বুধবার, ২৭ মে, ২০২০
Pencil Box
মঙ্গলবার, ২৬ মে, ২০২০
COVID situation and Dentistry
আরও কয়েক মাসের বেকারত্ব??
প্রায় দু মাসের ওপর কাজ নেই। নিয়ম মেনে করোনা ভাইরাস সংক্রমনের চেন ভাঙতে স্বেচ্ছায় কর্মহীন দশা। শুধু আমি নয়। হিসেব করে দেখলাম আমার মতই কর্মহীন আরো বহু। সারা বিশ্বে অনেক দাঁতের ডাক্তার শুধু মাত্র ভাইরাস সংক্রমন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই বিরতি নিয়েছিল। কিন্তু ফলশ্রুতি হলো শূন্য। এখন সত্যি আফসোস হয় আগেই সব বন্ধ না করে কাজ করে গেলে এখন বিরতি নেওয়া যেত।সংক্রামিত পরিসংখ্যান এখন ১ লক্ষ ৩২ হাজার। উপসর্গ হীন রোগের বাহকদের কথা তো ছেড়েই দিলাম। সরকার থেকে এখন অনুমতি আসছে ডাক্তাররা চাইলে চেম্বার খুলতে পারেন। আরে মশাই এখন তো বিপদ চোখের সামনেই রয়েছে। কোন নিশ্চয়তা নেই কে যে সংক্রমনের বাহক।
তো কি হয়েছে? তুমি ডাক্তার। রোগ কে তুমি ভয় পাবে?
আরে ধুর মশাই ডাক্তার। এই ডাক্তারিতে একটা কথা আছে। "The goal of medicine is to see its own end and not to create more diseases."
রোগের বিরুদ্ধে সাহস দেখিয়ে চেম্বার খুলে চিকিৎসা করলাম। শেষে নিজেই একজন উপসর্গ হীন বাহক হয়ে আরো চার পাঁচ জন রুগীকে সংক্রমিত করে দিলাম। আজ না হোক কাল সে কথা ধরা পরবেই। তখন নিজের কাছে নিজেই ছোট হয়ে যাবো। এতটাও সরল সোজা রোগ নয় এই করোনা ভাইরাস। ভগবান না করুক কোনদিন, হয়ত আমার নির্বুদ্ধিতায় একজন বৃদ্ধ রুগী সংক্রমিত হয়ে গেলেন চেম্বার থেকে। একই সাথে তাঁকে ও তাঁর পরিবার কে আমি বিপদের দিকে ঠেলে দিলাম। এই বিবেক দংশনের থেকে আমার বেকারত্ব ভালো। দেশে করোনা সংক্রমনের হার এখন ঊর্ধ্বমুখী। কোন বাছ বিচার ছাড়া মানুষ জন একেবারে সাধারন দিনের মতন জীবন কাটাচ্ছে। এতগুলো লোকের চাকরি গেল। এত মানুষের দোকান বন্ধ, মাইনে পাচ্ছে না। দরকারি চিকিৎসার সামগ্রী নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই। এত গুলো লোকের এতটা আত্মত্যাগ পুরোটাই বিফল? একেবারেই বিফল?
এত ভয় পাচ্ছ কেন ভায়া। সরকার থেকে তো নিয়ম বাৎলে দিয়েছে?
নিয়ম?? পড়ে দেখেছেন সেই নিয়ম? ওরে বাবা মানতে গেলে তো আবার সেই নতুন করে চেম্বার শুরুর খরচ। আর নিয়মের কি কোনো স্থিরতা আছে? নিত্য দিন তো সে বদলে চলেছে। ইতিমধ্যে একগাদা টাকা খরচ করে যে সব সামগ্রী কিনলাম। পরের দিন আরেকটা নোটিশে দেখছি ওই দিয়ে কোনো লাভ নেই। তার উপরে আরো কিছু সংযোজন হয়েছে। নিয়মে বলছে চেম্বারের ভিতর দূষিত বাতাস পরিশোধনের যন্ত্র লাগবে। এক একটা যন্ত্রের দাম ৪০-৬০ হাজার টাকা। এই বাজারে এতগুলো টাকা খরচ করে আপনি ভাবছেন বেশ নিশ্চিন্তে এবার চেম্বার করবেন? আরে দাড়ান মশাই কোম্পানির কাগজে একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন। সেখানে স্পষ্ট লিখেছে এই যন্ত্র বাতাস থেকে দূষিত কণা শোষণ করে নিলেও তাকে রহিত করতে পারেনা। আর এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই যে সেই যন্ত্র থেকে দূষিত কণা আবার বাতাসে ফিরে আসবে না। এ আমি পড়াশোনা করেই বলছি না জেনে নয়।
হে হে! তাহলে উপায়? উপায় আছে তো! ওই যন্ত্রের মধ্যে থেকে বেরোনো বাতাস যাতে সংক্রমন বয়ে না আনে তাই জন্যে এই যে; আরেকটি যন্ত্র! এর মাধ্যমে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। চেম্বার তো নয় পুরো যন্তর মন্তর। দালাল যে, তার তো বিক্রী নিয়ে কথা। ডাক্তার বা রুগী বিপদে পরলো কি না পরলো থোড়াই কেয়াড়!
তো ডাক্তারবাবু কিনেই ফেলুন না? কাজ তো করতেই হবে।
নিশ্চই!! একদিন না একদিন তো ফিরতেই হবে। কিন্তু আমার এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এত টাকা খরচের ভরপাই করবে কে? সেই তো আপনাকেই করতে হবে। হিসেব করে দেখলাম সব নিয়ম মেনে চললে, শুধু মাত্র রুগী দেখে ওষুধ দেওয়ার জন্যেই প্রায় ৩৭৪ টাকা খরচ। দেবেন তো এক ধাক্কায় ৪০০ টাকা ভিজিট? বলবেন না তো, "পাড়ার মধ্যে ওইটুকু একটা চেম্বার তাতে ভিজিট ৪০০টাকা? "
এবার আসি তাহলে কাজের কথায়। আরে মশাই যা নিয়মের বহর তাতে একটা নড়বড়ে দাঁত তুলতেই কম বেশি ৬০০ টাকার জিনিস লাগবে। তাহলে ডাক্তারের পারিশ্রমিক? এত যন্ত্রপাতির দাম? ইলেকট্রিক বিল? ডাক্তারি বর্জ্য পদার্থ সঠিক ভাবে নিয়ে যাবে যে তাদের খরচ?? নতুন যে এত সব জিনিস এলো তাদের দাম?
হিসেব করতে করতে কোন সময় যে ১০০০ টাকায় পৌঁছে যাবেন বুঝতেই পারবেন না।
ডাক্তার টা একটা নির্লজ্জ। এই বাজারে সুযোগ বুঝে একটা নড়ে যাওয়া দাঁত তুলে হাজার টাকা নিয়ে নিল।
হে হে! বদনাম হওয়ার এর থেকে ভালো কোন উপায় আছে? তার চাইতে আমি ভীতু ডাক্তার ভালো। দাম কমানোর জন্যে নিয়মের গাফিলতি করে নিজেকে ও আমার রুগীদের বিপদে ফেলতে চাইনা।
এতো ভেবে কোন লাভ আছে? যাদের আসার ঠিক আসবে। টাকা যারা ঠিক মতন দেওয়ার ঠিক টাকা দেবে। এত পরিবর্তন মুখ বুজে মেনে নিয়েছে যারা, এই পরিবর্তনটা নাহয় গালাগালি দিয়ে মেনে নেবে!
ঠিক কথা মশাই। রাতারাতি নোট বন্দীর খবর শুনে ব্যাঙ্কের বাইরে সব থেকে বেশি ভিড় ছিল বয়স্ক মানুষের। আসলে বসেই যখন আছি টেবিলের ওপাশে গিয়ে একবার ভেবে দেখলে ক্ষতি কি? তাই ভেবে দেখছিলাম।
এত কিছু লিখতাম না। কিন্তু আমার মতই যারা রোজ আফসোস করে অথচ মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা। তাদের জন্যেও এই লেখা। চটক, জৌলুস তো দশ শতাংশের হাতে। তাদের কাছে এত বাহুল্য চর্চিত জিনিস কেনা অসম্ভব কিছু না। কিন্তু দিনের শেষে ভাত ডাল আর বিরিয়ানির তফাৎটা সাধারণ মানুষ বোঝে। আমরা সেই পাড়ার ভিতর, ছোট চেম্বার, ভাত ডাল ডাক্তার। আমাদের না আছে website না আছে Google শীর্ষ খ্যাতি। আমাদের কাছে রুগী ফোন করে তার গাড়ি কোথায় park করবে জানতে চায় না। শুধু আমরা চেম্বারে আছি কিনা জানতে চায়। কম খরচের একটা নির্ভরযোগ্য জায়গা ছিলাম। এখন আমরাও নতি স্বীকার করছি এই বিরাট পরিবর্তনের। নতি স্বীকার করছি এই বিশ্বব্যাপী মারণ ভাইরাসের দৌরাত্বে। মাথা নোয়াচ্ছি ডাক্তার হয়েও এই রোগের সামনে।
এই সময় সাহসের সাথে চেম্বার করে বাহাদুরের খেতাব নেওয়ার থেকে নিজের অজ্ঞতা বা অসামর্থ্য ভাব কে মেনে নিয়ে অবসরে থাকা অনেক শ্রেয়। বিবেকের কাছে অন্তত পরিষ্কার থাকবো যে অজান্তে কোন রুগীর ক্ষতি আমি করিনি।
আমার facebook এর দৌরাত্ম্য খুব সীমিত। হয়ত এই দীর্ঘ লেখা কেউ পড়েও দেখবে না। কিন্তু সবার কাছে অনুরোধ একটু নিয়ম মেনে যদি এই রোগের সংক্রমন বন্ধ করা যায়। দয়া করে চেষ্টা করুন। কারেন্ট নেই বলে সবার অসুবিধা হচ্ছে এ কথা আমি অস্বীকার করছিনা। কিন্তু তাই বলে পাড়ার মোড়ে একত্রে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে, লাইনের কাজ দেখার জন্যে ভিড় করে, আপনিও অজান্তে হয়ত রোগ বহন করে আনছেন বাড়িতে। সারা দেশে হঠাৎ এমন রোগাক্রান্ত সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে যদি কারো দোষ থেকে থাকে সেটা আমাদের। আমরাই নিয়ম ভেঙেছি। এখন আমরাই তার ফল ভোগ করছি। এখনো হয়ত সময় আছে ফিরে দাঁড়ানোর। চেষ্টা করে দেখুন যদি এই সংখ্যা নামিয়ে আনা যায়। নইলে যা বুঝছি, তাতে আরো দুমাসের বেকারত্ব অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে।
বুধবার, ২০ মে, ২০২০
A Ragging Case
Ragging
Ragging শব্দটি তখনো খুব একটা প্রচলিত শব্দ নয়। কলেজে আসা মানে, বিশেষ করে পলিটেকনিক বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আসা মানে আধুনিক ragging এর থেকে কয়েকশ গুণ বেশি পরিমাণে ছাত্র ছাত্রীদের অত্যাচার করা হত। আমি নিজেই থার্ড ইয়ারে এসে কলজে সব নতুন ছাত্রদের কাছে ত্রাস ছিলাম। কলেজের হোস্টেলের সামনে আমায় দেখতে পেলে কোন জুনিয়ার ভিতরে যাওয়ার সাহস পেত না। যদি তাদের কাছে কোন খাবার থাকতো, তাহলে সেটা ওখানেই দিয়ে যেতে হতো। এখনো আসিফ বলে আমার এক জুনিয়ার আমাকে ভয় পায়। ওর সদ্য কিনে আনা ২কেজি জিলিপি আমি ও আমার দুষ্কর্মের সাথীরা মিলে খেয়ে নিয়েছিলাম।
আমার সঙ্গী সাথী বলতে আমরা চার জন। কল্যাণ, আশিক, ব্রজ মোহন আর আমি সুরজিৎ।
কলেজের হোস্টেলে ফেরার একটা শর্ট কাট রাস্তা ছিল। আমাদের হোস্টেল থেকে প্রায় ৪ কিমি দূরে একটি ছোট চৌক মতন ছিল। নদীর পাড়ে সেখানে প্রতি মঙ্গলবার হাট বসতো। আলুর চপ, মোচার চপ থেকে শুরু করে সিঙ্গারা জিলিপি, পেটাই পরোটা। কি না খাওয়া যেত সেদিন। তো সেরকম এক মঙ্গলবার আমরা চার বন্ধু মিলে হাটে গেছি। যথারীতি নিজেদের মতন করে হাসি মজায় সময় কাটিয়ে সন্ধ্যের পর ফেরার পথ ধরেছি। এবার এখানেই সেই শর্ট কাট রাস্তার গল্প। পাকা রাস্তা ধরে হোস্টেল ফিরতে হলে ৪কিমি পথ। কিন্তু কিছুদূর পাকা রাস্তা ধরে গিয়ে নদীর বাঁধ বরাবর ঢাল দিয়ে নেমে গেলে একটি পুরোনো কবরস্থান। সেখান থেকে সোজা হাঁটলে হোস্টেলের দূরত্ব প্রায় অর্ধেক কমে যায়। প্রথমত রাস্তা নেই এখানে কোনো। দ্বিতীয়ত কবর স্থান বলে সবাই একে এড়িয়ে চলত। কিন্তু আমরা চারজন এই রাস্তা কে বহুবার ব্যবহার করেছি বলে কোন ব্যাপার নয়। তো সেদিন ও দিব্য ফিরছি ওই পথ ধরে। কিছুদূর আসার পর মনে হল কারা যেন আমাদের পিছন পিছন আসছে। ভূত বা ভয় সম্পর্কে আলাপ ছিল না বলে পিছন ফিরে ছায়া মূর্তি দেখতে পেয়েই একটা হাঁক দিলাম। আমার বাজখাঁই গলা শুনে দেখলাম ছায়া মূর্তি সামনে এসে দাঁড়ালো। ফার্স্ট ইয়ারের দুই ছাত্র সুদীপ্ত আর অর্ণব। আমি সবে ধমক দিতে যাবো ওরা কেঁদে ফেলল।
"দেরী হয়ে গিয়েছিল দাদা খেতে খেতে। তাই শেষ বাস মিস করেছি। হাট এর মধ্যে তোমাদের দেখতে পেয়ে ভাবলাম অপেক্ষা করে যাই। তোমরা কিভাবে ফেরো সেই ভাবে ফিরে আসবো। ভুল হয়ে গেছে দাদা।"
কবর স্থানে আর হুজ্জুতি করলাম না। কিন্তু এদের দুজনকে রোগড়ানোর একটা ইচ্ছে আপনার মনে খেলা করতে শুরু করে দিয়েছে তখন। কবর স্থান প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় সুদীপ্ত নামের জুনিয়ার বললে।
"তোমরা এগোতে থাকো। আমি একটু বাথরুম করে আসছি। খুব চাপ এসে গেছে।"
সুদীপ্তর বন্ধু ওকে বাধা দিতে গিয়েছিল, কিন্তু আমার মনে ততক্ষণে যা বুদ্ধি খেলার শুরু হয়ে গেছে।
আমরা ধিমি তালে একটু একটু করে এগিয়ে গেছি। সুদীপ্ত একটা গাছের আড়ালে গিয়ে নিজের কাজ সেরে দৌড় দিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলো। হোস্টেল অব্দি কোনো কথা বলিনি। হোস্টেলে ঢোকার ঠিক আগে সুদীপ্ত কে বললাম,
"আচ্ছা!! তুই যেখানে হিসু করলি। সেখানে কোনো কবর ছিল না তো??"
"কবর? কই না তো! দেখিনি তো।"
"দেখিস বাবা। এসব হলো গোড়া সাহেবদের কবর। এদের কবরে দাড়িয়ে বাথরুম করলে নাকি শুনেছি বাথরুম আটকে যায়।"
কল্যাণ আর আশিক আমার মতলবটা ধরে ফেলেছিল। তারাও সুরে সুর যোগ দিলো। মোট কথা একজনের মাথায় ভয় ঢোকানোর জন্যে যে টুকু অভিনয় প্রয়োজন তার কিছুই বাদ দিলাম না। সুদীপ্ত আর অর্ণব কে ভালো করে বুঝিয়ে দিলাম যে এই কথা যেন রাষ্ট্র না হয়। হিন্দুর ছেলে হয়ে খ্রিস্টানদের কবরে গিয়ে বাথরুম করে এসেছে, এমন খবর লোকে জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। দুই জুনিয়ার এর মাথায় বেশ করে বীজমন্ত্র রোপন করে আমরা যে যার হোস্টেলে ফিরে এলাম।
কিছু কিছু ঘটনা সত্যি হয়ে যায় নাকি আমাদের মানসিকতায় জিনিসটা সত্যি রূপ নেয়ে তা জানিনা। কিন্তু সত্যি সত্যি সুদীপ্তর সেই রাত থেকে আর বাথরুম হয়নি। পরেরদিন দুপুর থেকে তার পেট ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। কল্যাণ হেসে ফেলে সত্যি কথা বলে ফেলেছিল প্রায়, কিন্তু আমি বাধা দিলাম। এইটুকু বুঝেছিলাম যে ভয় পাওয়ার কারণে সুদীপ্তর এই দশা। কিন্তু ডাক্তার বদ্যি করার বদলে আমার মনে হলো সেই "ভয়ের উপর আরেকটি ভ প্রয়োগের" কথা। তো যেমন ভাবা তেমন কাজ। অনেক ভেবে মনে করার চেষ্টা করছি এমন অভিনয় করলাম খানিক। তারপরে মনে পরে গেছে এমন একটা ভান করে বললাম।
"আমি এক সাহেবের মুখে এই ঘটনার কথা শুনেই কাল অমন বললাম। আসলে আগে মনে পরলে আগেই বলে দিতাম ভাই। কিন্তু কি জানি কেন একটা শঙ্কা কাজ করলেও তোকে আটকানোর কোনো যুক্তি না বুঝে আমি আর বলিনি।"
"এবার আমার কি হবে দাদা? আমি কি মরে যাবো তবে?? আমার যে খুব পেট ব্যথা করছে।"
সুদীপ্ত প্রায় কেঁদে ফেলে।
"তুই জল খেয়েচিস আজ সারাদিন?"
"হ্যাঁ দাদা খেয়েছি। কিন্তু খুব অল্প।"
"বেশ! আজ ঠিক রাত সাড়ে দশটা নাগাদ খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে বেশ খানিকটা জল খাবি। তারপর হোস্টেলের বাইরে অপেক্ষা করবি। তোকে জ্যান্ত কবর দিতে হবে"
"কি বলছ কি?" সুদীপ্ত প্রায় সেখানেই অজ্ঞান হয়। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললুম,
"আরে না না। স্রেফ গলা অব্দি কবর দেবো। এটা সেই সাহেবের থেকেই শেখা। অর্ধেক কবর দিলেই যে মাটি তে তুই বাথরুম করেছিস। সেই জমি তোকে ক্ষমা করে দেবে। আর তুই আবার সব ঠিক ভাবে করতে পারবি।"
কল্যাণ আর আশিক অবাক হয়ে আমার কথা গুলো গিলে গেল। জীবনের শেষ বয়সে এসে যখন কলেজের দিন গুলো মনে পড়ত। আমি নিজেও অবাক হতাম এইসব বুদ্ধি আসতো কি করে ভেবে।
তো যা হোক সন্ধ্যে থাকতে থাকতে আমি আর কল্যাণ গিয়ে কবরস্থান ঘুরে এলাম। কোনো পাহারাদার বা কেউ থাকলে তাকে আগে হাত করতে হবে। আচমকা অমন জ্যান্ত মানুষ কবর দিতে দেখলে থানা পুলিশ হবেই। কাজেই সব সামলে নেওয়া ভালো। অনেক খুঁজেও কোনো লোককে দেখতে না পেয়ে আমরা কবরস্থান টা একবার পরীক্ষা করে দেখলাম। নদীর পাড়ের দিকে, অর্থাৎ পশ্চিম দিকের প্রান্তে দেখলাম দুটো কবর যেন খোড়া আছে। হয়ত আগে থেকে খুড়ে রেখে দেওয়া হয়। সেটা আর পরীক্ষা করে না দেখে মোটামুটি দুজন একটা ছক কষে ঘটনার যাবতীয় সব ব্যবস্থা ভেবে রাখলাম। আসল উদ্দেশ্য ছিল, সুদীপ্ত ভয় পেয়ে এমন হয়েছে। আরেকবার একটু ভালো রকম ভয় দেখালে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই ভেবে গোটা ঘটনার পরিকল্পনা করা।
দেখতে দেখতে রাত নেমে এলো। সুদীপ্ত তখন পেট ব্যথায় চঞ্চল হয়ে গেছে। পূর্ণিমা আসতে এখনো দুদিন।কিন্তু আকাশে চাঁদের আলো বেশ পরিষ্কার। অতএব কাজ করতে অসুবিধা হবে না। টর্চ, দরি, বড়ো দুটো লাঠি আর এক বোতল জল সঙ্গে করে আমরা রওনা দিলাম। সুদীপ্ত যে এমন ভাবে আমাদের কথায় সায় দিয়ে যাবে, সত্যি বলতে আমরাও ভাবিনি। কিন্তু বেটা এতই ভয় পাচ্ছে যে, যা বলেছি করে গেছে। সন্ধ্যে বেলা নির্দিষ্ট করে যাওয়া দুটো কবরের কাছে এসে পৌঁছলাম। ব্রজমোহন কুস্তি করে। কাজেই তার অনেক জোর বলে আগে তাকেই কবরে নামিয়ে দেওয়া হলো। একটা কবরের যে এতটা গভীরতা হয় চোখে দেখলে আন্দাজ পাওয়া যায়না। ব্রজমোহন এর প্রায় কাঁধ অব্দি গভীর কবর। মানে প্রায় এক মানুষ। পাছে ভয় পেয়ে সুদীপ্ত কান্না কটি করে তাই আগেই ওকে বুঝিয়ে বলেছিলাম মুখ বেঁধে দেওয়ার কথা। করাও হলো তাই। পাছে ছটফট না করে তাই দরি দিয়ে হাত পা বাধা হলো। আমি, কল্যাণ আর আশিক মিলে আস্তে আস্তে সুদীপ্তর হাত পা বাঁধা শরীরটা কে নামিয়ে দিলাম। ব্রজমোহন কবরের মধ্যে সুদীপ্ত কে ঠিক ভাবে রাখার চেষ্টা করছিল, যাতে গলা অব্দি ওকে কবর দেওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ আকাশ কালো করে মেঘ ঢেকে ফেলল। চারদিকে যেন প্রলয়ের মতন ঝড় ঝঞ্ঝা ধেয়ে এলো। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় নিমেষে আমরা সবাই কাক ভেজা ভিজে গেলাম। হঠাৎ আবহাওয়ার এমন পরিবর্তনে সব ব্যবস্থা ভুলে সুদীপ্ত কে তুলে নিয়ে হাসপাতাল যাবো কিনা ভাবছি। এমন সময় ব্রজমোহন স্থবির এর মতন হয়ে গেল।
ব্রজমোহন কবরের বাইরে থেকে মাটি নিয়ে সুদীপ্তর হেলান দিয়ে দারানোর মতন একটা ব্যাবস্থা করছিল। কিন্তু হঠাৎ তার থেমে যাওয়ায় আমরাও ঘাবড়ে গেলাম। সুদীপ্ত মুখ বাধা অবস্থায় চিৎকার শুরু করলো। বুঝলাম তার দৃষ্টিও ব্রজমোহন যেদিকে তাকিয়ে আছে সেখানে। আমরা ভেবেছিলাম পুলিশ এসেছে বোধহয়। কিন্তু পিছন ফিরে সেই বৃষ্টির রাতে যে দৃশ্য দেখলাম তার জন্য কেউ কোনদিন প্রস্তুত থাকে না। আমাদের থেকে ঠিক বিশ হাত দূরে একটা কবরের ওপর কেউ যেন বসে আছে আর স্থির দৃষ্টিতে আমাদের কাজ দেখছে। একেই এমন প্রবল বৃষ্টি তার মধ্যে অন্ধকার সব যেন ঝাপসা। আশিক কিছু না বুঝেই সেদিকে টর্চ ফেলতেই দেখলাম একটা মড়া। তার ঘোলাটে আধ বোঝা চোখে আমাদের দিকে দেখছে। বৃষ্টির তেজ যেন ক্রমে আরো বেড়ে গেল। গ্রাম বাংলায় এমন ঝড় যেন বহুযুগ পরে আবার ফিরে এসেছে। কবর স্থানের গাছ গুলো হওয়ার বেগে নুইয়ে পরছে। এমন সময় একটা বাজ পরলো কোথাও যেন। সেই আলোয় দেখলাম মরাটা যেন নরে উঠলো। সেই বিভৎস দৃশ্য দেখে আশিকের হাত থেকে টর্চ পরে গেল। একটা মৃত দেহের মধ্যে এত প্রাণ সঞ্চার কিভাবে হলো!! ব্যাপারটা যেন হজম হচ্ছিলো না। মৃত দেহ তো মৃত দেহই। তার থেকে ভয় কিসের। আমি আর একটু এগিয়ে দেখতে যাবো এমন সময় বেশ কিছু বিদ্যুতের আলো ঝিলিক দিয়ে গেল। আর সেই আলোয় যে দৃশ্য দেখলাম, সে আমার সারা জীবন মনে থাকবে। মৃত দেহটা যেন দুপাশে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে নিজেকে কবর থেকে তোলার চেষ্টা করছে। ধরফর করে পিছনে একটা আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখি ব্রজমোহন সুদীপ্ত কে এমনি ফেলে দিয়েই কবর থেকে উঠে দৌড় দিয়েছে। ব্রজর সাথে সাথে কল্যাণ ও তাই। সুদীপ্ত কবরের মধ্যে পরে গোঙাতে শুরু করেছে। তৃতীয় বার যখন দেখলাম মড়াটা প্রায় আরো খানিকটা উঠে এলো। আমি পিছিয়ে যেতে শুরু করলাম। আশিক ও নিজের হাতের লাঠি ফেলে দৌড় দেওয়ার কথা ভাবছে। পাঁচ সেকেন্ড ও যেন তখন পাঁচ ঘণ্টা। সুদীপ্তর কবরের কাছে পৌঁছে ওকে তুলবো কিনা ভাবছি আরেকটা বিদ্যুৎ ঝলক। আর তার সাপেক্ষে দৃশ্য দেখে আমাদের আর সাহসের সঞ্চয় রইলো না। স্পষ্ট দেখলাম মড়াটা নিজের শরীর কে অনেক টাই কবর থেকে বের করে এনেছে। আর তার মাথাটা দুলছে। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতের ঝিলিক আসছে। আমাদের ভয় দেখিয়ে তার যেন ভারী আমোদ হয়েছে। সেই হাসি দেখে আশিকের আর সাহস ছিল না। হোস্টেল মুখো দৌড় লাগালো সে। আর আমি ঝাঁপ দিলাম সুদীপ্তর কবরে।
অনেকে বলে, কবর স্থানে ভয় পেলে কোনো একটা কবরের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। তাহলে কোনো ক্ষতি হয় না। আমার পাশে তো একটা আস্ত কবর রয়েইছে। কাজেই দিলাম ঝাঁপ। আশিক বোধহয় ভেবেছিলো আমিও দৌড় দেবো। কিন্তু আমাকে না দেখতে পেয়ে সে বেচারা আরো ভয় খেয়ে গেছে। কিছুদূর গিয়ে তার লজ্জা বোধ হতে শুরু করায় আবার ফিরে আসে। আমি ততক্ষণে সুদীপ্তর পায়ের বাধন খুলে দিয়েছি। আশিক আসতেই আমাদের দুজন কে টেনে তুললো। তারপর সেই যে দৌড় দিয়েছিলাম। আর মনে নেই।
পরের দিন সকালবেলা শুনলাম সুদীপ্ত ভালো আছে। কবর থেকে উঠে আসা মড়া দেখেই তার যা বাথরুম হওয়ার প্যান্টে হয়ে গিয়েছিলো। তারপর থেকে আর অসুবিধা হয়নি। ব্রজমোহন বৃষ্টি ভেজার জন্যে সর্দি বাধিয়েছে। আর আশিকের হাঁটু কেটে গেছে। খুব অল্প ক্ষতির মধ্যে দিয়েই আমাদের কবরস্থানের ঝঞ্ঝাট মিটে গেল। এর পরে অবশ্য আমি আর সেই অর্থে ragging করিনি। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে সুদীপ্ত ও আমাদের ragging দলে যোগ দিয়েছিল। আসলে সেদিনের পর থেকে সে আমাদের বেশ প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিল। বেচারা অমন চুপটি করে না থাকলে এমন অভিজ্ঞতা হতো না। এর পরেও আমি অবশ্য ভূতের ভয় দেখিয়েছি। এমনকি এখনো দেখাই অনেক কে। কিন্তু সেই রাতের মতন ঘটনার পুনরাবৃত্তি করার দূরভিসন্ধি কোনদিন আর হয় নি।
(C) পাগলা দাশু।
পরে খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিলাম। অনেক সময় সদ্য কবর দেওয়া মড়া কে শেয়াল কুকুরে মাটি থেকে তুলে আনে। মাটি আলগা থাকে বলে এই কাজে তাদের অসুবিধা হয় না। বৃষ্টি হলে মাটি আরো আলগা হয়ে যায়। ব্যাস! এতেই পোয়া বারো। অন্ধকারে ঠিক দেখতে পাওয়া যায়নি বলে। নইলে নিশ্চই সেই মড়ার ঘেঁটি ধরে শেঁয়াল টানছিলো। আর সেই দৃশ্য দেখেই আমাদের...............
বৃহস্পতিবার, ১৪ মে, ২০২০
The Haunted House of Garia
//সদাশিব বাবুর বাড়ি//
/১/
সময়টা ১৯৬৮ বা ১৯৭০ হবে। গড়িয়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা কে
তখনও গ্রাম বলা চলে। শহুরে আদব কায়দা মেনে কিছু ঘড় বাড়ি তৈরি হওয়া শুরু হয়েছে বটে কিন্তু
কোথাও গিয়ে মফস্বলের কুড়েমি মেখে একটু যেন খাপছাড়া বা অসমাপ্ত। আমি তখন সদ্য বদলি হয়ে
এসেছি কোলকাতায়। একটি সরকারী দপ্তরে কেরানীর চাকরী। আগের আপিসের থেকে এখানে মাইনে একটু
বেড়েছে। মাসে ৩৫০ টাকা মাইনে আর সাথে বাড়ি ভাড়া বাবদ ৫০ টাকা অতিরিক্ত। এই বাড়ি ভাড়ার
জন্যে আলাদা করে খরচ দেওয়ার বন্দোবস্ত অবশ্য আপিসের মিত্তির বাবুর করে দেওয়া। মিত্তির
বাবুর সাথে বড় সাহেবের খুব খাতির। কিভাবে জানিনা মিত্তির বাবুর আমার উপর বেশ একটা সহানুভূতি
জন্মেছিল তাই এই সাহায্য। তাঁর সুপারিশেই প্রথমে কালীঘাটে আর তারপর গড়িয়া কামডহরির কাছে একটি ভাড়া বাড়িতে এসে ওঠা।
কালীঘাটের বাড়িটি বেশ ভালই ছিল কিন্তু ওখানে মেয়ে মানুষের স্নানের খুব অসুবিধা। পাড়ার
মোড়ে কলতলায় গিয়ে পুরুষ মহিলা সবাই স্নান করতো। মফস্বল-গাঁয়ে থাকা মানুষ হলেও শহরে
এসে এমন ব্যাবস্থা স্ত্রী ও মায়ের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব। ভাই অবশ্য হেসে বলেছিল,
“পাড়াগাঁয়ে থাকতে যেমন পুকুরে নেমে স্নান করতে। এও সেরকম বন্দবস্ত।অসুবিধার কি আছে?”
ভাই ছেলে মানুষ, বোঝে কম। শহুরে লোকে গ্রামের মহিলা দেখলে নজর দেয় বেশী। সেই নজরের
প্রকারভেদ আর সবিস্তারে নাই বা দিলাম।
কোলকাতায় আসার এক মাস পরে মা-বউ এর কথা শুনে শেষে মিত্তির মশাই
কে আবার ধরলাম একটা ভালো ভাড়া বাড়ির বন্দোবস্ত করে দিতে। মেয়ে মানুষের অসুবিধা হচ্ছে
শুনলে মিত্তির বাবু যেন স্বয়ং কৃষ্ণ ঠাকুরের রূপে অবতীর্ণ হন। সেইদিনেই আমায় নিয়ে আপিস
ছুটির পর তিন জায়গায় বাড়ি দেখাতে নিয়ে গেলেন। চেতলা, টালিগঞ্জ, রাসবিহারী এইসব জায়গায়
খুঁজেও আমার উপযুক্ত কোন ভাড়া বাড়ি পাওয়া গেল না। শেষে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। প্রায়
দু সপ্তাহ পরে এক শনিবার মিত্তির বাবু সরাসরি আমাদের কালীঘাটের বাড়িতে চলে এলেন। গড়িয়াতে
কামডহরির কাছে একটি দোতলা বাড়ি সদ্য তৈরি হয়েছে। মালিক এখন একতলাটা ভাড়া দিতে চায় যাতে
বাড়ি তৈরির খরচে কিছু সাহায্য হয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সন্ধ্যে নামার আগেই মিত্তির
মশাই, ভাই আর আমি রওনা দিয়ে দিলাম গড়িয়ার দিকে। রোদের আলো থাকতে থাকতে বাড়ি দেখে নেওয়া
উচিৎ। সন্ধ্যের কিছু আগেই সেখানে পৌঁছে আমরা ঘড় দেখলাম। দেওয়ালে তখনও প্লাস্টার চাপেনি।
উঠোন বলে কিছু নেই। ঝোপ ঝাড় ডিঙ্গিয়ে একটা সরু পথ দিয়ে গেলে বাড়ির মূল দরজা। ঘরের ভিতরে
প্লাস্টার করে চুন রঙ চাপানো হয়েছে, আর লাল মেঝে করা। আলো পাখার বন্দোবস্ত করা থাকলেও
দিনের বেশীরভাগ সময় লাইন থাকে না। তবে বাড়ির চারপাশে অনেক আম, কাঁঠাল আর নারকেল সুপারির
গাছ থাকায় জায়গাটা খুব ঠাণ্ডা। ঘরের পিছন দিকে একটা বিশাল উঠোন। বাড়ির মালিক এই জায়গাটা
জঙ্গল সাফ করে পরিষ্কার করে নিয়েছেন কারণ মেয়ে ঝি রা এখানে কাপড় কাঁচে, বাসন মাজে ইত্যাদি।
ভাই এর তো জায়গা দেখেই খুব পছন্দ। আমিও বেজায় খুশী কারণ বাড়ি
ভাড়া মাত্র ত্রিশ টাকা। ভদ্রলোক নিতান্তই লজ্জা লজ্জা করে বললেও আমি যেন হাতে চাঁদ
পেলাম। কালীঘাটে অমন বাড়িতে থেকেও সত্তর টাকা বাড়ি ভাড়া দিতে হয়, সেখানে এমন নিরিবিলিতে
বাড়ি যেন স্বর্গ। বাড়ির পিছনে উঠোন পেরিয়ে মেয়েদের জন্যে আলাদা করে স্নান ঘড় আর পায়খানা
করা আছে। উঠোনের এক প্রান্তে একটা কুয়ো। সেখানেই কাপড় কাঁচা, বাসন মাজা, স্নানের জল
ইত্যাদির ব্যাবস্থা। কথা হল পরের মাসের পনেরো তারিখের পরে আমরা এই বাড়িতে এসে উঠবো।
অগ্রিম হিসেবে তিন মাসের ভাড়া চেয়েছিলেন বাড়ির মালিক। আমিও পরের মাসে মাইনে পেলে দিয়ে
যাব বলেছি। সেই মত পরের মাসে মাইনে পেয়েই, এক রবিবার, আমি আর আমার গিন্নী মিলে বাড়ি
দেখতে গেলাম। দরজা দিয়ে ঢোকার পরেই গিন্নী যেন কেমন একটু থম মেরে গেল। নতুন জায়গায়
এলে সবার অমন একটু হয় তাই আমি আর অত গা করিনি। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারছিলাম এই বাড়িটা
বা বাড়ির বাসিন্দাদের আমার গিন্নী ঠিক পছন্দ করছে না। তার কোন পরামর্শ নেওয়ার অপেক্ষা
না করে তাই বাড়ি ভাড়ার অগ্রিম জমা করে গেলাম। বাড়ির মালকিন আবার বেশ ভালো। আমাদের চা
করে খাওয়ালেন। তাদের গাছের নারকেল থেকে বানানো নারকেল নাড়ু খাওয়ালেন। আমার স্ত্রীকে
দেখে তিনিও যেন ভারি খুশী। দুজনে মিলে বেশ খোশ গপ্প করলো খানিক। আমি আর বাড়ির মালিক
সদাশিব চাটুজ্জে ছাদে গিয়ে টাকা পয়সা ও অন্যান্য বৃত্তান্ত নিয়ে আলোচনা করলাম। সেদিন
সন্ধ্যা নেমে যাওয়ায় বাড়ির উঠোন ভালো করে দেখা হয়নি। কিন্তু আজ ছাদের উপর থেকে লক্ষ্য
করলাম সেখানে তিন জায়গায় কুয়ো খোরা হয়েছে কিন্তু বাধানো হয়নি। ভদ্রলোককে কারণ জিজ্ঞেস
করতেই কেমন যেন একটু ঢোঁক গিললেন। তারপর বললেন, “আসলে এই তিন জায়গায় যতবার কুয়োর কাজ
শুরু করা হয়েছে ভিতরে হুশ হুশ করে এমন জল এসেছে যে কাজ করা প্রায় এক রকম অসম্ভব হয়ে
যাচ্ছিল। শেষে ওই পশ্চিম দিকের কোণে দেওয়ালের কাছ বরাবর একটা কুয়ো বানানো হয়েছে। ভদ্রলোকের
যুক্তিতে কেমন একটা খটকা লাগলেও সেরকম আমল দিতে ইচ্ছে হয়নি। দুজনে মিলে চারমিনারের
ধোয়া উড়িয়ে শেষে ছাদ থেকে নামলাম। আশে পাশে বাড়ি ঘরের সংখ্যা খুবই সামান্য। কিন্তু
তবুও এটাকে একটা পাড়া বলা চলে। পাড়ার মধ্যে দুটো মুদী দোকান রয়েছে। আর একটা তেঁতুল
গাছের নিচে মাছ ও সবজির দোকান বসে সকাল বেলা। গড়িয়া খালের একটা অংশ বোধহয় এই দিক দিয়ে
ছিল। তারই একটা মজা ডোবা মতন রয়েছে এখানে। সেটায় সব বাড়ি থেকে আবর্জনা এনে ফেলা হয়।
/২/
দেখতে দেখতে ১৫ তারিখ এসে গেল। তারপর মায়ের কথা মতন সব বিধি
মেনে নতুন বাড়িতে মাল পত্তর নিয়ে আসা হল। জিনিস বলতে খুবই সামান্য কিছু। দুটো স্টোভ,
রান্নার জিনিস, তিনটে বিছানা আর জামা কাপড় যা থাকে। দুটো চৌকির ব্যাবস্থা সদাশিব বাবু
করে রাখবেন বলেছিলেন। এসে দেখলাম ভদ্রলোক কথার খেলাপ করেন নি। উঠোনে রোদের মধ্যে দুটো
চৌকি রাখা আছে। ট্যাক্সি থেকে সব মাল পত্তর নামিয়ে বাড়ি ঢুকতেই মায়ের মুখে একটা অদ্ভুত
কথা শুনলাম। মা বললে এই ঘরের হাওয়া নাকি ভারি ভারি মনে হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ভাই কে দিয়ে
ঠাকুরের জিনিস পত্তর থেকে গঙ্গা জলের ডাব্বা এনে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিলো। গঙ্গা জলের সাথে
হাওয়া বাতাসের কি সম্পর্ক জানিনা। কিন্তু একটা তফাৎ আমিও অনুভব করলাম। বদ্ধ ঘরের বাতাসে
যেমন একটা গুমোট ভাব থাকে। গঙ্গা জলের কৃপা না জানলা খুলে দেওয়ার ফল জানিনা এখন সেটা
আর নেই। আপিসে দরখাস্ত করে তিনদিনের ছুটি চেয়ে নিয়েছিলাম। মিত্তির মশাই সেটা বড় সাহেব
কে বলে মঞ্জুর করিয়ে দিলেন। দুই ভাই মিলে চেষ্টা করলাম যতটা সম্ভব সাহায্য করার। আর
আমার গিন্নীর গুণে মাত্র দু’দিনেই ঘড় বেশ বাসযোগ্য হয়ে উঠলো। কিন্তু মা ও গিন্নীর মনের
মধ্যে যে একটা খুঁতখুঁতে ব্যাপার কাজ করছে সেটা দুই ভাই বেশ আন্দাজ পাচ্ছি। আমাদের
উদাসীনতা হোক বা অভিজ্ঞতার অভাবে বাড়ির অন্দরমহলের আবহাওয়া ঠিক আন্দাজ পেতাম না।
এতদিন কালীঘাটের বাড়িতে আলাদা করে কোন আসবাব এর প্রয়োজন হয়নি।
কিন্তু এই বাড়িতে এসে আসবাব কিছু না কিনলেই নয়। সদাশিব বাবুর থেকে জেনে নিয়ে আমরা দুই
ভাই মিলে রথতলার বাজার থেকে একটা নারকেল কাঠের ছোট আলমারি নিয়ে এলাম রান্নাঘরের জন্য।
এই বাড়িতে বেড়ালের উপদ্রব আছে। থালা বাসনে মুখ দেয়, মাছ নিয়ে পালায়। আর কিনলাম কিছু
মোড়া আর একটা জলচৌকি। গিন্নীর হাতের গুণে ঘরের মধ্যে বেশ একটা সুখী গৃহকোণ এর ছায়া।
প্রথম সাতদিন বেশ ভালো ভাবেই কেটে গেল। আমার ভাই দ্বিজেন্দ্র পড়াশোনায় যথেষ্ট ভালো
ছিল। স্কুল ফাইনালে ব্রাঞ্চ স্কুলে সে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছিল। কিন্তু কোলকাতায় এসে
তার যেন রকমফের হল। পড়াশোনার প্রতি তার আর মনোযোগ নেই। সে এখন চাকরী করতে চায়। চাকরী
কি আর অতই সোজা? তবু মিত্তির মশাই কে বলে কয়ে সন্দেশ পত্রিকার ছাপা খানায় একটা চাকরী
জুটে গেল। ভাইয়ের কাজের সুত্রেই আমাদের সত্যজিত রায় এর কাজ সম্পর্কে জানা। সন্দেশ পত্রিকায়
সেবার শেয়াল দেবতা রহস্য বেড়িয়েছে। ছাপা খানা থেকে এক কপি বই ভাই নিয়ে এসেছিল বাড়িতে।
তো এক রবিবার দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে দুই ভাই মিলে শেয়াল দেবতা রহস্য পড়ে আলোচনা
করছি ফেলুদা কে নিয়ে। এমন সময় ভাই এর নজর দেখি জানলার বাইরে স্থির হয়ে গেল। চকিতে সে
জানলা টপকেই লাফিয়ে বাইরে গেল। তার চিৎকার শুনলাম স্পষ্ট “ও খোকা। আরে পরে যাবে যে।
ও খোকা!!” গতিক সুবিধার নয় বুঝে আমিও বাইরে গেলাম।
বাইরে এসে দেখি ভাই উঠোনের মধ্যে একটা অসমাপ্ত কুয়োর উপর ঝুঁকে
পরে কি যেন দেখছে। আমিও ছুটে যেতে ভাই বলল, “স্পষ্ট দেখলাম জানিস। একটা বাচ্চা ছেলে
প্রাণ পণে কুয়ো থেকে ওঠার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। এসে দেখি নেই। কুয়োর জল ও তো
স্থির”। আমরা দুই ভাই এইসব নিয়ে আলোচনা করছি আর উঠোনের আসে পাশে বাচ্চাটাকে খুঁজছি।
এমন সময় ছাদের দিকে নজর গেল। সদাশিব বাবু দেখি জুলু জুলু চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন।
চোখা চুখি হতেই আড়ালে চলে গেলেন। খটকা যে একটা লাগলো না বললে ভুল হবে কিন্তু বাচ্চাটা
এলো কোথা থেকে? এই বাড়িতে আসা ইস্তক কোন বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে নজরে পরেনি। আমরা সাতদিন
ধরে এই বাড়িতে আছি, কিন্তু সদাশিব বাবুর স্ত্রীকে একদিনও আসতে দেখলাম না। সব মিলিয়ে
আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যেও একটা খুঁতখুঁতে ব্যাপার কাজ করছিল। কিন্তু সারাদিন কর্ম সুত্রে
বাড়ির বাইরে থাকার জন্যেই হোক বা বিজ্ঞান মনস্কতার জন্যেই হোক, এই বাড়ির অশরীরী অস্তিত্বের
বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম না।
ভাইয়ের দেখা ওই ঘটনার প্রায় দিন পাঁচেক পরে, ভাই তার পত্রিকা
অফিস থেকে ফেরার সময় কৈ মাছ কিনে নিয়ে আসে। গড়িয়ার হাটে সস্তায় পেয়ে যাওয়ায় সে আর অপেক্ষা
করে না। মাছ নিয়ে এসে তার তো আর আহ্ললাদ ধরে না। বৌদির কাছে তার সব আব্দারের মধ্যে
এইটি একটি বিশেষ আব্দার। মাঝে মধ্যেই নতুন রকম রান্না করে খাওয়ানো। আমার গিন্নীর হাতের
রান্নাও সে’রকম। আমি তখনও অফিস থেকে ফিরিনি। কাঁচা মাছ অমন রেখে দিলে খারাপ হয়ে যাবে।
আর তার ওপর ভাই এর আব্দারে আমার গিন্নী বাধ্য হয়েই সেদিন রাতে তেল কৈ বানাবে বলে প্রস্তুতি
শুরু করে। সেদিন অফিস থেকে ফিরতে আমার একটু দেরী হয়েছিল। বাড়ি এসে দেখি একটা ডাক্তারের
গাড়ি আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ির পরিবেশ ও কেমন যেন থমথমে। ভাই এর কাছে
শুনলাম কৈ মাছের বৃত্তান্ত। তো সেই কৈ মাছ নিয়ে আমার গিন্নী কুয়োর কাছে বসে পরিষ্কার
করছিল। এমন সময় কি যেন দেখে ভয় পেয়ে একটা চিৎকার দেয়। ভাই সে আওয়াজ শুনে গিয়ে দেখে
আমার গিন্নী অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। সদাশিব বাবু কে ডেকে দুজনে মিলে তারপর ওকে ঘরে নিয়ে
আসে। অনেকক্ষণ অব্দি চেষ্টা করেও জ্ঞান না ফেরায় শেষে ভাই গিয়ে পাড়ার হরেন ডাক্তার
কে ডেকে নিয়ে আসে। ডাক্তার এসে স্মেলিং সল্ট নাকের কাছে ধরায় শেষে জ্ঞান ফিরেছে।
সেরাত্রে আমার গিন্নীর কাছে আমরা প্রথম এই বাড়ির অশরীরী একটা
ঘটনা শুনলাম। ভাই কৈ মাছ এনে দেওয়ার পরে বাজারে গিয়েছিল টুকিটাকি কিছু রান্নার জিনিস
কিনতে। সেই অবসরে আমার গিন্নী কুয়োর কাছে গিয়ে মাছ পরিষ্কার করছিল। এমন সময় সে নাকি
দেখে সদাশিব বাবুর স্ত্রী কুয়োর আসেপাশে ঘোরাফেরা করছেন। আমার গিন্নী স্বভাব বশেই হেসে
আলাপ করতে যায় কিন্তু সদাশিব বাবুর স্ত্রীর নজর যেন ওই মাছগুলোর প্রতি। ভাবগতিক অন্যরকম
দেখে সে তাড়াতাড়ি মাছ ধুতে শুরু করে। এমন সময় সদাশিব বাবুর স্ত্রী নাকি বলেন একটা মাছ
দিতে। আমার গিন্নী হেসে জানায় যে রান্না হয়ে গেলে দুটো মাছ সে নিজে গিয়ে দিয়ে আসবে
দোতলায়। কিন্তু এতে যেন সদাশিব বাবুর স্ত্রী ক্ষেপে যায় আর হাত বাড়িয়ে মাছগুলো ছিনিয়ে
নেওয়ার চেষ্টা করেন। আমার স্ত্রী এমন অদ্ভুত আচরণের জন্য অবাক হয়ে মাছ নিয়ে পাশ কাটিয়ে
আসার সময় নাকি দেখে একটা লম্বা কঙ্কালের হাত এসে এক থাবা মারল মাছের ঝুড়িতে। ব্যাস!
ওই দেখেই সে অজ্ঞান হয়ে যায়। ভাই তখন বাজার নিয়ে এসে রান্নাঘরে গুছিয়ে রাখছিল। বৌদির
চিৎকার শুনতেই সে কুয়োর কাছে গিয়ে দেখে এই কাণ্ড। রাতের বেলায় আমরা দুই ভাই মিলে টর্চ
নিয়ে মাছগুলোর কি হল দেখতে গিয়েছিলাম। সেই অসমাপ্ত কুয়োর পাশে যেখানে আমার ভাই বাচ্চাটাকে
দেখেছিল। মাছের কাঁটাগুলো দেখলাম পরে আছে সেই কুয়োর পারে। যে কেউ দেখলে বলবে এই কাজ
বেড়ালের। কিন্তু অশরীরী গল্পের আবহেই হোক বা মনের কোণে থাকা কুসংস্কারের জন্যে। কঙ্কাল
হাতের ঘটনা আমাদের বেশ উদ্বিগ্ন করে রাখল। মা বলেছিল সদাশিব বাবুর সাথে একবার কথা বলে
দেখতে। কিন্তু বাড়ির মালিকের কাছে গিয়ে তার গিন্নীর মাছ চুরি করার নালিশ করবো। বড্ড
বারাবারি ভেবে দুই ভাই চেপে গেলাম। আর তাছাড়া আমার কোথাও গিয়ে যেন মনে হয়েছিল এই কঙ্কাল
হাত দেখতে পাওয়ার কারণ ম্যাটিনি শোয়ে গিন্নী কে নিয়ে “তিন কন্যা” দেখতে যাওয়ার ফল।কিন্তু
পরে অবশ্য আমার ভুল ভেঙ্গে যায়।
/৩/
পরের দিন সকালেই আমার মা রথতলা কালীবাড়ি চলে যায় পূজা দেওয়ার
জন্য। আমার গিন্নীও যা ভয় পেয়েছে তাই সে ও গেছে। আমি আর ভাই ঘরে বসে টুকটাক কাজ করছি।
উঠোনের দিকে দোরের সামনে একটা বাল্ব লাগানোর ব্যাবস্থা করলাম। রাতের বেলায় সত্যি যা
অন্ধকার হয়ে থাকে। ভুত থাক বা না থাক, ভয় এমনিও লাগে। আমরা দু’ভাই এইসব কাজ করছি, এমন
সময় সদাশিব বাবুর কোন আত্মীয় বা বন্ধু স্থানীয় কেউ এলেন। আমাদের দেখে তিনি যেন বেশ
বিরক্ত হলেন। উনি সিঁড়ি দিয়ে উপরে যাওয়ার পরেই একটা বিতণ্ডা শুনতে পেলাম। বাড়ি ভাড়া
দেওয়ার জন্যেই যে এই ঝগড়া তা বেশ আন্দাজ পেলাম। সম্ভবত এই বাড়িতে শরীকী ঝামেলা আছে।
উপরতলার বিতণ্ডা প্রায় আধা ঘণ্টা চলল। তারপর ভদ্রলোক বাইরে এসে খ ও ব সহযোগে বেশ কিছু
স্তব রচনা করে সদাশিব বাবুর বন্দনা করে চলে গেলেন। ভাই আর আমি বাল্ব লাগানোর কাজ সেরে
রান্নাঘরে একটা তাক লাগানোর চেষ্টায় ব্যাস্ত রইলাম।
“বাড়ি খুঁজবে, মানে?’ ভাই অবাক হয়ে বলে।
এরপর মা ধীরে ধীরে সব খোলসা করে বলে। আজকে মন্দিরে পূজা দিতে
গিয়ে মা গতকাল সন্ধ্যের ঘটনা পুরুত মশাইয়ের কাছে বলে। এর পর পুরুত মশাই আমাদের ঠিকানা
শুনে নাকি বলেন এই বাড়ি অভিশপ্ত জমির উপর। এই কথা সবাই জানে। কিন্তু এই বাড়ির ইতিহাস
সম্পর্কে আরও ভালো বলতে পারবেন এই পাড়ার গগন চাটুজ্জের স্ত্রী। আমাদের দুই ভাই এর দায়িত্ব
হল এখন এই গগন চাটুজ্জের বাড়ি খুঁজে বের করে মা কে নিয়ে সেখানে যাওয়া। এবং অনতিবিলম্বে
নতুন বাড়ির সন্ধান করা। আর এখন থেকে বাইরের দিকে এই ঘরে আমি আর ভাই শোব। আমার স্ত্রী
মায়ের ঘরে শোবে। পুরুত মশাই বিশেষ করে পুজা দিয়ে ফুল আর মা কালীর স্নানের জল দিয়েছেন।
সেই ফুল আর স্নানের জল আজ সন্ধ্যাবেলা ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। ভাই আর আমি প্রথমে
হেসে ফেলেছিলাম কিন্তু বাকী দু’জনের মুখ দেখে আর সাহস হলনা কৌতুক করার।
সন্ধ্যের সময় যখন সব বাড়ি থেকে শাঁখের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমার
মা ও স্ত্রী দু’জনে আঁচলে গিঁঠ বেঁধে ঘরের মধ্যে সেই মা কালীর স্নানের জল ছেটাতে শুরু
করলো। এমন সময় সারা ঘরে যেন একটা আলোড়ন শুরু হয়ে গেল। রান্না ঘরে বাসন রাখার আলমারিটা
দুম করে পরে গেল। ভাই ও কেমন যেন ছটফট শুরু করলো। তার সারা গায়ে যেন কেউ গরম জল ঢেলে
দিয়েছে। আমি নিজেও খুব অস্বস্তিতে পরলাম। ম্যালেরিয়া জ্বর ছাড়ার সময় যেমন ঘাম হয়। আমি
সেরকম ঘামতে শুরু করলাম। পড়নের ফতুয়াটা ভিজে জবজবে হয়ে গায়ে সেটে বসে গেছে যেন। মা
কিন্তু অবিচল হয়ে মন্ত্র আওড়াচ্ছেন আর জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। এমন সময় ভাই আর থাকতে না
পেরে কুয়োর দিকে ছুটে গেল। আমিও গিয়ে দেখলাম ভাই বালতি বালতি জল তুলে গায়ে ঢালছে। তার
সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে যাচ্ছে। এমন সময় ভিতর ঘড় থেকে আমার স্ত্রীর চিৎকার শুনে ঘরে গিয়ে
দেখি বিছানা পত্র সব অগোছালো হয়ে গেছে। কেউ যেন এই মাত্র সব জিনিস নিয়ে সারা ঘরে ছড়িয়ে
ফেলেছে। স্ত্রীর সাথে হাত মিলিয়ে জিনিস গোছাচ্ছি এমন সময় ভাই এর চিৎকার। বাইরে যেতেই
যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার পিঠ দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল। অসমাপ্ত একটা কুয়োর
মধ্যে থেকে ভাই উঠে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। দৌড়ে গেলাম ভাইকে সাহায্য করতে।
কুয়োর জলে তখন যেন কোন বৃহদাকার জন্তু তুফান সৃষ্টি করেছে। ভাইয়ের পা ধরে সেই জন্তু
যেন ক্রমে তাকে কুয়োর ভিতরে টেনে নিতে চায়। আমি আমার সব শক্তি সঞ্চয় করে ভাই কে টেনে
তোলার চেষ্টা করেও পারছিনা। এমন সময় দেখি সদাশিব বাবু এসে দাঁড়ালেন। তারপর দু’জনে মিলে
ভাইকে টেনে তুললাম।
/৪/
এই ঘটনার পরে প্রায় একমাস পেরিয়ে গেছে। আমরা এখন গড়িয়া মোড়ের
কাছেই একটি বাসা ভাড়া নিয়ে আছি। তিনতলা বাড়ির নিচে একদিকের চারটি ঘর ফাঁকা পরেছিল।
সেটাই আমাদের ব্যাবহার করতে দিয়েছেন। এই বাড়ির সন্ধান সদাশিব বাবু নিজে করে দিয়েছিলেন।
আমার জমা দেওয়া অগ্রিম টাকা দিয়ে তিনি নিজেই এই বাড়ি ভাড়ার অগ্রিম দিয়ে দেন। তারপরে
বহুবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কোনদিন এই রহস্যের কারণ বলেন নি। একদিন নিছকই ইচ্ছে
হওয়ায় আমরা দুই ভাই মিলে পুরনো পাড়ায় গেছিলাম। সেখানে গিয়ে গগন চাটুজ্জের বাড়ি খুঁজে
বের করলাম। ভদ্রলোককে দেখে আমরা দুই ভাই অবাক। ওই বাড়িতে থাকার সময় একদিন যে লোকটি
এসে সদাশিব বাবুর সাথে ঝগড়া করেছিলেন তিনি গগন চাটুজ্জে। আমাদের দেখেই ভদ্রলোক চিনতে
পেরে ঘরে এনে বসালেন। তারপর যে বৃত্তান্ত শুনলাম সেটা আজও আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটি
রহস্য।
সদাশিব ও গগন চাটুজ্জে দুই ভাই। দেওয়ানী মামলা করে করে সদাশিব
অনেক টাকা ও জমি করেছিলেন। এই জমিটিও তার মধ্যে একটি। কিন্তু জমিতে খুঁত আছে সে বিষয়ে
স্থানীয় লোকেরা বারবার সাবধান করা সত্ত্বেও সদাশিব চাটুজ্জে এই জমিতে বাড়ি তোলার কাজ
শুরু করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই একতলার ঘর তুলে নিয়ে উনি স্ত্রী ও পুত্র সহ এখানে চলে
আসেন। তারপর একটু একটু করে বাড়ির কাজ করতে থাকেন। এই অঞ্চলে জলের অভাব চিরকালীন। তাই
নিজের জমির মধ্যেই একটি কুয়ো বানাবার চেষ্টা করেন সদাশিব বাবু। কিন্তু কুয়ো কাটার তৃতীয়
দিনেই সদাশিব বাবুর বড় ছেলে ওর মধ্যে পরে গিয়ে মারা যায়। তারপর থেকেই সদাশিব বাবুর
স্ত্রী কেমন যেন উন্মাদ হয়ে যান। অনেক চেষ্টা করেও সেই কুয়োটার কাজ শেষ করতে না পারায়
শেষে সদাশিব বাবু আরেকটি কুয়ো খুঁড়ে সেই মাটি দিয়ে পুরনো কুয়ো বোঝানোর ব্যাবস্থা করেন।
কিন্তু কোন অতিপ্রাকৃত ঘটনার সাহায্যে যতই কুয়ো খুঁড়ে মাটি তোলেন সেই পুরনো কুয়োর মুখ
বন্ধ করা যায়না। শেষে পশ্চিম দিকের এক ছটাক জমি কিনে সদাশিব বাবু সেখানে প্রাচীর তুলে
নতুন কুয়ো বানিয়ে নেন। সব কিছু ঠিক চলছিল, কিন্তু একদিন দুপুরে হঠাৎ সদাশিব বাবুর স্ত্রী
নাকি তার বড় ছেলেকে কুয়ো থেকে ওঠার চেষ্টা করতে দেখতে পান। ব্যাস! মা এর মন, সে কি
আর বাঁধ সাধে? কাউকে কিচ্ছু না বলেই ছুটে গেলেন কুয়ো থেকে ছেলেকে তুলবেন বলে। গেলেন
তো গেলেন আর এলেন না।
আমি এই সময় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পরেছিলাম। কারণ আমি ও আমার স্ত্রী
দু’জনেই সদাশিব বাবুর স্ত্রী কে দেখেছিলাম। তারপর মনে মনে খেয়াল করে দেখলাম। সেদিন
সদাশিব বাবু নিজেই ট্রে তে করে চায়ের পেয়ালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। সদাশিব বাবুর স্ত্রী
এলেন পরে। বসার ঘরে একটা চেয়ারে এসে বসলেন বটে কিন্তু কোন কথা বলেন নি। আমার স্ত্রীর
দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন এ আমি স্পষ্ট দেখেছি। তারপরে বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত কথা বলার জন্য
সদাশিব বাবু আমাকে ছাদে নিয়ে যান। ফিরে এসে আমি অবশ্য আর ওনার স্ত্রী কে দেখিনি। কিন্তু
নারকেল নাড়ু? মনে পরল, সেগুলি চায়ের সাথে সদাশিব বাবু নিজেই নিয়ে এসেছিলেন। মানুষের
ভ্রম হলে অনেক কিছু দেখতে পায় শুনতে পায় এই কথা আমি জানি। কিন্তু সদাশিব বাবুর বাড়িতে
যে অভিজ্ঞতা হল, তবে কি সত্যি তারা আছেন?????
সদাশিব বাবুর বাড়ি অবশ্য এখন আর নেই। বছর কয়েক আগে আমি আর ভাই
একবার গিয়েছিলাম ওই পাড়ায়। সেখানে এখন একটা পেল্লায় ফ্ল্যাট বাড়ি উঠেছে। আর যে ডোবায়
ময়লা ফেলা হত, সেখানে এখন একটা বড় পার্ক তৈরি করা হয়েছে।
(C) পাগলাদাশু