মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০২০

The Plummet 2.0???

নৌকো ডুবি ২.০???

হওয়ার তালে, পালের টানে নৌকো দিব্য চলেছিল এগিয়ে। নদীতে তখন ভরা উজান। ঢেউ এর ওপর ঢেউ। সাগর পারে এসে নৌকো ভরাট শুরু হলো। মজদুর এলো, পাইক এলো, বিদ্বান এলো, মূর্খ এলো, নাবিক, বরকন্দাজ, পাল বাহক, মাল বাহক, এটা সেটা, অমুক তমুক আরো কত কি। হঠাৎ নৌকোর যে মেরামত করে, সে এসে জানান দিলে নৌকোর ঠিক মাঝ বরাবর একটা ফুটো হয়েছে। মোটর রুমে জল ঢুকছে। কিছু একটা করা দরকার। নৌ প্রধান বললে "কিস্যু হবে না। এই টুকু তো পথ। সাত দিনের যাত্রা। ঠিক পেরিয়ে যাবো। জল বের করে ফেলার জন্যে আরো কিছু মজদুর নাও।"  যেমন প্রস্তাব তেমন কারবার। বন্দর থেকে মাল ও যাত্রী বোঝাই নৌকো, পারি জমালো সমুদ্র পথে। 

যাত্রীরা কেউ জানে না নৌকোর মাঝে ফুটো। তাই দিয়ে যে ক্রমাগত জল ঢুকছে। তারা তো নিজের আমেজ এ মত্ত। সাগর পাড়ে বেড়াতে এসে তাদের যেন ছুটির মেজাজ। একবার নৌকোর ছই এর ওপর ওঠে। কেউ আবার সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে স্নান করে। কেউ লগী ধরে টান মারে। কেউ মাস্তুলে চড়ে বসে থাকে। কেউ আবার মাছ ধরার জাল নিয়ে সাগরে ফেলে। কানকো টিপে মাছ না নিলে কি আর পোষায়??? এদিকে নৌকোর দোলা চালে জল ভরে বেশি। এত লোক হয়ে ওজন ও হয়েছে বেশি। তবু যাত্রীদের কোনো হেলদোল নেই। তারা দিব্যি লাফায়, নাচে গায়। কি যায় আসে?

এমন সময় দ্বিতীয় দিনে, সাগর তখনো বেশি গভীর নয়। এই পথে যাওয়া আরেকটি ডিঙ্গি নৌকা মাঝ পথে খারাপ হয়ে যাওয়ায়, এই নৌকার প্রধান খবর দিলেন ডিঙ্গি যাত্রীদের তুলে নিতে। আর তো মোট পাঁচ দিনের পথ। ঠিক হেসে খেলে কেটে যাবে। ভাঙ্গা ডিঙ্গি থেকে যাত্রী এলো শেষে। নতুন যাত্রীদের সবাই হাত তালি দিয়ে অভ্যর্থনা করে নৌকায় তুলে নিলো। কেউ কিস্যু টের পেলো না। নৌকায় জল যেন আরো স্রোতে প্রবেশ শুরু করলো। ওদিকে পাটার ওপরে উৎসব, এদিকে খোল ভর্তি জল। মেরামতির কারবারি, জল বের করার শ্রমিক সব মিলে নাজেহাল। ক্রমে পেরোলো তৃতীয় দিন।

তৃতীয় দিনে নৌকা যেন মাঝ সমুদ্রে হাহাকারে। চারিদিকে নির্দিষ্ট দূরত্ব মেনে সব নৌকা স্থবির হয়ে আছে। সামনে বিশাল তুফান। এখানে অব্দি আসতেও আর দেরী নেই। তবু যদি প্রকৃতি সদয় হয়, তাই ভয়ে আর কোনো নৌকা এগোতে সাহস পায়না। ঝরের মধ্যে পাছে ঠোকাঠুকি লাগে, তাই সবাই নির্দিষ্ট দূরত্বে নোঙর ফেলে ভাসছে। আসন্ন ঝড়ের কথা ভেবে প্রমাদ গুনছে আর অপেক্ষা করছে আগত প্রলয়ের। আমাদের আলোচ্য নৌকোর প্রধান ও ঠিক বুঝে নোঙর ফেলতে বললেন। মেরামতির লোক, জল ফেলার লোক, বৈঠা বাহক সবাই হা হা করে উঠলো। হায় একি হলো। এই উন্মত্ত যাত্রীদের সাথে ঝড়ের মাঝে ফুটো নৌকায় থাকা আর কাঠের টুকরো সম্বল করে স্রোতে ভাসা একই ব্যাপার। কিন্তু কি আর করা। প্রধান যখন ঠিক মনে করেছেন। তাই হবে। 

আমরা ডাঙায় যে ঝড়ের সাথে অভ্যস্ত, সমুদ্রে তা আরো হিংস্র। উঁচু উঁচু ঢেউ এর বাড়ি এসে পরে নৌকার পাটা তে। নোঙর করলে নৌকায় যে দুলুনি এসে লাগে তাতে অর্ধেক লোকের বমি ছোটে। চতুর্দিক কালো করে অধার মেঘ ঘনিয়ে এলো। ঝড়ের হালকা ঝাপটা দিতেই নৌকা ভীষণ দুলে উঠলো। আর তাতেই যাত্রী কিছু একেবারে টাল সামলাতে না পেরে জলে পরে গেলো। মাঝি মাল্লা আর মেরামতকারী  জলে ঝাঁপিয়ে পরে কিছু যাত্রীকে উদ্ধার করে। বাকিরা সলিলে সমাধি। এক জায়গায় দাড়িয়ে গেলে নৌকায় জল ঢোকে বেশি। এদিকে কোনো উপায় নেই। জল বেড় করার কর্মীরা হাত টেনে কাজ করে যেতে থাকে। কিন্তু এক পোয়া জল টানলে তিন পোয়া জল হুস হুস করে খোলার ভিতর ঢোকে। তার ওপর ঝড়ো হওয়ার দাপটে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ এসে নৌকায় চড়াও হয়। তার জলেও খোলা ভেসে যায়। 

মেরামতির কর্মীরা সাবধান করে। তারা নৌ প্রধান কে স্পষ্ট জানায় একেই ঝড়ের দাপটে এত দুলুনি। তার উপর যাত্রীদের কোলাহলে মত্ত নৌকার ভাঙ্গা অংশ মেরামত করা যাবে না। নৌ প্রধান বুঝলেন সব। নির্দেশ দিলেন সব যাত্রীকে এক জায়গায় বসে থাকতে। সবাই সব কিছু শুনলে মন দিয়ে, বুঝলেও কিছু বিচক্ষ্ন লোক। কিন্তু মানুষের প্রবৃত্তি কে নিয়ন্ত্রণ করতে স্বয়ং ভগবান পারেন না তো সামান্য নৌ প্রধান। কিছু লোক হুট পাটি করে লেগে গেলো খবর সংগ্রহ করতে। কি এমন হলো যে একেবারে নৌকা নোঙর করে দাঁড়িয়ে গেল। শুধু তো দাড়িয়েই গেলো না একেবারে সবাইকে স্থির হয়ে বসার নির্দেশ দিলো। তারা এই প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ায় খবর সংগ্রহ করতে। কিছু যাত্রী মাছের জাল নিয়ে নৌকার কিনারায় গিয়ে বসে। টাটকা মাছের ঢের যখন সামনেই আছে খাবার কষ্ট করে কি কোন লাভ আছে?? তারা জাল ফেলে মাছ ধরে। পাটা তে উঠে হই হল্লা করে। কিছু লোক আবার মাছ ধরা দেখবে বলে নৌকার কিনারে যায়। কিছু মাছ খাবার লোভে যায়। সে এক অতি নাটকীয় পরিস্থিতি।

এমন সময় কোন এক খবর বাজ চুকলি কাটলো। খবর চাউর হলো নৌকায় যে ফুটো আছে। ব্যাস! আর কোথায় যাওয়া। নৌকার উপর যেন হুজ্জুৎ শুরু হয়ে গেল। যারা যারা মাছ ধরছিল কিছু উল্টে পরলো জলে। তাদের বাঁচাতে কিছু মাঝি ও ভেসে গেলো। কিছু যাত্রীকে হাঙ্গরে খেলো, কিছু যাত্রী ডুবে মরলো। যত খবর চাউর হয় কেউ মরেছে, যাত্রীরা তত বেশি হুট পুটি করে। আরো কিছু যাত্রী উল্টে পরে সমুদ্রের জলে। কিছু যাত্রী আবার কেমন করে নৌকায় জল ঢুকছে দেখার জন্যে খোলার মধ্যে ভিড় করে। সে এক হুলুস্থুল কান্ড। যারা মাস্তুলে চড়ে ফুর্তি করছিলো। নৌকোর দুলুনিতে টপাটপ জলে পরলো। আর তাদের বাঁচাতে মেরামতির কাজ বন্ধ রাখতে হয়। অযথা সময় নষ্ট হয়। নৌকায় আরো জল ঢুকে পরে। জল ঢোকার পথ বন্ধ করার কোন উপায় নেই দেখে নৌ প্রধান মেরামতির লোকদের ডেকে পরামর্শ করলেন। ঠিক করা হলো কিছু মেরামতির লোক সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে জলের তলা থেকে গিয়ে নৌকার ফুটো অংশ মেরামত করবে। ঝড়ের আসতে এখনো বেশ কিছু দিন। যাত্রীরা যদি একটু সংযত হয়, নৌকার কিছু হলেও একটু উন্নতি হবে। অন্তত জলের গতি আটকানো যাবে। অতিরিক্ত লোক তুলে এখন বিপদ বেড়েছে। তো যেমন ভাবা তেমন কাজ। মেরামত এর কিছু লোক ঝাঁপ দিল জলে। কিন্তু কি আর করা। জল ভর্তি হাঙ্গর। অস্ত্র না থাকায় প্রথম দিকের সব মেরামতির লোক হয় আহত হলো, নয় মরে গেল। নৌ প্রধান এর আর কি দোষ? সব্জি কাটার ছুরি হাতে দিয়ে মেরামতির লোকদের আবার জলে নামিয়ে দিলো। 

আরে!! মেরামতির লোকেরা তো শুকনো জমিতে কাজ করে অভ্যস্ত। এমন মাঝ সমুদ্রে কাজ করা যায় নাকি? তার ওপর কেউ তো আর ডুবুরি নয় যে জলের নিচে অত সময় দম ধরে রাখবে। ব্যাস! শুরু হলো কষ্ট। একটু করে ডুব দেয়ার পরেই উঠে আসে হাফাতে হাফাতে। যাত্রীরা সব নৌকার উপর থেকে গালি গালাজ করে। কেউ উপদেশ দেয়, কেউ আবার ঢিল ছোড়ে। জল বের করার লোকে এসে বাধা দিলে লাথি মারে গালি দেয়। নৌ প্রধান হতাশ হয়ে মাথা চুলকায় আর ভাবে। একটু একটু করে ঝড় এগিয়ে আসছে। কি যে হবে??? এদিকে মজুত করা খাবার শেষের পথে প্রায়। সাত দিনের হিসেবে মাল নেওয়া। সেই মাল নিয়ে এত গুলো লোকের কদিন আর চলে। যাত্রীরা কিন্তু বেজায় ফুর্তিতে আছে। কিছু লোক আতঙ্কে ছুটে বেড়ায়। কিছু লোক কিছু না ভেবেই জলে ঝাঁপ দেয়। কিছু লোক ভাবে বেশী দূর তো আর আসিনি সাগর পথে। তাই বাড়ি যাবে বলে জলেই ঝাঁপ দেয় উল্টো পথে সাঁতরে যাবে বলে। এত অরাজকতা তে কি আর মেরামতির কাজ হয়?? নাবিকরা সব প্রমাদ গোনে। হাল বাহক হাল ছেড়ে দেবার কথা ঘোষণা করে। বৈঠা বাহক আর মাস্তুলবাজ ঘোষণা করে নৌকা ভারী হচ্ছে বলে হাল্কা করা দরকার। জল বেড় করার কাজে কিছু যাত্রী এগিয়ে আসে। কিন্তু কত আর সম্ভব? এই সব কাজে মেহনত এর থেকেও অভিজ্ঞতা লাগে বেশি। এখন পালা নৌকা হাল্কা করার। কি করা যায় কি করা যায় অনেক পরিকল্পনা করেও কোনো উপায় খুঁজে পাওয়া যায়না। এমন সময় মাতাল মাঝি এসে খবর দিল, ওই দেশে বিক্রির জন্য নৌকায় অনেক পেটি মদ উঠেছে। কিছু মদের বোতল জলে ফেলে দিলে নৌকা হাল্কা হবে। মাঝির প্রস্তাব যথেষ্ট যুক্তির। আর কোনো কথা নেই। খুলে দেওয়া হলো মদের পেটি। হাল বাহক যারা হাল ছেড়ে দেবে ভেবেছিলো, তারা বললে, "আরে দাড়ান মশাই দাড়ান। দুম করে অমন মদের বোতল ফেলে দেবেন না। এত যাত্রীদের জন্য নৌকার যে ক্ষতি হলো, তার একটা খরচ নেই??? একটা কাজ করুন মশাই। যাত্রীদের বলা হোক যে মদের বোতল বিক্রী আছে। তোমরা কিনে খাও বা ফেলে দাও, মোট মাট নৌকা হাল্কা হওয়া চাই।"

এমন প্রস্তাব কার না ভালো লাগে?? মাঝ দরিয়ায় ঝড়ের মুখে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে করতেও মদের সাহচর্য পেতে। একবার খবর জানাজানি হতেই যাত্রীদের মধ্যে সে কি উন্মাদনা। এদিকে পয়সা নেই বলে নৌকায় ওঠার সময় ঠিক মত ভাড়া দেয়না। কিন্তু মদের বেলায় ঠিক পয়সা আছে। এই না হলে মানুষ?? ব্যাস!! বোতলের পর বোতল বিক্রি হলো, পেটি সব খালি হলো, ফাঁকা বোতল জলে গেল। নৌ প্রধান এর ঘরে পয়সা এলো। মেরামতির খরচা থেকেও অনেক উপড়ি বরং জমা হলো। হাল বাহকরা বেজায় খুশি। কিন্তু তারা যেটা ভাবেনি সেটাই হলো অবশেষে। এত মাল পেটে গেলে স্বয়ং ঈশ্বর নিজের মতি স্থির রাখতে পারেন না সেখানে এরা তো সাধারণ মানুষ। নৌকার উপর হুলুস্থুল লেগে গেলো। যে সব মেরামতির লোকেরা প্রায় নৌকার ফুটো বন্ধ করে এনেছিল, আবার সেই কাজে ব্যাঘাত ঘটলো। নৌকার এত দুলুনিতে কাজ করা সম্ভব না তার ওপর জলের তলায় দম আটকে। নৌ প্রধানের কাছে তারা নালিশ জানায়। মাঝি মাল্লা কিছু মাতাল সামলাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কা কষ্য!! মাতাল হয়ে সব ছড়া কাটে। নৌকার মাস্তুলে চড়ে পদ্য আওড়ায়। আর কিছু জলে পরে। এদের আবার জল থেকে তোলার কাজ করতে গিয়ে কিছু মেরামতির কর্মী কেউ হাঙ্গরের পেটে গেলো, কিছু ডুবে মরলো। বেশ কিছু আহত হলো। 

আর যায় না সামলানো। নৌ প্রধান বললেন যা হয়েছে বেশ হয়েছে। আর অপেক্ষা করে লাভ নেই।  নৌকা নিয়ে ঝড়ের মধ্যে এগোনোর নির্দেশ দিলেন। যা থাকে কপালে। একটু একটু করে নৌকা এখন সেই ঝড়ের দিকে এগোচ্ছে। প্রকৃতি নিজেই ঝড় কে বন্ধ করে নৌকার উপর করুণা বর্ষণ করে সবাই কে বাঁচাবে, নাকি যাত্রীরা নিজেদের সংযত রেখে নৌ প্রধানের কথা শুনবে?? কি পরিণতি হয় এখন সেটাই দেখার। আর সেই অপেক্ষাতেই রয়েছে নৌকো ডুবির উপসংহার। 

(C) পাগলা দাশু

কোন মন্তব্য নেই: