রবিবার, ১২ মার্চ, ২০১৭

দন্ত-বিহঙ্গ 2

অর্ক ভট্টাচার্য্য 

                                                                     //১//
কোন একদিন: ~জ্যোতিষ গুরু দিব্যানন্দ ফটাফট~



সে'বার বিয়ের মরশুমটা বেশ মরা বাজার। দাঁতের যন্ত্রণা কাবু করে দিলেও, রুগীদের বিয়ে বাড়ি গিয়ে মাংস খাওয়া স্থগিত হবে, সেই ভয়ে কেউ আসেনা দেখাতে। বাজার মন্দা হলেও রোজ নতুন উদ্যমে চেম্বার খোলেন  ড: পুন্য রঞ্জন শিকদার। রোজ আসেন, চেম্বার খোলেন, ঝার-পোছ করেন। দুপুরে সরু চালের ভাত, ফিনফিনে মুসুর ডাল আর ঝুড়ি ঝুড়ি আলুভাজা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করেন। বিকেল হলেই ফটিক গিয়ে চা, সিঙ্গারা বা আলুরচপ নিয়ে আসে। ফটিক আজ ছ'মাস হল সহকারী হিসেবে কাজে লেগেছে। বিকেলে টিফিন হলে একটু বেরিয়ে আসেন শিকদার মশাই। বাজারের কাছেই হলদি নদীর চর। বাঁধ পেরিয়ে কিছু পথ গেলেই নদী। সূর্যাস্তটা বড় অনুভূতি প্রবন এই হলদি নদীর পারে। চামুরদহের বাজারের পোস্ট-অফিসের কাছে এক বাড়ির নিচে একটি ঘর নিয়ে তার চেম্বার। আজ দু'বছরে চেম্বারের উন্নতি অনেকখানি হয়েছে। কেবল চটে যাওয়া রঙ বা খসে পরা প্লাস্টারের খরচটা তুলতে পারেননি শিকদার মশাই। এইতো গেল শুক্রবার, হাট বসেছিল। বাজার করতে আসা মানুষের দল থেকে চারজন এলেন চেম্বারে। দু'জন তাঁর সুখ্যাতির কথা শুনিয়ে নিজেদের দাঁত সারানোর বরাত ও দিয়ে গেলেন। কেবল সামনেই চারটে বিয়ে বাড়ি আছে বলে কাজ করালেন না।  

নিজের মনেই খবরের কাগজের নজর কারা খবরগুলো নিয়ে ভাবছিলেন শিকদার মশাই। এমন সময় দরজায় টোকা। 

"ডাক্তারবাবু আছেন নাকি?" বাইরে থেকে প্রশ্নকর্তার রাশভারী কন্ঠস্বর ও আবেগ প্রবন আলাপ শুনে মনটা বিগলিত হয়ে যায়। শিকদার মশাই প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই চেয়ার ছেড়ে উঠে যান আগত ব্যক্তিকে স্বাগত জানাতে। ঘরের মধ্যে যিনি এলেন, দেখলেই ভক্তি জাগে। পরনে ধুতি আর মখমলের পাঞ্জাবি। কাঁধে উত্তরীয়, নিপাট করে টেরি কাটা চুল। ভুরু যুগল যেন বাধভেঙে একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। পুরু ঠোঁটের ওপর এক চিলতে গোফ। ঠোঁটের কোণে পানের লাল দাগ। এতদিন পরে এমন রুগীর পায়ের ধুলো পড়ল এই চেম্বারে। মনটা উরু উরু করতে থাকে। একমাসের খরচ উঠে যাবে প্রায় এনার মুখে যা যা কাজ হতে পারে। আপ্যায়ন করে চেয়ারে বসান শিকদার মশাই। ফটিক দুপুর অব্দি অপেক্ষা করে কাজ নেই দেখে বাড়ি গেছে খেতে। নিজেই দাঁত পরীক্ষা করার সব সরঞ্জাম খুঁজে নিয়ে চেয়ারের কাছে আসেন শিকদার মশাই। 

"হাতিবের চকের শ্যামলাল সামন্ত আমার মক্কেল। তার কাছে আপনার নাম শুনে আসা।" গোটা ঘর যেন ভদ্রলোকের কন্ঠস্বরে গমগম করে উঠল। শ্যামলাল সামন্তকে মনে পড়েনা শিকদার মশাই এর কিন্তু তবু সম্মতি সূচক ভাবে মাথা নাড়েন। আগত রুগী আবার বলে ওঠেন। 
"আপনার হাত নাকি কথা বলে মশাই। নিখুঁত ভাবে দাঁত মারি থেকে তুলে আনতে নাকি আপনার জুড়ি মেলা ভার?"

"হে হে, কি যে বলেন?" মাথা নিচু করে ঘাড় চুলকে নেয় শিকদার। তারপর মুখের ভিতর দেখার ছোট্ট আয়না তুলে নিয়ে প্রশ্ন করে, "বলুন কি সমস্যা?"

"আজ এক মাস হল, আমি দাঁতের যন্ত্রনা সহ্য করছি। আশেপাশে অনেকে আছে, কিন্তু ভরসা হয়নি বলে যাইনা।  শ্যামলাল বাবু সেদিন আমার দাঁত ব্যাথার খবর পেয়ে আপনার কথা বললেন।"

"কোন দিকে ব্যাথা?"

"ডানদিকের নিচের পাটি।  সব দাঁতেই এখন ব্যাথা। গোড়ার দিকে মালুম পেতাম কোন দাঁত দায়ী। এখন পুরো মারিতেই যন্ত্রনা।" রুগী মুখ খুলে মাথা হেলান দিয়ে বসেন। 

"পান খেয়ে তো সব দাঁতেরই অবস্থা খারাপ। ডানদিকের নিচের পাটির দাঁতগুলো নড়ছে রীতিমত।" শিকদার ডাক্তার রুগী দেখে নিজের জায়গায় গিয়ে বসেন। প্রেসক্রিপসন টেনে নিয়ে লেখা শুরু করেন। 

"আপনার নাম?

চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের সামনে রাখা একটা টুল নিয়ে বসেন রুগী, তারপর বলেন।

"আমার নাম যোগী দিব্যানন্দ ফটাফট।"

"আজ্ঞে?" একটু হোঁচট খান শিকদার মশাই। এমন নাম জম্মে শোনেন  নি। 

"আমার নাম দিব্যানন্দ ফটাফট, বয়স দুই কুড়ি চার বছর।"

"আপনার দাঁতের যা অবস্থা, তাতে নড়ে যাওয়া দাঁতগুলো ফেলে দিতেই হচ্ছে। একমাস সময় নিয়ে মারি শুকিয়ে গেলে দাঁত বাধানোর কাজ করতে পারবো। সেই অবসরে যদি আপনি সময় দেন, বাকি দাঁত গুলির মেরামত করে নেওয়া যায়। যেমন আপনার দুটো দাঁতে সিল করতে হবে, প্রায় চারটে দাঁতে চিকিৎসা করে crown দিতে হবে। আর সবার আগে দাঁতগুলি পরিষ্কার করতে হবে।"

প্রেসক্রিপসন লিখে ওষুধ আর কি কি খরচ হবে বুঝিয়ে বলেন শিকদার মশাই। তারপর দাঁত ফেলার জন্য তারিখ বাছতে গিয়ে দিব্যানন্দ বাবু বলে ওঠেন। 

"এখনো বিয়ে করেননি কেন?"

হঠাৎ এমন প্রশ্নে বেশ হতচকিত হয়ে যান শিকদার মশাই।  "সময় হয়নি আরকি। কেন?"

"দেখি আপনার হাতখানা।" কিছু বোঝার আগেই শিকদারের ডান হাত নিয়ে দেখতে শুরু করেন দিব্যানন্দ বাবু। 

"হুম! বিবাহ স্থানে শনির যোগ। আপনার বুঝি শনিবারে জন্ম? গোধূলি লগ্নে?"

ভদ্রলোকের কন্ঠের দৃপ্ত ভঙ্গি, আর চিবুকের কাঠিন্য শিকদার মশাইকে ভালোই বশ করে নেয়। 

"ছেলেবেলা থেকেই বুঝি অমনোযোগী? পড়াশোনায় মন ছিল না?"

শিকদার আবার সম্মতি সূচক ঘাড় নেড়ে জবাব দেয়। 

"ধনস্থানে কেতুর যোগ। বিষয়-আসয় খুব বেশি করে উঠতে পারেননি।"

"আজ্ঞে কি করে করি বলুন? মাস গেলে সাকুল্যে আট আনা আয় হলে, চোদ্দ আনা ব্যায়। বাকি টাকা জোগাড় করতে ধারকর্জ করতে হয়। তার ওপর বাজারের যা অবস্থা। বিয়ে করলে খাওয়াবো কি? তাই আর। ..."

"হুমম!" গভীর মনোযোগের সাথে হাতের রেখার দিকে চোখ রাখেন দিব্যানন্দ। 

"আপনার এই লাইনে আসা ঠিক হয়নি মশাই। ব্যবসা আপনার হাতে নেই। তার মানে আপনি ডাক্তার ভালো নয়, সে'কথা ভাববেন না। কিন্তু এটাও তো একরকম ব্যবসা। আপনি বড় সরল মানুষ। আপনাকে ঠকিয়ে লোকে  বড়লোক হয়ে যাবে, কিন্তু আপনি উন্নতি করতে পারবেন না। এবার থেকে কোন চুক্তি কারো সাথে করলে দেখবেন বামদিকের চোখ ফরফর করে কাঁপছে কিনা। যদি কাঁপে বুঝবেন রাম ঠকা ঠকবেন। "

"তাহলে উপায়?" শিকদার বেশ আতঙ্কিত ভাবেই জিজ্ঞেস করে ফেলে। 

"চিন্তার কিছু নেই। কেতু কে শান্ত রাখতে ও বৃহস্পতির কৃপা পেতে পোখরাজ ধারণ করুন। বিবাহ স্থানে বুধের উপস্থিতি আপনার জন্যে একটু সুবিধা দিত। কিন্তু সে উপায় করতে হলে আপনার একটা ছক বানাতে হবে। তারপর। ....."

"আজ্ঞে বিয়ের থেকেও আমার টাকার প্রয়োজনটা বেশি। যদি সে'ব্যাপারে কিছু?" শিকদার মশাই বলে ফেলেন।

"ঐশ্বর্য লাভ কি এতই সোজা? মূলাধার চক্রে ঠেলা দিয়ে, কুল-কুন্ডলিকার আজ্ঞাক্রমে সূর্যের অবস্থান পরিবর্তন করতে হয়। গ্রহের অবস্থান পাল্টে ফেলে বৃহস্পতির কাল বিচার করতে হয়। সেই কালে সময়ের অক্ষ স্থাপন করে কালের উল্টো স্রোতে সহস্র ধারার মাঝে ধনস্থানে কেতুর আবাহন করতে হবে। সে কি আর এতই সহজ বাবা?"

"আজ্ঞে না। তাহলে?" বেশ হতাশ হয়েই বলেন শিকদার মশাই।

"আর কিছুই না, মুক্ত ধারণ করুন নিজেকে শান্ত রাখতে। সোমের কৃপায় মতি যেন স্থির থাকে। রোজ সকালে উঠে পুব দিকে চেয়ে সূর্য প্রণাম করুন নিয়ম মেনে। বৃহস্পতি র মঙ্গলবারে ক্ষুর ছোয়াবেন না। শনিবারে নিরামিষ খান। আর তেলেভাজা খাওয়া ছাড়ুন। এঁটো তেলের রান্না আপনার রাহুস্থানে নিয়ামক। শনির শক্তিও বৃদ্ধি পায়। "

সব বুঝে নিয়ে বেশ ঘাবড়ে যান শিকদার মশাই। ফটিক না এসে পড়লে ঘোর কাটতেই না। রাশিফল, গ্রহ-নক্ষত্রের আবহাওয়া যেন এখনো আছন্ন করে রেখেছে শিকদার কে। শিকদার এর মোহগ্রস্ত ভাব বোধয় টের পেয়েছিলেন দিব্যানন্দ। একটা মিহি কাশির ধমক এনে উঠে পড়েন।

"আচ্ছা, আজ তাহলে আসি। এই ওষুধগুলো ধারে-কাছের দোকান থেকে পাওয়া যাবে তো?"

একটু সময় লাগে শিকদারের নিজেকে ফিরিয়ে আনতে।  তারপর আশ্বাস দেয় সব ওষুধ এখানেই পাওয়া যায় বলে। দিব্যানন্দ পাঞ্জাবির পকেটে প্রেসক্রিপসন ভরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।

"আজ্ঞে আমার fees ৫০টাকা।" শিকদার উঠে দরজার কাছে যান।

"আমার fees ২৫০টাকা। আমি জ্যোতিষগুরু দিব্যানন্দ ফটাফট। ব্রজলালচকে আমার চেম্বার। ছক বানাতে ৪০০টাকা, সমস্যা সমাধানের জন্যে রত্ন আমার কাছেই পাবেন। একমাসের মধ্যে এলে আপনার জন্যে special discount এর ব্যবস্থা করে দিতে পারি। আজকের fees টা নিলাম না। তবু আপনার সাথে সমান করতে, আমি ২০০টাকা পাই। আপনি নেহাতই নবীন আমার থেকে। তাই কিছু চাইলাম না। ঠিক আছে, আজ চলি। নমস্কার।"

বামদিকে চোখের নিচটা কেমন যেন ফরফর করে কেঁপে উঠলো শিকদার মশাইয়ের। অস্তগামী সূর্য লাল আবির ছড়িয়ে দিয়েছে সবদিকে। পথে লোকের আনাগোনাও বেড়েছে। চা দোকানি উনুন ধরিয়েছে, তার ধোয়া গোটা বাজার জুড়ে। ঐপারে তেলেভাজার দোকানে বড় কড়াইতে ডালডা ঢালা হল। ব্যস্ত বাজারের ব্যস্ত পথ নিজের মতোই চলতে থাকে। এক কোণে ভাঙা বাড়ির নিচে এক চিলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিকদার ডাক্তারের বামদিকের চোখের নিচ তখনো ফরফর করে কাঁপছে।





  


মূল কাহিনী কাল্পনিক। বাস্তবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। স্থান, কাল ও পাত্র সম্পূর্ণ কল্পিত চিত্রণ।

ছবি: S. Rai




1 টি মন্তব্য:

Nill বলেছেন...

Your storie nice and wonderfull storie