বুধবার, ২৭ মে, ২০২০

Pencil Box



।। পেন্সিল বক্স ।।

/১/
বিবারের সন্ধ্যাগুলো সবচেয়ে প্রিয় সময় সিদ্ধার্থর। ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকের বারান্দায় একান্তে নিজের মতন করে আরাম চেয়ারে বসে গল্পের বই পড়া। সাথে এক কাপ ধূমায়িত চা আর প্রিয় বিস্কুট। এমনি বিস্কুট অবশ্য তার মুখে রোচে না। সেই স্কুল জীবনের অভ্যেস চায়ের দোকানে বসে সন্দেশ বিস্কুট দিয়ে চা খাওয়া। বাড়িতেও সেই একই রেওয়াজ নিয়মিত। ব্যাচেলর জীবনের একটা দীর্ঘ অধ্যায় পেরিয়ে এখন সে সমাজের একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ। স্ত্রী পুত্র নিয়ে একটা ছিমছাম সুখের গৃহকোণ। তবু পুরনো অভ্যেসের যে টুকু বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই চেষ্টা করে।

“ওগো শুনছ? বাবুর একটা পেন্সিল বক্স আনতে হবে। পুরনোটা ভেঙ্গে ফেলেছে”।

এই একটা নতুন কণ্ঠস্বর এখন সংসারের যাবতীয় সুখ দুঃখের সঙ্গী। স্ত্রী ডাকছে, সেই মুহূর্তে বারান্দায় বসে গল্পের বই পড়া অত্যন্ত অবিবেচকের মতন কাজ হবে। অগত্যা গদি ছেড়ে ঘড়ের দিকে যাওয়া।

/২/
বাবা, আমায় একটা পেন্সিল বক্স দেবে?” বাবার পাঞ্জাবীর হাতা ধরে হাল্কা আদুরে টান দিয়ে বলে সিধু।
“নিশ্চই দেবো বাবা। এই মাসটা যাক। পরের মাসেই তোমার জন্য নতুন পেন্সিল বক্স এনে দেবো”।

সিধু অবশ্য তাতেই খুশী। আজ সকালে সে তার বাবার সাথে বেড়িয়ে ভবানীপুরের বিখ্যাত কচুরি আর জিলিপি খেয়েছে। তারপর সাউথ হাই স্কুলের সামনে তাকে নামিয়ে দিয়ে বাবা অফিস চলে গেছে। পেন্সিল বক্সের প্রাপ্তি সম্পর্কে কৌতূহল আজ সারাদিন তার মনের আনাচে কানাচে খেলা করে বেরিয়েছে। রোদের আলোয় বালির কণা যেমন চিকচিক করে। আজ তার খুশিগুলিও যেন সেরকম চিকচিক করছে।

আসলে তার ক্লাসে একটি নতুন বাচ্চা ভর্তি হয়েছে এই বছর। ব্যাটার বাবা হয়ত খুব বড়লোক। খোকার ব্যাবহারে দামী জুতো, স্কুল ব্যাগ, জলের বোতল, এমন কি পেন্সিল বক্সটা পর্যন্ত একদম বড়লোকি দেমাগে আত্মগরিমায় বুক ফুলিয়ে থাকে। সেদিন ফাইনাল বেলের পর সিধু ফার্স্ট বেঞ্চের নতুন ছেলেটির কাছে গিয়ে পেন্সিল বক্সটা হাতে নিয়ে দেখছিল। কি সুন্দর নরম গদি করা গায়ে। তাতে আবার কার্টুন আঁকা। দুপাশ থেকে খোলা যায়। ভিতরে অনেক খানি জায়গা। মাথার দিকে আবার আলাদা করে ইরেজার আর শার্পনার রাখার জায়গা। সিধু দেখছে, এমন সময় সেই দাম্ভিক ছেলেটি বলে ওঠে “তুই আমার পেন্সিল চুরি করছিস?”

ছেলেপিলের মধ্যে এমন গোলযোগ অনেক হয়। কিন্তু বড়লোকের ছেলেপুলে মা-বাপের সাহায্য নিতে পছন্দ করে বেশী। দুটো ঘুসি আর চুল টানাটানি করে ক্লাসের শেষে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। আর তাতে হার সেই বড়লোকের ছেলেটিরই হয়েছিল। কিন্তু স্কুল থেকে বেড়িয়েই ছেলেটির মা এসে সিধুর হাত চেপে ধরে।

“তুই আমার ছেলের পেন্সিল চুরি করতে গিয়েছিলি?”

একজন অভিভাবকের চিৎকারে আরও কিছু উৎসুক অভিভাবক জড়ো হয়ে যায়।

“দেখুন কাণ্ড। এই বয়স থেকেই চুরি করা শিখছে। আজকে পেন্সিল চুরি করছে কাল টাকা পয়সা। কচু গাছ কেটেই ডাকাত হয়”।

সিধু কচু গাছ আর ডাকাতের সম্পর্ক ঠিক কিরকম আন্দাজ করতে পারেনি। শুধু মাথা নিচু করে দুবার বলার চেষ্টা করেছিল “আমি চুরি করতে যাইনি”।
কেউ যে তার কথা শুনছেও না সেটা বুঝতে পেরে আড় চোখে একবার সেই বড়লোকের ছেলেটির দিকে দেখেছিল। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে হাল্কা একটা ফিচেল হাসি নজরে পরল। বড়লোকের ওই স্বভাব। তারা গরীবের মজা উড়িয়ে হয় মানে মারে নয় ভাতে।পরদিন সকালেই তাই বাবার কাছে প্রথম আবদার একটা পেন্সিল বক্সের জন্য।
/৩/
চাকরী নেই মানে?”

রাতে ঘুমের মধ্যে মায়ের চিৎকার শুনতে পেয়ে উঠে বসে সিধু। আজকাল মা-বাবা রোজ ঝগড়া করে। এই জিনিসটা বড্ড খারাপ লাগে সিধুর। ঝগড়া করে ওই ভাঙ্গাচোরা বাড়িতে যারা থাকে তারা। তার মা-বাবা ঝগড়া করবে এ’যেন একেবারে ভাবাই যায়না। অন্যান্য দিন ঝগড়া হলে অনেক আগেই থেমে যায়। কিন্তু আজকে যেন অশান্তির স্থায়িত্বকাল বেশ দীর্ঘ। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে বাবাকে খোঁজার চেষ্টা করে সিধু।

-আস্তে কথা বল। সিধু ঘুমাচ্ছে।

-তুমি আমায় আগে বলোনি কেন? আজ ছ’মাস তোমার চাকরী নেই। আর সে’কথা তুমি আমায় বলবে না?

-ভেবেছিলাম একটা কিছু হিল্লে হয়ে যাবে। কিন্তু এতদিন ধরে চেষ্টা করেও কোন ফল না হওয়ায় আজ বলছি।

-তোমার আক্কেল জ্ঞান কবে হবে একটু বলবে? বাবা ঠিকই বলেছিল। তোমার মত ছেলেরা শুধু মেয়েদের ভোগ করতে জানে। দায়িত্ব নিতে না।

-এ’কথা তোমার বাবা তোমায় বলেছিলেন?

-তুমি আগে বল চাকরী গেল কি করে?

-কারখানায় তালা পরেছে।

-সেকি।

-হুম

ঘটনা গুলি কিছু কিছু বোধগম্য হলেও মা-বাবার এইজন্য ঝগড়া করবার কারণ সিধু বুঝে পায়না। সেই রাতের পর থেকে নিয়মিত ঝামেলা শুরু হয়। মাঝ রাতে উঠে সিধু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে তার মা-কে কাঁদতে। একদিন মা কি যেন একটা বলেও ফেলেছিল বাবাকে, আর তারপরেই বাবা চড় মেরেছিল। ব্যাস! পরেরদিন সকালেই মা জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে দেয়। সিধু কোথায় থাকবে সেই নিয়েও বচসা শুরু হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ বাবাই জিতে যায় অ স্থির হয় সিধু বাবার সাথে থাকবে।

/৪/
সেই রাতে ভালো করে ঘুম আসেনা সিদ্ধার্থর। স্বপ্নে কেবল বাবা আর সেই রাতের ঘটনা ভেসে উঠছিল। ভোর রাতের দিকে সে হঠাৎ দেখে, ভীর ট্রেনের কামড়ায় সে একটি বাচ্চাকে তুলে দিয়ে কোন রকমে লোহার রড ধরে উঠে দাঁড়ায়। আর তারপরেই ভিড়ের ঠেলা সামলাতে না পেরে হাত স্লিপ খেয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে পরে যায়।

ধরমর করে উঠে বসে সিদ্ধার্থ। সুতির জামাটা গায়ে একদম চিটে বসে গেছে ঘামে ভিজে। এরকম দুঃস্বপ্ন সে আগে কোনদিন দেখেনি। জয়া তখন ঘুমের ঘোরে। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় চলে আসে। বাবার মুখটা বারবার চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
সারাদিন অফিসেও একই অবস্থা। থেকে থেকে কিছু পুরনো ঘটনা মনে পরে যাচ্ছিল। কোন রকমে অফিসের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে জয়া ফোন করে।

“শুনছ! বাবুর পেন্সিল বক্সটা নিয়ে এসো। আর একটা হরলিক্স”।

পাড়ার মোরে একটা নতুন বই খাতার দোকান হয়েছে। ফেরার পথে সেখানেই আগে যায়। বাচ্চাদের জন্য নানা রকম পেন্সিল বক্স দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা বিশেষ পেন্সিল বক্সের দিকে নজর যায়।

/৫/

-না না, এই পেন্সিল বক্সটা নয়।
-তাহলে কোনটা?
-আরে ওই যে। দুদিকে পেন্সিল রাখা যায়। রবার আর কলকাটার রাখার জন্য আলাদা জায়গা আছে। বড় দেখতে।
- এইরকম?

দোকানদার হাতে করে যেটা নিয়ে আসে সেটা তার স্বপ্নে দেখা পেন্সিল বক্সের থেকেও অনেক সুন্দর দেখতে। এমনকি স্কুলের সেই বড়লোক বাচ্চাটার থেকেও সুন্দর দেখতে। নীল রঙ্গের বক্স। তার গায়ে নরম গদি লাগানো। সেখানে স্পাইডার ম্যানের ছবি। এক পাশে পেন্সিল রাখার জন্য আলাদা করে খোপ বানানো আছে। মানে সে এক রাজসিক ব্যাপার। আবেগের চোটে পেন্সিল বক্সটা হাতে নিয়ে জড়িয়ে ধরে সিধু।

-দাম কত?
- দুশো টাকা।

দোকানদার ও তার বাবার মধ্যে পরবর্তী কথোপকথন সে আর শোনেনি। শুধু পেন্সিল বক্সের সাথেই আত্মমগ্ন হয়ে নানান অলীক স্বপ্নের মধ্যে বিচরণ করতে শুরু করেছে।

এরপর সে তার বাবার সাথে একজন দুষ্টু লোকের বাড়িতে যায়। লোকটাকে সে আগেও দেখেছে। আর প্রথম দিন থেকেই সে বিশেষ পছন্দ করেনা লোকটাকে। কথায় কথায় বাবাকে ধমকি দেয়, বকাবকি করে। বাবা চুপচাপ শুনে যায়। বাবা যে কেন এর কাছে আসে কে জানে? বাবাও এমন বোকা এই হদ্দ কালো মোটা লোকটাকে সাহেব সাহেব বলে ডাকে।

সেদিন সন্ধ্যায় কিন্তু সিধুর বিশেষ হুশ নেই লোকটার প্রতি। নতুন কেনা পেন্সিল বক্সটা হাতে নিয়ে এক দৃষ্টে সেদিকেই চেয়ে আছে। সিধু যতটুকু আন্দাজ পেয়েছে, এই লোকটার অনেক গাড়ি আছে। নিজের গাড়ি নয়, ট্যাক্সি। সিধুর বাবা ওই ট্যাক্সি চালায়। রোজ বিকেলে সিধুকে স্কুলের থেকে নিয়ে বালিগঞ্জে একজন টিউটরের কাছে পৌঁছে দিয়ে আসে। মা চলে গেছে দু’মাস হয়েছে। বাপের বাড়ি থেকে এখনও আসেনি। সিধু জানে মা এমন আগেও করেছে। দাদুর বাড়ি গেলে মা অনেকদিন থাকে। কিন্তু এইবার যেন একটু বেশী। রাতে মাকে পাশে না পেয়ে ভয় পেয়ে বাবার কাছে গিয়ে শুয়েছিল সিধু। বাবাকে জিজ্ঞেস করায়, বাবা বলেছিল। এইটা যেমন তোর বাবার বাড়ি। তুই এখান থেকে কোথাও গিয়ে বেশিদিন ভালো থাকতে পারবি না। তোর মায়েরও ওইটা বাবার বাড়ি। তাই মাঝে মধ্যে গিয়ে থেকে আসে। এত অকাট্য যুক্তি সিধু হজম করে নিয়েছিল। অতি সহজেই ব্যাপারটা সরল ভাবে নিয়ে সে নিজের ঘড়ে গিয়ে শুয়ে পরেছিল।

-সাহেব। আজ যদি কিছু টাকা অগ্রিম দিতেন। আসলে বাড়িতে বাজার নেই।
-থামা তোর কাঁদুনি। তেল চুরি করে করে তো আমায় ডুবিয়ে ছাড়বি তোরা। আমি কিছু জানিনা ভেবেছিস?

চুরি শব্দটা শুনে কেমন যেন খটকা লাগে সিধুর। তার বাবাকেও চোর বলল?

-আমি তেল চুরি করিনা সাহেব।
-তুই থাম। গাড়ির ডিঁকিতে জলের বোতলে তেল কে রেখেছিল? চুরি তুই করিসনা?
-সে তো তেল ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে কাটা তেল কিনেছিলাম। আসেপাশে কোন তেলের পাম্প ছিলনা বলে। যতটুকু বেঁচে ছিল রেখে দিয়েছিলাম।
-তুই যে কত বড় চোর। তা আমার জানতে বাকি নেই বুঝলি? যা ভাগ এখন এখান থেকে।

সিধু ছলছলে চোখে দেখল তার বাবাকে। কেমন নীরবে মাথা নিচু করে গাড়ির চাবিটা তুলে দিল মালিকের হাতে। তারপর সিধুকে নিয়ে বেড়িয়ে এল সেই বাড়ি থেকে। এর পর গোটা রাস্তা বাবার সাথে কোন কথা হয়নি। পেন্সিল বক্সের আনন্দে খিদের কথা বলতেই ভুলে গিয়েছিল সে। এখন এগরোলের দোকানের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে পেটের ভিতর খিদেটা কেমন যেন আনচান করে উঠল। খিদেই যত নষ্টের গোঁড়া। খিদে না পেলে মানুষ কত নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করতে পারত। বাবাকে খিদের কথা বলবে কিনা ভাবছে এমন সময় বাবা নিজেই যেন সিধুর মনের কথা বুঝতে পেরে এগ রোলের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো।

/৬/

-দাদা, কোনটা দেবো?

দোকানীর ডাকে সিদ্ধার্থর ঘোর কাটে। তার পছন্দ করা পেন্সিল বক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে দাম জিজ্ঞেস করে।
বাড়ি ফেরার বাকি পথটুকু সে কিভাবে আসল খেয়াল নেই। বাড়ি ঢুকেই কোন কথা না বাড়িয়ে সে একটা চেয়ার নিয়ে পুরনো জিনিস রাখা লফটে ওঠে। এক এক করে বাক্সগুলো নামাতে শুরু করে সিদ্ধার্থ।

-আরে কি হল?

জয়া এসে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পরে সিধুর কাণ্ড দেখে।

-আরে ওটায় কাঁচের জিনিস আছে। সাবধানে।

কোন কথাই এখন সিদ্ধার্থর কানে পোঁছাচ্ছে না। সেই পুরনো বাক্সটা। মা মারা যাওয়ার পরে ও’বাড়ি থেকে যে জিনিসগুলো এসেছিল। তার মধ্যেই থাকার কথা। পাগলের মতন খুঁজতে শুরু করে সে। এই তো সেই দ্বাদশ শ্রেণীর জীবন বিজ্ঞান বইটা। এই বাক্সেই থাকবে।

সিদ্ধার্থর উন্মাদের মত কাণ্ড দেখে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে জয়া রান্নাঘরে চলে গেছে।

/৭/

-বাবা, তুমি খাবে না?
-না বাবা। তুই খা। আমার খিদে পায়নি।
এগ রোলের দাম মিটিয়ে বাবা সিধুর হাত ধরে স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। গরম এগ রোলটা দুটো কাগজ দিয়ে পেঁচিয়ে নিলেও সিধু হাতে ধরে রাখতে পারছে না। এই তাদের রোজকার রুটিনের চেনা পথ। বাপ ব্যাটা মিলে রোজ রাতে এই পথে স্টেশনে যায়। তারপর সেখান থেকে ট্রেন ধরে টালিগঞ্জ স্টেশন।

সবটাই রোজকার নিয়ম মাফিক ছন্দে হলেও রাত ৯ টার ট্রেনে সেদিন ভিড়টা একটু বেশী। ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মের গায়ে লাগতেই ধাক্কাধাক্কি শুরু। এর আগের ট্রেনটা ক্যান্সেল হয়ে যত বিপত্তি। কোন রকমে বাচ্চা বলে সিধু এর তার মাঝখান দিয়ে কিছুটা ভিতর দিকে চলে যায়। কিন্তু তার বাবা কোন রকমে রড ধরে উঠে দাঁড়ায়। গতি নিয়ে নেয় ট্রেন। বাইরের দিক থেকে প্রচণ্ড ধাক্কা আসছে। কিন্তু লোকের ভীরে একচুল জায়গা পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব।সেই ভিড়ের মাঝেও নতুন কেনা পেন্সিল বক্স হাতের মুঠোয় আগলে রেখেছিল সিধু। স্টেশন ছেড়ে ট্রেন গতি নিতে শুরু করে। দরজার দিক থেকে বাবার আওয়াজ একবার শুনতে পায় সিধু।

-সিধু। ঠিক ঠাক দাঁড়াতে পেরেছিস তো?

সিধুও পাল্টা হ্যাঁ বলতে গিয়েছিল। কিন্তু তারপরেই একটা গদাম করে শব্দ, আর বাকীদের হায় হায় আওয়াজ। একটা অসম্ভব সম্ভাবনার জটিল কুয়াশা যেন এক নিমেষে সিধুকে আঁকড়ে ধরে। এই ঘন কুয়াশা কাটিয়ে কাছের জিনিসও কেমন যেন ঠাহর করা যায়না। কয়েকজন বয়স্ক লোক পরের স্টেশনে সিধুকে নিয়ে নেমে যায়। তারপর পুলিশের ঘড়ে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকা। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে মায়ের সাথে দেখা হয় সেই স্টেশনের অফিস ঘড়ে। মায়ের চোখে জল দেখে তখনও আন্দাজ করতে পারেনি সিধু কি হয়েছে। এরপরের ঘটনাগুলি কালের নিয়মেই হয়ত মুছে গিয়েছিল সিধুর মন থেকে। শ্মশান ঘাটে পরের দিন দুপুরে যাওয়া দাদু দিদার সাথে। সেখানে একটা কালো লোহার দরজার সামনে বাবার শরীরটা শুয়ে আছে। কপালের কাছে জমাট বাধা রক্ত। একজন ঠাকুর মশাই যেমন যেমন বলে গেলেন, ঠিক তাই করল সিধু। মাটির পাত্র থেকে জল নিয়ে বাবার ঠোঁট ভিজিয়ে দিল। তারপর চাল কলা মাখা একটা পিণ্ড নিয়ে গলার কাছে রাখল। প্যাকাটির মাথায় আগুন দিয়ে বাবার মুখে ছোঁয়ানো। গতকাল সন্ধ্যাবেলাই সে বাবার মুখের কাছে এগ রোল নিয়ে এক কামড় খেতে বলেছিল। আর আজ দুপুরেই সব শেষ। গঙ্গায় গিয়ে অস্থি ভাসিয়ে দিয়ে কেমন যেন গা গুলিয়ে ওঠে সিধুর। বাবার ওই চেহারা সে মনে করতেই শরীরটা খারাপ লাগে।

/৮/

-কি হল তোমার? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?

চা নিয়ে এসে সিদ্ধার্থ কে দেখে ঘাবড়ে যায় জয়া।

-এই সিদ্ধার্থ! কি হয়েছে তোমার?

অলস শরীরে বাক্স থেকে একটা প্লাস্টিকে মোড়ানো পেন্সিল বক্স বের করে সিদ্ধার্থ। এখনও নতুন রয়েছে ব্যাবহার না হওয়ায়। আর তার পাশেই পরে রয়েছে হুবহু এক দেখতে আজকের কেনা নতুন পেন্সিল বক্স।

© পাগলা দাশু


Image:
Copyright: (c) Irina Kvyatkovskaya | Dreamstime.com

কোন মন্তব্য নেই: