই ঠিক থাকলেও, এই ধূপ ধুনোয় তার বড় অসুবিধে। একটুখানি নাকে গেলেই ব্যাস। একশ চব্বিশ বার না হাঁচলে, থামে না। এদিকে পুজোর এই বিশেষ অধ্যায়টা বাদ দিলেও চলে না। সকাল সকাল এসে চেম্বার খুলে, নাকে রুমাল বেঁধে ঝাড়পোছ করে, পুজো দেয় ফটিক। ক্যানিং এর এই চেম্বারে তার পসার এখন ভালোই জমেছে। গেল পৌষে তার রুগীর সংখ্যা দুই পেরিয়ে চার হয়েছিল। সেই থেকে তার দৃঢ় বিশ্বাস। এই চত্তরে তার মত দন্তচিকিৎসক আর নেই।
দম আটকে প্রায় পাঁচ মিনিট ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে, ধুনো দিয়ে চেম্বার থেকে বাইরে আসে ফটিক। তারপরে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে আবার চেম্বারে ঢোকে। আগত ব্যক্তি রুগী না পর্যটক সে বিষয়ে এখনো কিছু জানে না ফটিক। কিন্তু আগন্তুকও পিছুপিছু চেম্বারে এসে ঢোকে। নিজের সাধ করে বানানো কাঠের চেয়ারে গিয়ে বেশ সাহেবি কেতায় বসে গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে আগন্তুককে বসতে বলে। আগত ব্যক্তি তখন চেম্বারের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষনে ব্যস্ত। ডাক্তারবাবু বসতে বলায় ছোট্ট করে নমস্কার ঠুকে রুগী বসার একটা টুল নিয়ে টেবিলের সামনে এসে বসে।
"বেড়ে সাজিয়েছেন কিন্তু আপনার ডিস্পেন্সারি। নাহ! এ'জিনিস এই তল্লাটে কেউ দেখেনি।"
আগন্তুকের প্রশংসা শুনে বেশ গদগদ আহল্লাদিত হয়ে, মাথা নিচু করে হেসে নেয় ফটিক।
"তা আমার যা সাধ্য, সেই মতোই সাজিয়েছি। অতিরিক্ত কিছু নেই।" ব্যাগ থেকে প্রেসক্রিপসন প্যাড আর কলম বার করতে করতে বলে ফটিক।
"না না। তাও যেভাবে সাজিয়েছেন, ক'টা ডাক্তার পারে?"
"হে হে!! ধন্যবাদ। বলুন। কি সমস্যা আপনার?"
আগন্তুক এবার যেন প্রশংসা থেকে বিরত হওয়ার সময় এসেছে বুঝে যায়। একটু থেমে বলেন।
"আজ্ঞে সমস্যা ঠিক আমার নয় ডাক্তারবাবু। আমার মেয়ের।"
"কি ব্যাপার?" ফটিক উৎসাহিত হয়।
"প্রায়ই বলছে, দাঁত মাজতে গেলে নাকি মাড়ি দিয়ে রক্ত আসছে। কি করা যায় বলুন দেখি?"
"বেশ তো, মেয়ে কে নিয়ে চলে আসুন। দেখে নিচ্ছি।"
একটু যেন বিপাকে পরেন আগন্তুক ভদ্রলোক। ক্ষণিক বিরতি নিয়ে বলেন,
"তাকে এখন পাই কোথায় বলুন? সে তো এখন কলেজে। কাল কি আপনি বসেন? তাহলে আমি তাকে নিয়ে আসব।"
"আমি তো এখানে সপ্তাহে দু'দিন বসি। আমি আবার আসব শুক্রবার। সেদিন নিয়ে আসবেন নাহয়।"
"ওরে বাবা! তাহলে এই ক'দিন রক্ত আসলে কি করব?"
ফটিক যেন একটু বিপাকে পরে যায়। সত্যি তো। একজনের সমস্যা জেনেও সে কোন উপকার না করে, শুক্রবার অব্দি অপেক্ষা করবে? মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। ভদ্রলোকটিকে দেখেই মায়া হয়। মাথার ওপর পরিপাটি টাক, উপরের পাটির সামনের দাঁতের অগ্রদূত মূর্তি গোফের আড়ালে লোকানো ভাবাবেগ মিশ্রিত হাসির উজান এনে দেয় যেন। কি মনে হল, ব্যাগ থেকে একটা মলম আর কুলকুচির ওষুধ বেড় করে টেবিলের ওপরে রাখে ফটিক।
"এই মলম নিয়ে যান। মেয়েকে বলুন নিয়ম করে, দু'বেলা মাড়িতে মালিশ করতে। আর প্রতিবার খাওয়ার পরে এই কুলকুচির ওষুধ দিয়ে কুলি করতে। শুক্রবার আমি দেখি। তারপর নাহয় কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।"
ওষুধগুলি হাতে নিয়ে আগন্তুক আবার বলে ওঠে।
"আমার স্ত্রীরও জানেন তো দাঁতের সমস্যা। এত অযত্ন করে, কি আর বলব। পিছনের মাড়িতে একটি দাঁত ও অবশিষ্ট নেই। সব কটির গোড়া পরে আছে। এখন তো প্রায়ই শুনি মাড়ি ফুলে ওঠে নাকি।"
ফটিক আরো খানিকটা আহল্লাদিত হয়ে ব্যাগের ভিতর হাত দেয়।
"দাঁতের গোড়া পরে থাকা খুব একটা ভালো জিনিস তো নয়। এক কাজ করুন না। শুক্রবার আপনার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে আসুন। এই ওষুধগুলি নিয়ে যান। আজ থেকে খাওয়ানো শুরু করলে আমি শুক্রবার দাঁত কিছু তুলেও দিতে পারব তাহলে।"
দু'পাতা ওষুধ পকেটে ভরে পেন্নাম ঠুকে উঠে পড়েন আগন্তুক। "আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো ডাক্তারবাবু। আচ্ছা আজ আসি তাহলে, শুক্রবার দেখা হচ্ছে।"
"ওষুধগুলোর দামটা একটু দিতে হত।" পিছু ডেকে ফেলে ফটিক।
আগন্তুক ফিরে আসেন। "ওবাবা! এগুলোর দাম আছে নাকি?"
"আজ্ঞে হা! এগুলো বিক্রির ওষুধ।"
"আমি তো আমার ভগ্নিপতির কাছে আপনার সুখ্যাত শুনে খবর নিতে এসেছিলাম ডাক্তারবাবু। টাকা-পয়সা তো সঙ্গে আনিনি। শুক্রবার এগুলোর দাম দিলে হবেনা? নইলে আপনি রেখে দিন, আমি শুক্রবার এসে নিয়ে যাবো।"
ভারি লজ্জায় পরে যায় ফটিক। "আরে না না। পরদিন আসুন, একেবারেই দিয়ে দেবেন নাহয়।"
অনেক আশীর্বাদ ও ধন্যবাদ জানিয়ে সকালের আগন্তুক বিদায় নেয়। শুক্রবার সকালের জন্যে দু'টো রুগী পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে নেচে উঠল যেন। শুক্রবার কি কি করবে সেইসব ভেবে ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে পাঁচশ বাতাসা মানত করে ফেলে ফটিক।
//৩//
"ন্যাপলা এখানে কি করতে এসেছিল?"
ঠাকুরের ছবির পানে তাকিয়ে চোখে জল এসে গেছিল ফটিকের প্রায়। গোটা মাস যে রুগীর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, একদিনের সকালেই দুটো রুগীর বরাত পাওয়া কি মুখের কথা? ভগবানের অসীম কৃপা ছাড়া কিই বা হতে পারে? এ'সব ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্থায় হঠাৎ নিজের ঘরে কারো কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে ফটিক।
"কে? কে এসেছিল?" ফটিক দরজার দিকে তাকায়। ঠাকুরকে আরো কিছু উপঢৌকন মানত করেই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু মাঝ পথে বাধা পরে।
"ন্যাপলা। ন্যাপলা কি করতে এসেছিল তোমার চেম্বারে? বেরোতে দেখলাম মনে হল?" তামীম শেখ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন। এক কালে এখানকার নাম করা হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন। ফটিক এর যুবা বয়সের মেহনত দেখে মাঝে মধ্যে আড্ডা মারতে আসেন। এখানকার ইতিহাসের গল্প করেন। রুগী না থাকলেও, তামীম শেখের সাথে গপ্প করে আর হুঁকো টেনে সময় যেত ভালো।
"আপনি ওনাকে চেনেন নাকি?" ফটিক নিজের জায়গায় এসে বসে।
"চিনি মানে? ওর মত হাড় বজ্জাত আর একটাও আছে নাকি এই গ্রামে?"
ঢোকটা গিলতে গিয়েও মাঝ পথে আটকে যায় ফটিকের। বিষম খেয়ে বলে, "উনি নিজের স্ত্রী ও মেয়ের জন্য নাম লিখিয়ে গেলেন। আগামী শুক্রবার সকালে।"
"ন্যাপলার আবার স্ত্রী-কন্যা কবে হল? ব্যাটা বিয়েই করেনি।"
জোড়ালো একটা বিষম খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় ফটিক।
"তার মানে?"
দম আটকে প্রায় পাঁচ মিনিট ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে, ধুনো দিয়ে চেম্বার থেকে বাইরে আসে ফটিক। তারপরে মিনিট পনেরো অপেক্ষা করে আবার চেম্বারে ঢোকে। আগত ব্যক্তি রুগী না পর্যটক সে বিষয়ে এখনো কিছু জানে না ফটিক। কিন্তু আগন্তুকও পিছুপিছু চেম্বারে এসে ঢোকে। নিজের সাধ করে বানানো কাঠের চেয়ারে গিয়ে বেশ সাহেবি কেতায় বসে গলা খাঁকড়িয়ে নিয়ে আগন্তুককে বসতে বলে। আগত ব্যক্তি তখন চেম্বারের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষনে ব্যস্ত। ডাক্তারবাবু বসতে বলায় ছোট্ট করে নমস্কার ঠুকে রুগী বসার একটা টুল নিয়ে টেবিলের সামনে এসে বসে।
"বেড়ে সাজিয়েছেন কিন্তু আপনার ডিস্পেন্সারি। নাহ! এ'জিনিস এই তল্লাটে কেউ দেখেনি।"
"তা আমার যা সাধ্য, সেই মতোই সাজিয়েছি। অতিরিক্ত কিছু নেই।" ব্যাগ থেকে প্রেসক্রিপসন প্যাড আর কলম বার করতে করতে বলে ফটিক।
"না না। তাও যেভাবে সাজিয়েছেন, ক'টা ডাক্তার পারে?"
"হে হে!! ধন্যবাদ। বলুন। কি সমস্যা আপনার?"
আগন্তুক এবার যেন প্রশংসা থেকে বিরত হওয়ার সময় এসেছে বুঝে যায়। একটু থেমে বলেন।
"আজ্ঞে সমস্যা ঠিক আমার নয় ডাক্তারবাবু। আমার মেয়ের।"
"কি ব্যাপার?" ফটিক উৎসাহিত হয়।
"প্রায়ই বলছে, দাঁত মাজতে গেলে নাকি মাড়ি দিয়ে রক্ত আসছে। কি করা যায় বলুন দেখি?"
"বেশ তো, মেয়ে কে নিয়ে চলে আসুন। দেখে নিচ্ছি।"
একটু যেন বিপাকে পরেন আগন্তুক ভদ্রলোক। ক্ষণিক বিরতি নিয়ে বলেন,
"তাকে এখন পাই কোথায় বলুন? সে তো এখন কলেজে। কাল কি আপনি বসেন? তাহলে আমি তাকে নিয়ে আসব।"
"আমি তো এখানে সপ্তাহে দু'দিন বসি। আমি আবার আসব শুক্রবার। সেদিন নিয়ে আসবেন নাহয়।"
"ওরে বাবা! তাহলে এই ক'দিন রক্ত আসলে কি করব?"
ফটিক যেন একটু বিপাকে পরে যায়। সত্যি তো। একজনের সমস্যা জেনেও সে কোন উপকার না করে, শুক্রবার অব্দি অপেক্ষা করবে? মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। ভদ্রলোকটিকে দেখেই মায়া হয়। মাথার ওপর পরিপাটি টাক, উপরের পাটির সামনের দাঁতের অগ্রদূত মূর্তি গোফের আড়ালে লোকানো ভাবাবেগ মিশ্রিত হাসির উজান এনে দেয় যেন। কি মনে হল, ব্যাগ থেকে একটা মলম আর কুলকুচির ওষুধ বেড় করে টেবিলের ওপরে রাখে ফটিক।
"এই মলম নিয়ে যান। মেয়েকে বলুন নিয়ম করে, দু'বেলা মাড়িতে মালিশ করতে। আর প্রতিবার খাওয়ার পরে এই কুলকুচির ওষুধ দিয়ে কুলি করতে। শুক্রবার আমি দেখি। তারপর নাহয় কিছু একটা ব্যবস্থা করা যাবে।"
ওষুধগুলি হাতে নিয়ে আগন্তুক আবার বলে ওঠে।
"আমার স্ত্রীরও জানেন তো দাঁতের সমস্যা। এত অযত্ন করে, কি আর বলব। পিছনের মাড়িতে একটি দাঁত ও অবশিষ্ট নেই। সব কটির গোড়া পরে আছে। এখন তো প্রায়ই শুনি মাড়ি ফুলে ওঠে নাকি।"
ফটিক আরো খানিকটা আহল্লাদিত হয়ে ব্যাগের ভিতর হাত দেয়।
"দাঁতের গোড়া পরে থাকা খুব একটা ভালো জিনিস তো নয়। এক কাজ করুন না। শুক্রবার আপনার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে আসুন। এই ওষুধগুলি নিয়ে যান। আজ থেকে খাওয়ানো শুরু করলে আমি শুক্রবার দাঁত কিছু তুলেও দিতে পারব তাহলে।"
দু'পাতা ওষুধ পকেটে ভরে পেন্নাম ঠুকে উঠে পড়েন আগন্তুক। "আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো ডাক্তারবাবু। আচ্ছা আজ আসি তাহলে, শুক্রবার দেখা হচ্ছে।"
"ওষুধগুলোর দামটা একটু দিতে হত।" পিছু ডেকে ফেলে ফটিক।
আগন্তুক ফিরে আসেন। "ওবাবা! এগুলোর দাম আছে নাকি?"
"আজ্ঞে হা! এগুলো বিক্রির ওষুধ।"
"আমি তো আমার ভগ্নিপতির কাছে আপনার সুখ্যাত শুনে খবর নিতে এসেছিলাম ডাক্তারবাবু। টাকা-পয়সা তো সঙ্গে আনিনি। শুক্রবার এগুলোর দাম দিলে হবেনা? নইলে আপনি রেখে দিন, আমি শুক্রবার এসে নিয়ে যাবো।"
ভারি লজ্জায় পরে যায় ফটিক। "আরে না না। পরদিন আসুন, একেবারেই দিয়ে দেবেন নাহয়।"
অনেক আশীর্বাদ ও ধন্যবাদ জানিয়ে সকালের আগন্তুক বিদায় নেয়। শুক্রবার সকালের জন্যে দু'টো রুগী পেয়ে মনটা আনন্দে নেচে নেচে উঠল যেন। শুক্রবার কি কি করবে সেইসব ভেবে ঠাকুরের ছবির দিকে তাকিয়ে পাঁচশ বাতাসা মানত করে ফেলে ফটিক।
//৩//
"ন্যাপলা এখানে কি করতে এসেছিল?"
ঠাকুরের ছবির পানে তাকিয়ে চোখে জল এসে গেছিল ফটিকের প্রায়। গোটা মাস যে রুগীর জন্যে অপেক্ষা করতে হয়, একদিনের সকালেই দুটো রুগীর বরাত পাওয়া কি মুখের কথা? ভগবানের অসীম কৃপা ছাড়া কিই বা হতে পারে? এ'সব ভাবের ঘোরে আচ্ছন্ন অবস্থায় হঠাৎ নিজের ঘরে কারো কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে ফটিক।
"কে? কে এসেছিল?" ফটিক দরজার দিকে তাকায়। ঠাকুরকে আরো কিছু উপঢৌকন মানত করেই ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু মাঝ পথে বাধা পরে।
"ন্যাপলা। ন্যাপলা কি করতে এসেছিল তোমার চেম্বারে? বেরোতে দেখলাম মনে হল?" তামীম শেখ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসেন। এক কালে এখানকার নাম করা হাতুড়ে ডাক্তার ছিলেন। ফটিক এর যুবা বয়সের মেহনত দেখে মাঝে মধ্যে আড্ডা মারতে আসেন। এখানকার ইতিহাসের গল্প করেন। রুগী না থাকলেও, তামীম শেখের সাথে গপ্প করে আর হুঁকো টেনে সময় যেত ভালো।
"আপনি ওনাকে চেনেন নাকি?" ফটিক নিজের জায়গায় এসে বসে।
"চিনি মানে? ওর মত হাড় বজ্জাত আর একটাও আছে নাকি এই গ্রামে?"
ঢোকটা গিলতে গিয়েও মাঝ পথে আটকে যায় ফটিকের। বিষম খেয়ে বলে, "উনি নিজের স্ত্রী ও মেয়ের জন্য নাম লিখিয়ে গেলেন। আগামী শুক্রবার সকালে।"
"ন্যাপলার আবার স্ত্রী-কন্যা কবে হল? ব্যাটা বিয়েই করেনি।"
জোড়ালো একটা বিষম খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় ফটিক।
"তার মানে?"
//৪//
রবিবার করে চৈতন্যপুর বলে এক মফস্বলে চেম্বার করতে যায় ফটিক। শনিবার রাতে চলে আসে। পরদিন চেম্বার করে বিকেলের ফেরীতে বাড়ি যায়। কলকাতা থেকে সময় লাগে প্রায় ছ'ঘন্টা। Diamond harbor road ধরে প্রথমে আসতে হয় রায়চক। সেখান থেকে ফেরীতে নদী পেরিয়ে কুঁকড়াহাটি। কুঁকড়াহাটি থেকে বাসে এক ঘন্টা গেলে চৈতন্যপুর। শনিবার বেহালার চেম্বার থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে যায়। মালিকের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। ফটিক আবার নিমন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়া একদম পছন্দ করে না। সে যত কাজই থাকুক, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ঠিক পৌঁছে যাবে। আর যাই হোক, খাবারের প্রতি অভক্তি করা চলে না।
রায়চক আসার পথে সুখের ঢেকুর তুলতে তুলতে দুপুরের আয়োজনের কথা ভাবছিলো সে। খেয়ে-দেয়ে উঠেই চলে আসায় বিশ্রাম হয়নি ঠিক। তাই একটু আইঢাই করছে। ফেরী পার করে, কুঁকড়াহাটি পৌঁছে একটা সিগারেট খেয়ে নেবে। শেষ বাস সাড়ে সাতটায়। পরিকল্পনাগুলো আরেকবার সাজিয়ে নিয়ে চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে উপভোগ করতে থাকে। কি সুন্দর এখানের সব কিছু। ধানের ক্ষেত, সর্ষের ক্ষেত , কুড়ে ঘর। পুকুর ভর্তি পদ্ম, শালুক ফুটে রয়েছে। একটা গাছের ডালে অনেকগুলো বক বসে আছে। অবাক পৃথিবীর অবাক শোভায় মগ্ন হয়ে যায় ফটিক। দুপুরের অমন খাওয়া, তারপর গতিমান বাসের জানলা দিয়ে প্রকৃতির রূপ। চোখে ঘুম নেমে আসে ফটিকের।
ঘুম ভাঙলো মাথায় কিছু পড়ায়। ওপরের বাংক থেকে কারো জলের বোতল গড়িয়ে বাসের ঝাকুনি আর অভিকর্ষের টানে সরাসরি অবতরণ করে ফটিকের মাথায়। সবে তখন ফটিকের সংকীর্ণ নাসা পথে নির্গত বাতাস, তরুণাস্থির কম্পনে আন্দোলিত হয়ে গুরু গম্ভীর নিনাদ সুর সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। স্বপ্নের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে সে দেখছিলো, গ্রামের পঞ্চায়েত তাকে সম্মবর্ধনা দিচ্ছে। ভাষণ দিচ্ছেন ফটিকের মহানুভবতা নিয়ে। দুম করে মাথার ওপর কিছু একটা পরে ঘুম ভেঙে গেলেও, হাত তালি দিয়ে ওঠে সে। একটু হুঁশ ফিরতে পাশে বসা সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়। মাথার আঘাতটাও টের পায়। বেশ টনটন করছে একটা জায়গা। কিন্তু বলার বা করবার মত কিছু না পেয়ে, জলের বোতলটা পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে সহযাত্রীকে ফেরত দেয়। স্বপ্নটা বড় ভালো ছিল, কিন্তু ঘুমটা আর আসলো না।
বাস থেকে নেমেই সবাই দৌড় দেয় ফেরীর টিকিট কাটার জন্যে। ফটিক এখন আর দৌড়ায় না। একটু সংযত হচ্ছে আজকাল। মা-এর নিষেধ ও রয়েছে। কাজেই ধীরে সুস্থে নিজের ব্যাগ নিয়ে টিকিট কাউন্টারে এসে দাঁড়ায়। টিকিট হাতে পাওয়ার পর ঘাটের কাছ থেকে 'ভোঁ আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে সাতটার ফেরী রওনা দিচ্ছে। এখন দেরি করলে সত্যি সর্বনাশ। ওপারে ঠিক সময় না পৌঁছালে বাস বেরিয়ে যাবে। আর শেষ বাস বেরিয়ে যাওয়া মানে পদযাত্রা ছাড়া গতি নেই।
ভরপেট খেয়ে এমন দৌড় দেওয়া সত্যি কষ্টের। ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে যখন ফেরীর কাছে পৌছালো, জেটি থেকে তখন একহাত দূরে vessel . সব বিপদের থেকেও বড় বিপদ বাস না পাওয়া। সুবিধা বুঝে লাফ দিলো ফটিক। vessel এ উপস্থিত যাত্রীরা দেখল সেই কালজয়ী লাফ। হনুমান যেমন সাগর পেরিয়ে লঙ্কা পৌঁছে ছিল। ফটিকের অভিব্যক্তিও খানিকটা সেরকম। ফেরীর rod এ গিয়ে ধাক্কা খেতে কোৎ করে একটা শব্দ আসে ফটিকের মুখ থেকে। ব্যাগের ভারে আরেকটু হলেই জলে পরে যেত ফটিক, কিন্তু কিছু সহকারীর সাহায্যে সে যাত্রা আর কোন বিপদ ঘটেনি। কেবল একটা টিফিন এর ব্যাগ ধাক্কা সামলাতে না পেরে জলে পরে গেল।
পারে উঠে টিকিট দেখিয়ে বাইরে আসতে চৈতন্যপুর লেখা বাস সামনেই দাঁড়ানো দেখে নিশ্চিন্ত হয় ফটিক। বাসের কাছে গিয়ে ফাঁকা বাস দেখে মনটা আরো প্রফুল্য হয়। এতটা পথের ধকলে বেশ খাটনি গেছে। এদিকে সিগারেট খাওয়া হয়নি অনেক্ষন। ফাঁকা বাস দেখে নিশ্চিন্ত ছিল ফটিক, না ভরলে তো আর ছাড়বে না। সেই ফাঁকে বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোয়া দেওয়া যাক। একটা সিগারেট ধরিয়ে চা দোকানে ঢোকে ফটিক। নজর রাখে বাসের দিকে। লোক উঠতে শুরু করলেই, ছুটতে হবে। চা-বিস্কুট পর্ব শেষ করে একটু প্রয়োজনীয় কর্মের তাগিদে, চা দোকানের পিছনে যায় ফটিক। ফিরে এসে চায়ের দাম মিটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কি ব্যাপার? আজ চৈতন্যপুরের বাসে ভিড় নেই?"
"কি বলছেন দাদা, ঐদিকে একবার চেয়ে দেখুন?" চা দোকানি পয়সা ফেরত দিয়ে বলে।
বড় রাস্তার কাছে উপচে পরা ভিড় নিয়ে একটা বাস এগিয়ে যাচ্ছে। ফটিকের সব হিসেবে গোলমাল হয়ে যায়।
"তাহলে এই বাস টা কোথাকার?"
"এটাতো কাল সকালের ফাস্ট বাস। ঐদিকে আজকের শেষ বাস বেরিয়ে গেলো তো।"
দোকানির কথাগুলো বজ্রাঘাতের চেয়েও নির্মম বলে মনে হয়। ব্যাগ নিয়ে আবার দৌড় দিতে হয় ধোয়া উড়িয়ে চলে যাওয়া বাসের পিছনে। ফটিকের এই দন্ত-বিহঙ্গ জীবনের আরেকটি অধ্যায় রচনা হয় ধুলো মাখা পথের ধারে চৈতন্যপুরগামী বাসের পশ্চাৎ ধাবনে।
রবিবার করে চৈতন্যপুর বলে এক মফস্বলে চেম্বার করতে যায় ফটিক। শনিবার রাতে চলে আসে। পরদিন চেম্বার করে বিকেলের ফেরীতে বাড়ি যায়। কলকাতা থেকে সময় লাগে প্রায় ছ'ঘন্টা। Diamond harbor road ধরে প্রথমে আসতে হয় রায়চক। সেখান থেকে ফেরীতে নদী পেরিয়ে কুঁকড়াহাটি। কুঁকড়াহাটি থেকে বাসে এক ঘন্টা গেলে চৈতন্যপুর। শনিবার বেহালার চেম্বার থেকে বেরোতে একটু দেরী হয়ে যায়। মালিকের বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে একটু খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন ছিল। ফটিক আবার নিমন্ত্রণ এড়িয়ে যাওয়া একদম পছন্দ করে না। সে যত কাজই থাকুক, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে ঠিক পৌঁছে যাবে। আর যাই হোক, খাবারের প্রতি অভক্তি করা চলে না।
রায়চক আসার পথে সুখের ঢেকুর তুলতে তুলতে দুপুরের আয়োজনের কথা ভাবছিলো সে। খেয়ে-দেয়ে উঠেই চলে আসায় বিশ্রাম হয়নি ঠিক। তাই একটু আইঢাই করছে। ফেরী পার করে, কুঁকড়াহাটি পৌঁছে একটা সিগারেট খেয়ে নেবে। শেষ বাস সাড়ে সাতটায়। পরিকল্পনাগুলো আরেকবার সাজিয়ে নিয়ে চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে পেরিয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে উপভোগ করতে থাকে। কি সুন্দর এখানের সব কিছু। ধানের ক্ষেত, সর্ষের ক্ষেত , কুড়ে ঘর। পুকুর ভর্তি পদ্ম, শালুক ফুটে রয়েছে। একটা গাছের ডালে অনেকগুলো বক বসে আছে। অবাক পৃথিবীর অবাক শোভায় মগ্ন হয়ে যায় ফটিক। দুপুরের অমন খাওয়া, তারপর গতিমান বাসের জানলা দিয়ে প্রকৃতির রূপ। চোখে ঘুম নেমে আসে ফটিকের।
ঘুম ভাঙলো মাথায় কিছু পড়ায়। ওপরের বাংক থেকে কারো জলের বোতল গড়িয়ে বাসের ঝাকুনি আর অভিকর্ষের টানে সরাসরি অবতরণ করে ফটিকের মাথায়। সবে তখন ফটিকের সংকীর্ণ নাসা পথে নির্গত বাতাস, তরুণাস্থির কম্পনে আন্দোলিত হয়ে গুরু গম্ভীর নিনাদ সুর সৃষ্টি করতে শুরু করেছে। স্বপ্নের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে সে দেখছিলো, গ্রামের পঞ্চায়েত তাকে সম্মবর্ধনা দিচ্ছে। ভাষণ দিচ্ছেন ফটিকের মহানুভবতা নিয়ে। দুম করে মাথার ওপর কিছু একটা পরে ঘুম ভেঙে গেলেও, হাত তালি দিয়ে ওঠে সে। একটু হুঁশ ফিরতে পাশে বসা সহযাত্রীর দিকে তাকিয়ে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হয়। মাথার আঘাতটাও টের পায়। বেশ টনটন করছে একটা জায়গা। কিন্তু বলার বা করবার মত কিছু না পেয়ে, জলের বোতলটা পায়ের কাছ থেকে কুড়িয়ে সহযাত্রীকে ফেরত দেয়। স্বপ্নটা বড় ভালো ছিল, কিন্তু ঘুমটা আর আসলো না।
বাস থেকে নেমেই সবাই দৌড় দেয় ফেরীর টিকিট কাটার জন্যে। ফটিক এখন আর দৌড়ায় না। একটু সংযত হচ্ছে আজকাল। মা-এর নিষেধ ও রয়েছে। কাজেই ধীরে সুস্থে নিজের ব্যাগ নিয়ে টিকিট কাউন্টারে এসে দাঁড়ায়। টিকিট হাতে পাওয়ার পর ঘাটের কাছ থেকে 'ভোঁ আওয়াজ শুনে বুঝতে পারে সাতটার ফেরী রওনা দিচ্ছে। এখন দেরি করলে সত্যি সর্বনাশ। ওপারে ঠিক সময় না পৌঁছালে বাস বেরিয়ে যাবে। আর শেষ বাস বেরিয়ে যাওয়া মানে পদযাত্রা ছাড়া গতি নেই।
ভরপেট খেয়ে এমন দৌড় দেওয়া সত্যি কষ্টের। ব্যাগপত্তর নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে যখন ফেরীর কাছে পৌছালো, জেটি থেকে তখন একহাত দূরে vessel . সব বিপদের থেকেও বড় বিপদ বাস না পাওয়া। সুবিধা বুঝে লাফ দিলো ফটিক। vessel এ উপস্থিত যাত্রীরা দেখল সেই কালজয়ী লাফ। হনুমান যেমন সাগর পেরিয়ে লঙ্কা পৌঁছে ছিল। ফটিকের অভিব্যক্তিও খানিকটা সেরকম। ফেরীর rod এ গিয়ে ধাক্কা খেতে কোৎ করে একটা শব্দ আসে ফটিকের মুখ থেকে। ব্যাগের ভারে আরেকটু হলেই জলে পরে যেত ফটিক, কিন্তু কিছু সহকারীর সাহায্যে সে যাত্রা আর কোন বিপদ ঘটেনি। কেবল একটা টিফিন এর ব্যাগ ধাক্কা সামলাতে না পেরে জলে পরে গেল।
পারে উঠে টিকিট দেখিয়ে বাইরে আসতে চৈতন্যপুর লেখা বাস সামনেই দাঁড়ানো দেখে নিশ্চিন্ত হয় ফটিক। বাসের কাছে গিয়ে ফাঁকা বাস দেখে মনটা আরো প্রফুল্য হয়। এতটা পথের ধকলে বেশ খাটনি গেছে। এদিকে সিগারেট খাওয়া হয়নি অনেক্ষন। ফাঁকা বাস দেখে নিশ্চিন্ত ছিল ফটিক, না ভরলে তো আর ছাড়বে না। সেই ফাঁকে বুদ্ধির গোড়ায় একটু ধোয়া দেওয়া যাক। একটা সিগারেট ধরিয়ে চা দোকানে ঢোকে ফটিক। নজর রাখে বাসের দিকে। লোক উঠতে শুরু করলেই, ছুটতে হবে। চা-বিস্কুট পর্ব শেষ করে একটু প্রয়োজনীয় কর্মের তাগিদে, চা দোকানের পিছনে যায় ফটিক। ফিরে এসে চায়ের দাম মিটিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"কি ব্যাপার? আজ চৈতন্যপুরের বাসে ভিড় নেই?"
"কি বলছেন দাদা, ঐদিকে একবার চেয়ে দেখুন?" চা দোকানি পয়সা ফেরত দিয়ে বলে।
বড় রাস্তার কাছে উপচে পরা ভিড় নিয়ে একটা বাস এগিয়ে যাচ্ছে। ফটিকের সব হিসেবে গোলমাল হয়ে যায়।
"তাহলে এই বাস টা কোথাকার?"
"এটাতো কাল সকালের ফাস্ট বাস। ঐদিকে আজকের শেষ বাস বেরিয়ে গেলো তো।"
দোকানির কথাগুলো বজ্রাঘাতের চেয়েও নির্মম বলে মনে হয়। ব্যাগ নিয়ে আবার দৌড় দিতে হয় ধোয়া উড়িয়ে চলে যাওয়া বাসের পিছনে। ফটিকের এই দন্ত-বিহঙ্গ জীবনের আরেকটি অধ্যায় রচনা হয় ধুলো মাখা পথের ধারে চৈতন্যপুরগামী বাসের পশ্চাৎ ধাবনে।
১১টি মন্তব্য:
Impressive
Khub sundor hoyeche ... :)
বুদ্ধিদিপ্ত... এবং হাস্যদ্দীপক...খুব সাধারন ঘটনা শিল্পনৈপুন্যে অসাধারন হয়ে ওঠে... বেশ ভালো..
বাঃ!
👍👌
👍👌
Asadharon
���������� তোমার দ্বারাই হবে
Arribuss!! Darun toh!
অর্ক তোমার লেখাটি পড়ে খুবই ভালো লাগলো । সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিখুঁত বিবরণ, ঘটনার পর্যায়ক্রমিকতা, আপাতমধুর বাস্তবতা এবং হাস্যরসের উপাদান... এই সবকিছুর উপস্থিতি রচনাটিকে সমৃদ্ধ করেছে ।
তবে আমি নিজে একজন দন্ত চিকিৎসক হওয়ায়, দন্ত চিকিৎসা এবং সেই সংক্রান্ত হাস্যকর নগ্ন বাস্তবতাগুলো নিয়ে লেখা পড়তে পড়তে আমার মন ক্লান্ত এবং ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে ।
Eta bere Hoyeche vau
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন