সোমবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

Radio Station:


                                                                         //১//
নিয়ম মাফিক রোজ সকালে এসে অফিস খোলানোর কথা NG এর। NG অবশ্য তার ভালো নাম নয়, কর্মক্ষেত্রে ডাক নাম। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন ননীগোপাল, পুরো নাম ননীগোপাল মল্লিক। মাধ্যমিক পাশ করার পরে আর পড়া হয়নি। যা হয় আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত পরিবারে। সাংসারিক দায়িত্ব সামলাতে নেমে পরতে হয় অন্যের গোলামী করতে। ননীর জীবনেও কিছুটা সেরকম। বনগাঁর একদম এক প্রান্তবর্তী গ্রামে তাদের বাড়ি। তার বাবা ছিলেন রাজমিস্ত্রি। কলকাতা তে এসে কাজ করে শনিবার রাতের train এ বাড়ি যেতেন। একদিন বাড়ি ফিরলেন না। ভিড় train থেকে পরে মারা যান। ননীর জীবনের প্রথম অধ্যায় শুরুও বোধয় সেখান থেকেই। সে সময় সীমান্ত প্রহরা এত কড়া ছিলনা। তবু ভয় তো একটা ছিলই। অসৎ সঙ্গে পরে ননী শুরু করে গরু আর চিনি পাচার এর কারবার। এপার থেকে গরু নিয়ে বেড়াতে যেত নদীর পারে। ঠিক মাপা সময় অনুযায়ী ওপার থেকে সংকেত আসলে , গরু গুলো কে নদীতে নামিয়ে দিতো। বাংলাদেশের লোক ও সে'সময় গরু চড়াতে আসে। এপার থেকে ওপারে গরু গেলেও বোঝার উপায় নেই। এই প্রাণীদের পেটের কাছে চামড়ার ব্যাগে প্লাষ্টিক প্যাকেট মুড়িয়ে রাখা থাকত চিনি। কেউ টেরও পেত না। কিন্তু এই করে প্রচুর কমিয়ে নিত কিছু মানুষ। ননীও ভালো টাকা পেত। কিন্তু এসব কাজে সবদিন সমান যায় না। কিছু গরু উল্টো পথে ফিরে আসত। তাদের ওপারে নিয়ে যেতে তখন ডুবসাঁতার দিয়ে গরুদের গলা জড়িয়ে নিয়ে যেতে হত।  এভাবে গেলে সীমান্তরক্ষীদের নজর এড়ানো যেত আবার গুলি চল্লেও বিপদ থাকত কম। কিন্তু ননীর গুলি লাগলো একদিন। সেই থেকে ডানপা টা একটু দুর্বল তার।

এক বছর প্রায় বেকার বসে থাকার পর, রাজমিস্ত্রি হবে বলে, কলকাতা চলে আসে। এখানে অবশ্য বিপদ নেই। শুধু খাটনি বেশি, পয়সা কম। প্রথমদিকে যোগানদার এর কাজ। তারপর ইটগাঁথার কাজ। শেষে রাজমিস্ত্রি। তার বাবা যে কতখানি পরিশ্রমের পরে এই খেতাব পেয়েছিল সে অনুমান করতে পারে নিজে সেই পথে হাঁটার পর। চৌরঙ্গী পাড়ায় এক অফিসের রাজমিস্ত্রির কাজ করে, তার নাম একটু পসার পায়।  সেই অফিস মালিকের সুপারিশেই বাইপাসের ধরে এক পুরোনো বাড়ি ভেঙে, এক radio station বানাবার বরাত পায়। প্রায় ৭ মাসের পরিশ্রমে অফিসটা তৈরী হয়। এখান থেকে অবশ্য তার নতুন পথের যাত্রা শুরু।

                                                                  //২//
ইছামতির জলে ছিল সুর। নৌকার দাঁড় বাইতে যে ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ আসে, সেই তালে ছিল গান। ননী গান শেখেনি কোনোদিন তবে গলায় সুর ছিল। শরৎ কালে ইছামতির দুপাড় ভরে যেত কাশ ফুলে। কে বলবে দুটো অন্য দেশ। এমন অনেকদিন সে তার ছোট্ট ডিঙি নিয়ে স্রোতের টানে ভাসিয়ে দিত। নদীর তালে গান বেঁধে গান করত। কাশের শীষ ভেঙে পুতুল বানাত। কলকাতায় আসার পরেও ইছামতি কে মনে করে গান বাধতো সে। একদিন সেই গান শুনে ফেললেন Radio station এর মালিক। আর সেদিন থেকে রাজমিস্ত্রির কাজে ইস্তফা দিয়ে শুরু হল Radio station এর পরিচারকের কাজ। ক্রমে বেয়ারা। তারপর সঞ্চালক। গোটা পনেরো বছরের কর্ম জীবন কাটিয়ে, আজ সে এই পর্যায়ে।

আজকাল radio তে নতুন ধারার প্রবর্তন। সঞ্চালক হয়ে গেছে Radio Jockey, বা সংক্ষেপে RJ. তাদের নামের ও সংক্ষেপ আছে, অনেকের আবার ছদ্মনাম আছে। সে অনেক বেপার। এই দীর্ঘ পাঁচ বছরে Radio station এর ক্রম বিবর্তনের সাক্ষী সে। RJ হিসেবে কাজ পাওয়ার পর, তার নাম হয় NG . অর্থাৎ ননীগোপাল এর সংক্ষেপ। যাদবপুরের কাছে একটা ফ্ল্যাট ও কেনে সে।  তার কন্ঠ যে তাকে এমন সুযোগ দেবে, একি আর ননী জানত? নিজের কাজে অবহেলা করেনি কোনদিন। হয়ত তারই সুফল এখন ভোগ করছে। গতমাসে তার জীবন নিয়ে Radio তে কথা হচ্ছিল। অন্য আরেক RJ সাক্ষাৎকার নিচ্ছে ননীর। তাকে Radio station এর তরফ থেকে সম্মানিত ও করা হয়। এ'মাস থেকে তাই সকালের প্রথম show নানীকে দিয়েই। RJ হওয়ার পরেও অবশ্য অভ্যাস পাল্টায়নি ননীর। আজও সে সকাল সকাল চলে আসে। শুধু, পরিচারকের কাজ আর করতে হয় না। কেবল নিজের ঘরে ঢুকে যন্ত্রপাতি পরিষ্কার করা, তার ঘরে ঠাকুরের আসনে ধুপ দেওয়া। এসব না করলে তার যেন দিনই শুরু হয় না। ভোর ৬টায় প্রথম Broadcast. মোটামুটি ৫টা থেকে সকালে যাদের কাজ চলে আসেন। News room এ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সকাল ৭টায় খবর, তারপর নানা রকম অনুষ্ঠান। NG ওরফে ননী এখন থেকে খবরের আগে show টা করে। গানের আসর। ঘুম ভাঙার পরে দিনের শুরু কে স্নিগ্ধ ভাবে করতে, উৎসাহী হয়ে নিজের কাজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে এই show ভালোই পরিচিতি পেয়েছিলো। অনেকে phone ও করে তাদের পছন্দের গান বাজানোর জন্যে। বেশ ভালোই কাটতো ননীর সকাল। এরপর ছিল অফিসের কাজ। সারাদিনের শেষে সন্ধ্যে ৮টা নাগাদ ছুটি নিয়ে সে যেত বাড়ির কাছেই একটা library তে। খবরের কাগজ, আর গল্পের বই, এদের সাথে এক ঘন্টা কাটিয়ে বাড়ি ফিরত। কোন বই পছন্দ হলে নিয়ে আসত।

                                                             //৩//
আজ সকালেও নিয়ম মাফিক ননী সবার আগেই চলে আসে। অফিসের তালা তখনও খোলা হয়নি। দারোয়ানটাও কাছে পিঠে নেই দেখে নিজেই চাবি খুলে ভেতরে ঢোকে। আলো জ্বালিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বসে আজকের program কিভাবে শুরু করবে একবার ঝালিয়ে নেয় মনে মনে। রমেশ নামের এক ছোকরা চাকর কাজ করে এখন এখানে। ঐ পদটি অবশ্য একদিন ননীর ছিল। রমেশ অবশ্য সেই তফাৎ করেনা।  সে ননী কে যে সম্মান দেয় সেটা বাকীদের ও নজর কাড়ে। ননী একবার হাঁক দেয় রমেশ এর নাম ধরে। তারপর নিজেই হেসে ফেলে। বন্ধ অফিস খুলে নিজেই ঢুকল, তাও আবার ফরমাশ জানাতে রমেশ কে ডাকছে। ঘর থেকে বেড়িয়ে gate র সামনে আসে। না, দারোয়ানটা এখনও বেপাত্তা। রাস্তায় লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে। অফিসের বড় ঘড়িতে পৌনে ৬টা বাজে। এরম অনিয়ম তো কোনদিন হয় না। একটু যেন উসখুস করে মনটা। এত বছরে প্রথমবার পৌনে ৬টার সময় অফিস ফাঁকা। এখন কিছু করার নেই। নিজেই transmitter room এ যন্ত্রপাতি চালু করে। STL system on করে studio তে ঢোকে। Microphone feed check করে, control panel এর কাছে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জোগাড় করে নেয়।

কাল দুপুর অব্দি একটা ভালো বই পড়ার পর  থেকে মনে মনে আজকের সকালের বিষয় ঠিক করে রেখেছিলো সে। যান্ত্রিক জীবনের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া অযান্ত্রিক মনের আনাচে কানাচে যেসব সুক্ষ অনুভূতিগুলো লুকিয়ে থাকে, যারা চাইলেও মাথা তুলে নিজের দাবী জানাতে পারেনা। সেইসব ইচ্ছের গল্প নিয়ে আজকের বিষয় ভেবেছিল সে। অফিসে বসে গানের CD গুলো একজায়গায় করে রেখেছিল। studio থেকে বেড়িয়ে নিজের ঘরে যায় একবার CD গুলি আনতে। আশ্চর্যের বেপার, এখনো কোন মানুষ আসেনি। গোটা অফিসটায় সে একা। দু'বার হাঁক দেয় রমেশ এর নাম ধরে। এবারেও একই ফল। ওদিকে আবার ঘড়িতে ৬টা বাজতে ৫মিনিট বাকি। না, এমনধারা বেনিয়ম এই অফিসে প্রথমবার। পুজোরছুটিতেও যে radio station গমগম করে, সেখানে আজকে কি এমন উপলক্ষ, যে সবাই অনুপস্থিত। মনে মনে বেশ রাগ নিয়েই studio তে গিয়ে set on করে। চিরাচরিত ভঙ্গিতে শুভ সকাল জানিয়ে, নিজের program শুরু করে দেয়।

                                                              //৪//
৭টা অব্দি নিজের কাজ সেরে বেড়োনোর সময় ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। Load Shedding! আর সময় পেলো না। এখনো অফিসে কেউ আসেনি। News time শুরু হবার কথা। এদিকে অফিস ফাঁকা, তার ওপর আবার এই ঝামেলা। বিরক্ত হয়ে বাইরে আসে ননী। কোনরকম হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে। তারপর দরজার দিকে এগোয়। কেউ আসেনি যখন generator কে আর চালাবে। দিন দিন উচ্ছনে যাচ্ছে সব। মনে মনে এ'সব ভাবতে ভাবতে বাইরে বেড়িয়ে আসে। Gate এর বাইরে দৃশ্য দেখে ননী অবাক। Radio station এর অর্ধেক কর্মচারী gate এর বাইরে দাঁড়িয়ে। Gate টাও ফুল দিয়ে সাজানো। আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে আসে। ঐতো রমেশ দাঁড়িয়ে। ননী ডেকে ওঠে। কিন্তু রমেশ যেন শুনেও শুনতে পায় না। বাকি সঞ্চালকদের মধ্যেও অনেকে সেখানে উপস্থিত। তারা যেন কেউ তাকে দেখতে পাচ্ছে না। সবাই হাতে মোমবাতি নিয়ে দাঁড়িয়ে। কি চলছে বুঝে উঠতে পারে না ননী। সবাই যেদিকে তাকিয়ে, সেখানে চোখ পড়তে সব যেন কেমন গুলিয়ে যায়। পায়ের তলার জমিটাও যেন আর নেই। দেহের ভার আর নিতে পারছে না যেন পা দুটো। Gate এর পাশে দেয়ালের গায়ে, তার ছবি। সাথে আরো ৫জনের ছবি। এরা সবাই এই অফিসের কর্মচারী। Control room, power supply সেদিকের দেখভাল করতেন এরা।  রাস্তায় বিভিন্ন খবরের চ্যানেলের গাড়ি দাঁড়িয়ে। সবাই মৃত ব্যক্তিদের সম্মান জানাতে মোমবাতি, ফুল এইসব রেখে দিয়ে যাচ্ছে ছবিগুলোর সামনে। RJ বৈশাখী এক কোণে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্র সংগীত গাইল। সমবেত সবাই সঙ্গ দিল।

Radio station এর মালিক এর কাছে এবার খবর চ্যানেলের লোকেরা জড়ো হয়েছে দেখে  ননী ও সেদিকে গেলো। গতকাল বিকেলে এক ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে গোটা radio station . প্রায় ৪ ঘন্টার চেষ্টায়, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ৫জন কর্মচারী মারা যান। আগুনটা লেগেছিলো power room থেকে। তারপর গোটা অফিসটাই ধরে যায়। সময় মত বেরিয়ে আসায় সেই সময় অফিসে উপস্থিত অনেকে বেঁচে গেলেও ৫জন ফিরতে পারেনি।

মালিকের কথাগুলো শুনে নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস হয়না ননীর। প্রথমে চিৎকার করে, শেষে গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কাও দিতে যায়। কিন্তু হওয়ার মত সেও যেন অবয়বহীন। কেউ টেরও পায়না তার উপস্থিতি। ছুটে যায় অফিসের দিকে। আগুন যদি লেগেই থাকে, সকালের এতটা সময় সে কি নিয়ে কাটালো? দরজার সামনে যেতেই অবাক হয়ে যায়। মেঝেটা ছাই ও জল মিশে কাঁদায় ভরে আছে। Reception এর কঙ্কালসার কাঠামোটা কালি মেখে পরে আছে। দেয়ালের গায়ে কালকের অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষ দিচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে studio তে যায় সে। সকালে যা নিয়ে সে কাজ করল, সেগুলো একটাও আর পূর্ববর্তী চেহারায় নেই। সব হিসেবে কেমন যেন গোলমাল হয়ে গেল। নিজের ঘরের সামনে যায় সে। দরজাটা আলতো ঠেলা দিতেই খুলে গেল। সেই বার্নিশ করা frame টা এখন আগুনের তাপে ফেঁপে ওঠা তক্তা ছাড়া কিছুই নয়। নিজের ঘরের কোণ দিয়ে একটা sofa ছিল। কাল দুপুরে ওই sofa তে বসেই বইটা পড়ছিল সে। কাছে গিয়ে sofa র চারপাশে খুঁজতেই মলাটের পাতা দেখা গেলো।

গতকাল দুপুরে lunch সেরে এই বইটা নিয়েই পড়তে বসেছিল সোফায়। তারপর কোন ফাঁকে ঘুমিয়ে গেছে সে টেরও পায়নি। ঘুমের মধ্যে সুন্দর স্বপ্নের রচনা করেছিল সে। নিজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় কে নতুন করে উপলব্ধি করেছিল সে। ইছামতির ধারে ফিরে গিয়েছিল আবার। নিজের ডিঙি নৌকো নিয়ে আবার ভেসেছিল শান্ত স্রোতে। আজ মৃত্যুর এ'পারে এসে জীবনের সব গতি, সব হিসেব এলোমেলো হয়ে গেলো। এই Radio station এর প্রত্যেকটি ইট তার হাতে মাপ করে বসানো। সেই ইটের পাঁজরেই আজ তার সমাধি। নিজের মৃতদেহ টা দেখার শখ হয় একবার। কিন্তু কোথায় নিয়ে গেছে, সেটা  জানবার উপায়ও যে এখন নেই।  দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে নিচে শোকসভায় সমবেত লোকেদের দেখতে থাকে। এদের মধ্যে অনেকেই অচেনা। হয়তো এরা সেই শ্রোতারা, যাদের জন্যে একটা ছোট্ট ঘরের কোণে বসে দিনের পর দিন microphone এ মুখ রেখে কথা বলে যায় তারা। অদৃশ্য থেকেও তারা জীবন্ত, আকাশবাণী হিসেবে। আজ সে নিজেও অদৃশ্য। ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে যেন নেই। এ এক নতুন অধ্যায় তার জীবনের। Radio station এ যার নতুন করে সূচনা।   

         




কোন মন্তব্য নেই: