বৃহস্পতিবার, ২৩ মার্চ, ২০১৭

প্রতিবিম্বে 


                                                                         //১//
"কি চাও কি তুমি? কাজে এত অমনোযোগী হলে চলবে?...... আমি তোমার সাথে কথা বলছি দোলা!" নিজের চেয়ার থেকে উঠে আসেন অবিনাশ মিত্র, দোলার Project leader. দোলা টেবিলের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিল। অবিনাশ বাবু একবার ঝুঁকে দোলার চোখের দিকে দেখে, ব্যাঙ্গের হাসি দিয়ে ঘরের কোণে রাখা coffee machine এর দিকে এগিয়ে যান।

"এই তোমাদের মত মেয়েদের জায়গা কোথায় জানোতো? ঐ রান্নাঘরে। কাজে ভুল করে ফেলবেন, আর এদিকে boss কিছু বললেই চোখে জল চলে আসে। অন্যের sympathy কুড়িয়ে কাজে উন্নতি করবে ভেবেছ?" coffee cup নিয়ে নিজের জায়গায় ফিরে আসেন অবিনাশ। 

নিজের অজান্তেই হাতে থাকা file টা আরো বেশি খিমচে ধরেছিল দোলা। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল নিজেকে সংযত রাখার জন্যে। পায়ের পেশিগুলো গরম হয়ে উঠেছিল দেহের ভারে। তবু অবিনাশের কথাগুলো তাকে শুনে যেতেই হবে। চাকরিটা এখন আর শুধু তার প্রয়োজন নয়, ভরসার জায়গাও বটে। উপার্জন বলতে পরিবারে সে একা। গত তিন বছর এই company তে accounts section এ কাজ করে সে। উন্নতির সম্ভাবনা যে ছিলনা, তা নয়। কিন্তু অন্য মেয়েদের মত সময় দিতে, overtime করতে, বা নিদেন পক্ষে পুরুষ মানুষের চোখের খিদে মেটানো পোষাক পরতে সে ব্যর্থ। আজও তাই সেই একই ঘরের কোণে, রঙ খসে পরা দেয়ালের ধারে একটা ছোট্ট টেবিলে তার ঠিকানা বরাদ্দ। গতকাল office আসার পরেই তার টেবিলে Roy Enterprise এর file টা এসে পৌঁছায়। Tender wise quotation বানাতে হবে। গত বারো বছর ধরে এই tender তার company নিয়ে এসেছে। গত বছর Marketing manager মৌসুমীর সাথে সে-ও গিয়েছিল Roy enterprise এর MD এর সাথে দেখা করতে। কত স্বচ্ছল স্বাভাবিক ভাবে মৌসুমীদিকে সে দেখেছে হাসতে, কথা বলতে। কিন্তু সে কেন এভাবে কথা বলতে পারেনা, দোলা জানেনা। একটা জড়ত্বের প্রাচীর যেন ঘিরে ধরে তাকে। পরিচিত শব্দগুলোও তখন আবদ্ধ হয়ে যায় জিভের আড়ষ্টতায়। 

তাদের যাত্রা সফল হলেও, ফিরে আসার পর থেকে দোলার চাকরি জীবনে একটা অন্ধকার কালো মেঘের ছায়া যেন আবহ বিস্তার করে। মৌসুমীদির মনে হয়নি দোলা এই রকম meeting এর উপযুক্ত 'item' বলে। কাজেই অবিনাশ এর কাছে report যায় সেইভাবে। এই বছর তাই একই ভাবে মৌসুমীদি meet করতে গেলেও, দোলার প্রয়োজন পরেনি। 

গতকাল tender দেখে, গত বছরের quotation এর সাথে tally করিয়ে নতুন quotation তৈরী করেছিল সে। কিন্তু নতুন কিছু সংযোজনে VAT এর পরিমাণ 4.7% এর বদলে 14.7% করতে হোত। আর তাতেই এই বিপত্তি।

"চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?" coffee cup এ চুমুক দিয়ে ধমক দিয়ে বলেন অবিনাশ। 

"Am sorry sir." দোলার অস্পষ্ট শব্দগুলো যেন ceiling fan এর আওয়াজের সাথে মিশে হারিয়ে যায়। 

"Sorry? কি বিরাট বড় ক্ষতি হয়ে যেত সেটা আন্দাজ করার ক্ষমতাটুকু আছে তোমার? অবশ্য থাকবেই বা কি করে। তিন বছর ধরে একই জায়গায় পরে আছো। না আছে নিজের উন্নতির চিন্তা, company র উন্নতি থোড়াই care কর। হিসেবে বাকি থাকা  tax এর টাকাগুলো কি তুমি pay করতে?"

শ্বাসনালীর কাছে কথাগুলো দলা পাকিয়ে উঠছিল। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। মনের মধ্যে চেপে রাখা প্ৰতিবাদগুলি পিঞ্জর আবদ্ধ বেয়ারা হাতির মত দামাল হয়ে উঠছে। কিন্তু সব কথা শুধু চোখের জল হয়ে পরিণতি পায় দৃষ্টিকে আরো ঘোলাটে করে দিয়ে। 

"আমি জানি তুমি কেন এরকম করেছ।" অবিনাশের চোখে একটা হীন দৃষ্টি। দোলাকে আজ অপমানিত করার নেশা যেন তার মাথায় সওয়ার। "মৌসুমীকে এত হিংসে তোমার? 

দোলা অবাক হয়ে অবিনাশের দিকে তাকায়। নিজের company র ক্ষতি করবে বলে সে এমন ভুল করেছে? অবিনাশ কি তাই বলতে চায়? আর মৌসুমিদিকে সে হিংসে করতে যাবেই বা কেন?

"অমন অবাক হয়ে যাওয়ার মত কিছু হয়নি। মৌসুমীকে হিংসে কোরোনা। ওঁর থেকে শেখার চেষ্টা কর। তোমার থেকেও নিচু post এ চাকরি পেয়ে এসেছিল এই company তে। আজ দেখ সে কোথায় পৌঁছে গেছে।"

"কিন্তু আমি স্যার।........." দোলার কথাগুলি মাঝ পথেই বাধা পায়। 

"তর্ক করনা। তোমার মনে কি চলছে আমি জানি। নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছ কখনো? একটুও approachable তুমি? office এ কারো সাথে সদ্ভাব আছে তোমার? একেবারেই presentable নয় তুমি। নিজের মত আসো, যাও, সাদা ভূতের মত ঘুরে বেড়াও। এভাবে চললে, তোমার উন্নতি খুব কঠিন।"

প্রসঙ্গটা আরো দূর যেত হয়ত, কিন্তু subordinate প্রসূন এসে পড়ায় ইতি রচনা করতে হয় অবিনাশকে। "Quotations এ ৭টা item এ 14.7% VAT add করে নতুন print বার কর। Soft copy টা আমায় mail এ পাঠিয়ে দাও, আজকের মধ্যেই।" কথাগুলো শেষ করে file টা একরকম ছুড়েই দিলেন অবিনাশ। 

"স্যার, আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দরকার ছিল।" দোলার কথাগুলো অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতই নতুন উত্তাপ সৃষ্টি করে। 

"তুমি কি ঠাট্টা করতে রোজ আসো office এ? গত দু'মাসে সাত থেকে আটবার ছুটি নিয়েছ তুমি। বাড়িতে বসে থাকলেই তো হয়? Company accounts সামলাতে বলে তোমার নামে বরাদ্দ মাইনেটা নিয়ে যেতে মাসে মাসে।"

"স্যার, বাড়িতে একটু। ........"

নিজের মেজাজ হারিয়ে বসেন অবিনাশ। "প্রসূন, তুমি ওকে বলে দাও এই মুহূর্তে যেন আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কোন ছুটি হবেনা। আজকের মধ্যে quotation যেন আমার email এ blink করে।"

প্রসূন একবার দোলার দিকে তাকায়। রুমালে চোখ মুছে ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের department এ চলে আসে দোলা। একটু জল খেয়ে নিয়ে mobile টা নেয়। 

"বাবা কেমন আছে এখন?" উদ্বেগটা যেন সমস্ত আবেগ সহ কন্ঠস্বরে প্রতিফলিত হয়। 

"তুই ছুটি পেলি?" ওপাশে মা-এর কন্ঠেও ভীতির ছাপ স্পষ্ট। 

"না। কাজে চাপ আছে। আচ্ছা তুমি ভেবোনা। আমি দেখছি কি করতে পারি।"

ফোন কেটে দোলা একটা sms করে দেয় ইন্দ্রকে। নিজের পরিস্থিতি, আর যেতে না পারার কারণটাও জানায়। তারপর washroom থেকে চোখে মুখে জল দিয়ে এসে quotation টা correction করতে থাকে। 


                                                                          //২//
"আজ এত দেরী হল?" দরজা খুলে দোলাকে দেখে প্রশ্ন করেন দোলার মা। 

"Boss আজ খুব রেগে ছিলেন। ছুটি চাইবার সাহস পাইনি তাই। ইন্দ্র এসেছিল?" জুতোটা খুলে বসার ঘরে সোফায় নিজের ব্যাগটা রাখে দোলা। lunch box আর জলের বোতলটা বার করে। 

"তুই আগে স্নান সেরে আয়, তারপর সব বলছি।" 

নিজের ঘরে এসে পোষাক বদলাতে গিয়ে আয়নায় চোখ যায় দোলার। এগিয়ে যায় আয়নার সামনে। সকালে অবিনাশের কাছে শোনা কথাগুলো মনের মধ্যে আবার প্রতিধ্বনিত হয়। সত্যিই কি সে presentable নয়? approachable নয়? দুশ্চিন্তায় মুখে একটা অকাল বার্ধক্যের ছাপ এসেছে ঠিকই। রক্তাল্পতায় ভুগে মুখটা আরো ফ্যাকাশে। চোখে কাজল দিতে আর ইচ্ছে হয়না তার। মনে হয় দু'চোখের কোল ছাপিয়ে যেন সেই কাজল প্লাবন এনেছে। বাবার অসুস্থতায় পালা করে রাত জেগে থাকতে হয়। ঘুমের অভাবে সেই ছাপ চেহারায় স্পষ্ট। ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে যায় বলে তাড়াহুড়োয় office বেরোয়, তাই সাজগোজের সেভাবে অবকাশ মেলেনা।

"খাবার গরম করছি। বেশি দেরী করিসনা।" বাইরের ঘর থেকে মা-এর কন্ঠস্বর শোনা যায়। 

সব চিন্তার পালায় ইস্তফা দিয়ে bathroom এ যায় দোলা। 

খাবার পালা শেষ করে বাবা কে দেখে নিজের ঘরে আসে। তার মা তখন ব্যস্ত বিছানা করতে। সারাদিনের নিত্য ব্যস্ততায় এই সামান্য কিছু সময় দু'জনে share করে এক সাথে। মা তার চুলে তেল মাখিয়ে বিনুনি করতে করতে সারাদিনে ঘরের খবর শোনায়। আবার দোলা নিজের office এর গল্প করে। 

"ইন্দ্র এসেছিল?" চাদরটা পাততে সাহায্য করে দোলা। 

বিছানা পেতে এক কোণে বসে মেয়েকে কাছে ডেকে নেন। "হ্যা এসেছিল।" মেয়ের চুলের খোঁপা খুলে চিরুনি দিয়ে আচড়ে বলতে শুরু করেন। 

"তুই office বেরিয়ে গেলি। তারপরেই তোর বাবা কে খেতে দিলাম। ঠিক করেই খেল সবটা। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই bathroom এ গিয়ে বমি। আর একদম রক্ত বমি। ঘাবড়ে গিয়ে তোকে phone করে বললাম একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস। সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা।"
মাথা সরিয়ে নিয়ে মা-এর দিকে ফিরে বসে দোলা। "তারপর?"

"আমি কি আর একা সামলাতে পারি? ভাগ্য ভালো মুদি দোকানের ছেলেটা সেই সময় এসেছিল জিনিস দিতে। তোর বাবাকে ওর হাতে দিয়ে ডাক্তার কে phone করতে গেলাম। কিন্তু এমন ছাই phone কিনে দিয়েছিস, মাথা-মুন্ড কিচ্ছু বুঝি না। ওদিকে তোর বাবা ডেকেই চলেছে। শেষে একটু সুস্থ হলে পুরোনো prescription ঘেটে ডাক্তার কে phone করলাম। মুদি দোকানের ছেলেটা কে লিখে দিতে ও এনে দিল ওষুধ।"

"ডাক্তার কাকুকে একবার আসতে বলতে?" দুপুরের ঘটনাগুলো নিজের সকাল থেকে ঘটে যাওয়া অভিজ্ঞতা কে ফিকে করে দেয়। 

"সে তো out of station. প্রায় ঘন্টা খানেক এই যুদ্ধ করে তোর বাবা একটু সুস্থ হলে তোকে phone করলাম। Switch off শুনে বুঝলাম meeting এ আছিস বোধয়। এদিকে বমি করার পরেই তোর বাবা এমন নেতিয়ে পড়ল ভয় করছিল। শেষে ওই ছেলেটাকে দিয়েই পাড়ার কৌশিক কে ডেকে  পাঠালাম। সে এসে সব দেখে শুনে ওষুধ দিয়ে গেল। তারপরেই তুই phone করলি, কিছু পরেই ইন্দ্র এলো। ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। অনেকক্ষন বসে তারপর গেল।"

"ইন্দ্র কোন ডাক্তারকে এনেছিল?" দোলার ভয়গুলো আরো আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। 

"ওদের বাড়ির কাছেই একজন medicine এর ডাক্তার। খুব ভালো ব্যবহার। সব দেখে শুনে বললেন আপাতত ভয়ের কিছু নেই। যা ওষুধ পড়েছে ঠিকই আছে। কোন দরকার পড়লে তাকে যেন খবর দেওয়া হয়।"

মেয়ের মাথাটা কাছে টেনে নিয়ে এলোমেলো ভিজে চুলগুলো আবার সাজিয়ে নেন। বুকের ভিতরে একটা শূন্যতা যেন অনুভব করে দোলা। মা-এর কোলে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে কোমর। চোখের জল গড়িয়ে পরে মা-এর শাড়িতে। 

                                                                       //৩//
ইন্দ্র, দোলার কলেজ জীবনের বন্ধু। বন্ধুত্ব ক্রমে প্রণয়ে পরিণতি পায়।  ইন্দ্রদের বাড়িতে দোলাকে পছন্দ না হলেও, দোলার পরিবার ইন্দ্রকে মেনে নেয়। কলেজ শেষে দোলা চাকরিতে join করে, আর ইন্দ্র নিজেদের পারিবারিক ব্যবসাতে। বন্ধুত্বের বাইরেও সম্পর্কের গভীরতা বাড়ছিল, হয়ত বিয়ের প্রসঙ্গও এসে যেত। কিন্তু বাঁধ সাধল দোলার বাবার অসুস্থতা। একটানা দু'সপ্তাহ জ্বরে ভোগার পর হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। সবরকম test করিয়ে অবশেষে ধরা পরে Hepatitis B থেকে meningitis আর Liver cirrhosis। প্রায় একমাস হাসপাতালে কাটিয়ে ফিরে আসেন দোলার বাবা। এর পর থেকেই ক্রমাগত অসুখ বাড়তেই থাকে। অসুস্থতা, office এর ব্যস্ততা, সংসারের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে দোলা আর ইন্দ্রের সম্পর্কে একটা চির যেন দেখা দেয়। তবু বাবার জন্যে রাত জাগার সময় ইন্দ্রকে phone এ সময় দিত সে। কিন্তু ইন্দ্র যেন দূরত্বটাকে সহজভাবে নিতে পারছিল না। 

মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মোবাইল এ একটা sms পাঠায় দোলা। chat box এ reply ও এসে যায়। 

-'ajker jonne thanks. :) tumi ja korle aj.'

-'Hmm. thik ache. phn korbo?'

-'aj khub tired lagche. kal kotha boli?'

-'ok. gdnt then. bye.'

-'bye. thanks again.'

-'welcome. :)'

বালিশে মাথা রাখতেই একরাশ ঘুম যেন ঝাঁপিয়ে নেমে আসে চোখে। Boss এর কথা, বাবার অসুস্থতার কথা, Office এ কাজের কথা সব যেন ধুয়ে মুছে একটা নির্বাক, অন্ধকার স্বপ্নরাজ্যে নিয়ে যায় তাকে। বিছানার সাথে গোটা শরীরটা যেন মিশে যেতে চায়।

                                                                    //৪//
Office থেকে বেরিয়েই ইন্দ্রকে phone করে দোলা। সতেরো টা missed call ছিল, খেয়াল করেনি সে। আজ office এ board meeting ছিল। Mobile এর silent mode off করতে ভুলে গিয়েছিল। তাই টের পায়নি ইন্দ্রর call গুলো। এ'বছর company নতুন target declare করেছে। Production বাড়াতে হবে, সেই অনুপাতে খরচ এর হিসেবেও পরিবর্তন আসবে। একটা সম্ভাব্য recession এর খবর শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু director দের মতে, আরেকবার চেষ্টা করে দেখা যেতেই পারে। শেষ ৫ বছরে সমস্ত Debtors আর creditors এর list বানাতে হবে। Accordingly payment schedule আর collection করতে হবে। List বানাবার দায়িত্ব এবার দোলাকে দেওয়া হয়েছে। Conference hall থেকে বেরিয়ে অবিনাশ দোলাকে বলে দিয়ে গেছেন এটা একটা সুযোগ নিজেকে worthy প্রমাণ করার। একটা বড় কাজের দায়িত্ব পেয়ে দোলার মনটা বেশ ফুরফুরে। Office এর সিঁড়ি দিয়ে নেমে footpath এ উঠে call টা করে।

"Really sorry, mobile টা silent ছিল। বল কি খবর?"

"এ আর নতুন কি। হে হে!" ওপাশ থেকে ইন্দ্রর কন্ঠস্বরে সামান্য খাদের আভাস স্পষ্ট।

"কি হয়েছে?" রাস্তায় গাড়ির শব্দে ভালো করে কথা শোনা যাচ্ছিলনা। দোলা নিজের speaker volume টা বাড়িয়ে নেয়।

"একবার দেখা করা যায়?" ইন্দ্র নিজের গলাকে আরো খানিকটা খাদে নামিয়ে বলে।

ঘড়িতে সাতটা বাজতে পাঁচ। ঘড়ি দেখে নেয় দোলা।  হাতে কিছুটা সময় আছে। "কোথায় দেখা করবে বলো?"

"Same place. সরোবর?"

"Metro তে উঠে phone করে দিচ্ছি। তুমি সময় বুঝে চলে এসো।"

আজ প্রায় মাস খানেক পর তারা সরোবরে বেড়াতে এলো। এখানে একটা ফুচকার দোকানে গন্ধ লেবু দিয়ে ফুচকা বানায়। প্রথম দিকে ইন্দ্র ফুচকা খেত না। দোলার পাল্লায় পরে অভ্যাস হওয়ায় এখন দোলার থেকেও বেশি ফুচকা খায় ইন্দ্র। আজ অবশ্য ফুচকা খাবার ইচ্ছে ছিল না। ইন্দ্রকেও একটু ব্যস্ত বলে মনে হল। পার্কের একটা বড় তেঁতুল গাছের নিচে বাঁধানো বসার জায়গা বেছে নিয়ে দু'জন গিয়ে বসে। ইন্দ্র পকেট থেকে একটা খাম বের করে দোলার হাতে দেয়।

"কি এটা?" দোলা খামটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করে।

"বাবা কিছু টাকা পাঠালেন। তোমার এখন প্রয়োজন আছে। তোমার বাবা এত অসুস্থ।" ইন্দ্র একটা সিগারেট ধরিয়ে বলে।

"আমার এখনই লাগবেনা। তোমার কাছে রেখে দাও। বড় কোন দরকার পড়লে সাহায্যতো চাইবোই।"
দোলা খামটা এগিয়ে দেয়।

"ওটা তোমার কাছেই থাক। পরে আমি যদি না থাকি?"

কথাটার মধ্যে লোকানো আক্ষেপটা টের পায় দোলা। ইন্দ্রকে আজ বড় অন্যরকম লাগছে। অন্যান্য দিন দোলার সামনে সিগারেট ধরালেও এত বিকট গন্ধটা আসেনা। আজ তার মানে অনেকগুলো খেয়েছে ইন্দ্র। বলে বলে এক প্যাকেট সিগারেট থেকে এখন দিনে ২-৩টে সিগারেটে নামিয়েছে দোলা। ইন্দ্রর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে

"তোমার কাজের জায়গায় কোন সমস্যা হয়েছে?"

সিগারেটের শেষ টানটা অনেক্ষন বুকের মাঝে চেপে রাখে ইন্দ্র। সমস্ত উত্তাপটা প্রশ্বাসে সীমাবদ্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলে। একরাশ ধোয়ার সাথে বাষ্পীয় কিছু শব্দ ভেসে আসে দোলার কানে।

"আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।"

ইন্দ্রর কাঁধ থেকে হাতটা নিজের অজান্তেই নেমে আসে। দোলার শরীরটা কেমন যেন দুর্বল বলে মনে হয়। বেঞ্চের ধারটা খিমচে ধরে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে।

"কার সাথে?"

"বাবার এক বন্ধুর মেয়ে। গয়নার দোকান আছে ওদের। বাড়ি থেকে সবাই মেনে নিয়েছে। আমাকেও তাদের পছন্দ হয়েছে।"

"আর তোমার?" বড় বোকা বোকা একটা প্রশ্ন করে ফেলে নিজেকেই নিজে ধমক দেয় দোলা।

"আমি হ্যা বলে দিয়েছি।"

"আমাকে একবার বলতে পারতে?  আজকের দিনের জন্য prepared থাকতাম তাহলে।" চোখের জল আর আসেনা দোলার। অবিনাশের কথা মত sympathy কুড়িয়ে বেঁচে থাকতে চায়না সে। কিন্তু আবেগ বড় বিশ্বাসঘাতক অভিব্যক্তি। কন্ঠস্বরে নিজের কষ্টটা প্রতিফলিত হয়ে পরে।

"আমাকে ভুলে যেও। আর পারলে আমার নম্বরটা মুছে দিও mobile থেকে।"

"নিশ্চই!" একটা ঢোক গিলে কষ্টটাকে প্রশমিত করে নেয় দোলা। "কিন্তু একবার জানতে পারি এ'ভাবে সম্পর্কটা শেষ করে দিলে কেন?"

"তুমি নিজেকে এই প্রশ্নটা করে দেখ। উত্তর পেয়ে যাবে।" আরেকটা সিগারেট ধরায় ইন্দ্র।

"আমার ভুলটা একটু বলে দিলে সুবিধা হয়।" মুখের সামনে ভেসে আসা ধোয়াটা হাত দিয়ে কাটিয়ে নেয় দোলা।

"ভুল তোমার কে বলল? ভুলতো আমি করেছি। তোমার মত মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে।"

"আমার মত মেয়ে?"

"তুমি বুঝতে পারোনা? আমার বন্ধুরা তাদের girlfriend নিয়ে movie যাচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছে। Weekends এ party করছে। আর আমায় দেখ? তোমার শরীর খারাপ, তোমার বাবার শরীর খারাপ, তোমার বাড়িতে এই, তোমার বাড়িতে সেই। আমি কোথায়? তোমার জীবনে আমি কোথায়?" ইন্দ্র উত্তেজিত হয়ে পরে।
"আমাদের সম্পর্কে কোনদিন তুমি আর আমি বিষয়টা গুরুত্ব পেয়েছে? বিয়ের আগেই যদি এরকম থাকে, বিয়ের পরে তো আর দেখতেই হবে না। পুরো দায়িত্ব আমার ঘাড়ে।"

খামটা মুঠোয় চেপে ধরে দোলা। তার ভালোবাসার তুল্য-মূল্য বিচারের পদ্ধতি দেখে নিজেই বিস্মিত সে। সত্যিই তাই। ইন্দ্রকে কিই বা দিতে পেরেছে? সামান্য শরীরের বদলে আর কোন দাবিকেই গুরুত্ব দিতে পারেনি সে। শরীরটাই বা দিল কোথায়? তার শরীর সুস্থ থাকলে তবে তো? তল পেটের কাছে ব্যাথায় প্রত্যেক মাসে তিন চারদিন অন্ধকার ভাবে কাটে দোলার। চোখের কোণে সামান্য জলের আভাস যেন দেখা দিল। খামটা নিয়ে ইন্দ্রর হাতে ধরিয়ে দেয়।

"ভালো থেকো। বিয়ে করে সুখী থেকো। এই টাকা আমার চাই না। শরীর বিক্রী করার মত পরিস্থিতি আমার এখনো আসেনি।"

চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায় দোলা। সম্পর্কের ইতি রচনা করা কঠিন হলেও, সেটা খুব সহজ ভাবেই মিটে গেল। দোলার জীবনে একজনের অভাব নিশ্চিত হয়ে যাওয়ায় অসহায় ভাবটা জাপ্টে ধরে। গোটা রাস্তা নিজেদের সুখের দিনগুলো মনে করে কাটে।

                                                                        //৫//
ঘরে ফিরে fresh হয়ে নেয় দোলা। আজকে বাবার সেরকম শরীর খারাপ হয়নি। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মা-এর কাছে এসে বসে। নিয়ম মাফিক মার কাছে সারাদিনের ঘটনা শোনায়। তারপর শুয়ে পরে। যাওয়ার আগে আলো নিভিয়ে দিয়ে গেছে মা। একলা ঘরের দেওয়ালগুলোয় রাস্তার সামান্য আলো এসে পড়ছে। পর্দাগুলো ইতস্তত ভাবে উড়ছে হাওয়ায়। সন্ধ্যেবেলা ইন্দ্র ও তার কথোপকথনগুলো মনে পরে যাচ্ছিল।
"নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছ কখনো?" "তোমার প্রয়োজন, তোমার বাড়ি, এ'সবের বাইরে কিছু ভেবেছ কোনদিন?"

নিজের মনেই হেসে ফেলে দোলা। Class IX এ পড়তে দোলার মা-এর পরে গিয়ে হাত ভেঙে যায়। স্কুল যাওয়ার আগে সকালের খাবার, বাবার টিফিন, নিজের টিফিন বানিয়ে নিত সে। উচ্চমাধ্যমিকের পর তার বাবার শরীর খারাপ হল খুব। বাবার অফিসে গিয়ে ছুটির দরখাস্ত জমা দেওয়া, Medi-claim এর আবেদন জমা দেওয়া। প্রতিদিন হাসপাতাল গিয়ে বাবাকে দেখে আসা, বাড়ির বাজার করা, ওষুধ-পথ্য কেনা, সব নিজেই সামলেছে। কলেজে final year এ হঠাৎ বাবার মুখ দিয়ে রক্ত আসে। নিজের হাতে সে রক্ত পরিষ্কার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। কোন ambulance পাওয়া যাচ্ছিলনা দেখে ক্লাব অফিসে গিয়ে পাড়ার একজনের গাড়ি যোগাড় তো সে নিজেই করেছে। সে গাড়ি আবার ব্যবহার হয়না বলে তেল ছিল না। মাঝরাতে petrol pump বন্ধ।  সেই বন্ধ petrol pump এর লোকের ঘুম ভাঙিয়ে, গাড়িতে তেল ভরে হাসপাতাল নিয়ে এসেছে বাবাকে। একবারের জন্যেও আফসোস হয়নিতো তার পাশে কেউ নেই বলে? তাহলে আজ হঠাৎ সবাই তাকে করুণার চোখে দেখছে কেন ভেবে পায়না। চোখের পাশ দিয়ে কান্নার স্রোত তখন বালিশ ভিজিয়েছে। চোখ মুছে উঠে বসে দোলা। বিছানা থেকে উঠে ঘরের দরজা লাগিয়ে আলো জ্বালায়।  ঘরের কোণে আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। সবাই তাকে করুণা করে, সে কি নিজেও নিজেকে করুণা করে? আয়নার সামনে একটা টুল নিয়ে বসে দোলা।

 চুলগুলো বাঁধন খুলে মেলে দেয় কাঁধের ওপর। পাখার হাওয়ায় কপালের সামনে কিছু চলে আসে। সেগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে কানের পাশে নিয়ে ফেলে। বেশ মিষ্টি দেখতে কিন্তু তাকে। চুলগুলো কি সুন্দর নরম। চোখের দিকে তাকালে নিজেরই ভালো লাগে নিজেকে। নিজের কথা ভেবে নিজেই হেসে ফেলে। আয়নায় সে হাসি প্রতিফলিত হয়। কে বলে, সে presentable নয়? approachable নয়? কলেজ life এ নাহলেও সাত জন propose করেছে তাকে। Rose day, chocolate day তে কত ছাত্র উজাড় করে gift দিয়েছে, Valentine's day তে তার সঙ্গ পাবে বলে। সে'সব কিছু উপেক্ষা করেছে কত অনায়াসে। আর আজ তাকেই লোকে শোনায় সে presentable নয়? আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে আর মিচকি মিচকি হাসে। শেষে নিজেই বলে ফেলে। "আমি ছেলে হলে তোর প্রেমে পরে যেতাম রে পাগলি।"

স্বগোতক্তি, নাকি আয়নার মন্তব্য। বুঝে পায়না দোলা। কানের পাশ দিয়ে ঠান্ডা একটা ঘামের স্রোত বয়ে যায়। উঠে গিয়ে fan এর speed বাড়িয়ে দেয় সে। চুলগুলো আরো অবিন্যস্ত, বিক্ষিপ্ত ভাবে ছড়িয়ে আসে। আঙ্গুল দিয়ে চুল সরিয়ে মাথার পিছন দিকে নিয়ে যায়। আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের শরীরটাকে দেখে একবার। "উফ! এমন ভাবে তাকাস না আমার দিকে। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে তোকে। তোর গন্ধটা মেখে নিতে ইচ্ছে করছে খুব।"


বহুশ্রুত একটা গানের দু'কলি মনে পরতে গুনগুন করে ওঠে দোলা। কি মনে হল আয়নায় নিজেকে কোমর দুলিয়ে নাচলে কেমন লাগে সেটা দেখার ইচ্ছে হল। Charge থেকে খুলে mobile এ headphone লাগিয়ে নিজের পছন্দের "Sun and the Stars" গানটা চালিয়ে দেয়। নিজের খেয়ালেই দু'হাত মাথার পাশে নিয়ে গানের তালে দুলতে থাকে। মনটা বেশ ফুরফুরে বলে মনে হয়। আবার একই গান play করে, আলো নিভিয়ে শুতে চলে যায়।

                                                            //৬//
পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় দোলার। খুব মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখে উঠেছে সে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। স্নান সেরে আয়নার সামনে গিয়ে বসে। কাল রাতের ঘটনা গুলো মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দেয়। আলমারি খুঁজে নিজের একটা প্রিয় শাড়ি বের করে নেয়। সবুজ, লাল আর ময়ূরকন্ঠী রং মেশানো একটা hand-loom শাড়ি। চুলটাকে খোঁপা করে একটা clip দিয়ে বাধে। ঠোঁটে লাগিয়ে নেয় মেরুন lipstick. কাজল দিয়ে চোখ আঁকে আবার বহুদিন পর। তারপর আয়নায় নিজের প্রতিফলনের কাছে গিয়ে ঠোঁটে ঠোঁট রাখে।

"এই তো আমার মা-কে কি সুন্দর লাগছে আজ।" দোলাকে দরজার সামনে দেখে বলেন দোলার বাবা। রোজ সকালে office যাওয়ার আগে বাবার সাথে দেখা করে যায়। আজ অনেকদিন পর মেয়েকে এ'ভাবে সাজতে দেখলেন। দোলা বিছানার এক কোণে গিয়ে বসে।

"ঘুম হয়েছিল ভালো?" বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে দোলা।

"তোর কি মন খারাপ? বুড়ো বাপটা তোকে বড্ড জ্বালায়। তাই না রে মা?" দোলার হাতটা নিজের দু'হাতের মাঝে নেন দোলার বাবা।

"খুব জ্বালাও তুমি। ভাবছি এবার বিয়ে করে পালিয়ে যাব।" দোলা মুচকি হেসে বলে।

"কি কথা হচ্ছে বাপ্-বেটী তে?" চায়ের cup নিয়ে ঘরে আসেন দোলার মা।

"তোমার মেয়ে বিয়ে করে পালিয়ে যাবে বলছে।" দোলার বাবা হাসতে হাসতে বলেন।

"ও আমি বুঝি শুধু মা-এর মেয়ে। তোমার নয়?" দোলা কোমরে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলে।

"তুই তো আমার মা। হে হে! কোথায় তোর ঘটা করে বিয়ে দেব। তোর আমোদ-আহ্ললাদগুলো ভরিয়ে দেব। তা না করে নিত্যদিন তোদের দৌড় করাচ্ছি। ভয় হয় তোকে নিয়ে। ভাসিয়ে দিয়ে না যাই।" দোলার বাবা অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে নেন। দোলা বাবার মাথার কাছে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে।

"তোমার মেয়ের মেরুদন্ড কি এতই নরম বাবা? আমার বয়সে তুমি কম দায়িত্ব সামলেছিলে? গোটা পরিবার, নিজের সংসার। সামান্য salary পেতে চাকরি করে। বৌ-মেয়ে কে টেনে নিয়ে গেছ নিজের কাঁধে। এতটুকু আঁচ লাগতে দাওনি আমাদের গায়ে। সেই বাবার মেয়ে কি এতই দুর্বল? সামান্য ঝরে সে ভেসে যাবে?"

দোলার বাবা ডানহাত নিয়ে দোলার মাথায় রাখেন। তারপর গালটা টিপে দিয়ে হেসে বলেন। "পাকা বুড়ি একটা। সাবধানে office যা। আমায় নিয়ে ভাবিসনা বেশি। মন দিয়ে কাজ কর।"

বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোটা পথে বাবার হাসি মুখটা মনে করতে করতে যায় দোলা। আজকের সকালটা সত্যি অন্যদিনের থেকে সুন্দর।

                                                                        //৭//
দরজা খুলে নিজের ঘরে ঢুকতেই একঝাঁক ধুলো উড়ে এলো। বহুদিনের অব্যবহারে গোটা ঘরে পুরু ধুলোর আস্তরণ। তার খাটের ওপরে মাকড়শার জালে ভর্তি। বাইরের ঘরে sofa set গুলিরও একই অবস্থা। নিজের খুব পরিচিত এই বাড়ির প্রতিটি কোণ। Computer table এর পাশে আয়না টা রাখা। বারো  বছর আগের সেই রাতের কথা মনে পরে যায় হঠাৎ।  এই আয়নায় নিজেকে অন্যভাবে চিনেছিল সে। এই আয়নাই তাকে সঙ্গ দিয়েছে এত দূর পথে হেটে যেতে। ধুলোর চাদরে মোরা আয়নার কাঁচে হাত রাখে দোলা। সময়টা বারো বছর পিছিয়ে যায়।

সে'বছর promotion পায় দোলা। ভালো রকম increment ও হয়। একদিন office থেকে ফিরে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। মা-কে phone করে জানতে পারে বাবার অসুস্থতার খবর। হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে তাই। হাসপাতাল পৌঁছে বাবার ঘরে যেতে খেয়াল করে গোটা ঘরের স্তব্ধতা। বাবা ঘুমিয়ে আছে bed এ। তার মা এক কোণে মাথা নিচু করে বসে আছে। Sister রা এক এক করে বাবার শরীর থেকে Iv channel, ecg lead গুলো খুলে নিচ্ছে। বাবাকে এরকম নিশ্চিন্ত ভাবে ঘুমোতে দেখেনি দোলা বহুদিন। নীরবে বাবার মাথার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দেয় নিজে হাতে। কপালের ওপর হাত রেখে দেখে নেয়, জ্বর আছে কিনা। বুকের ওপর কান রেখে চেষ্টা করে ধুক পুক শব্দটাকে খুঁজে পেতে। Bed এর পাশে বসে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেই হেসে ফেলে। বাবার কষ্টগুলো আজ সত্যিই নেই। কত নিশ্চিন্ত মনে বাবা ঘুমোচ্ছে।

মা এসে পাশে দাঁড়াতে সম্বিৎ ফিরে পায়। হাসপাতালের bill মিটিয়ে বাবার দেহ বাড়িতে নিয়ে আসে। তাঁর বিছানাতেই শোয়ানো হয়। পোষাক বদলে দিয়ে চন্দন ফোটা দিয়ে সাজানো হয়। আত্মীয়দের মধ্যে অনেকে এক এক করে আসতে শুরু করেছে। এরপর সব কাজ মিটিয়ে বাবাকে রওনা করে দেওয়া। সময় বুঝি তার চোখের জল শুকিয়ে দিয়েছিল। একটা মুহূর্তেও নিজেকে দুর্বল মনে হয়নি। কারো সহানুভূতির মুখাপেক্ষীও তাই থাকতে হয়নি। বারো বছর পেরিয়ে গেছে বাবা চলে গেছেন। কিন্তু প্রতি মূহুর্তে তিনি দোলার পাশেই ছিলেন যেমন ভাবে ছোট্ট দোলাকে আগলে রাখতেন।

অতীতের স্মৃতি মনে করতে করতে হাত দিয়ে আয়নায় জমা ধুলো সরিয়ে ফেলেছিল দোলা। নিজের প্ৰতিচ্ছবি পুরোনো দিনগুলো মনে করিয়ে দেয়। আয়নাতেই বাবার ছবিটা চোখে পরে। বিপরীত দেয়ালে টাঙানো ছিল। নিজের ঘর থেকে বাবা-মা এর ঘরে যায় সে। তারপর সিঁড়ি দিয়ে ছাদে। এই ক'বছরে পাড়াটা অনেক বদলেছে। নতুন নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি হয়েছে। কিন্তু তাদের ছাদ থেকে পশ্চিম দিকের আকাশটা এখনো অনেকটা দেখা যায়। হঠাৎ একটা বাচ্চার হাসির শব্দ শুনে ফিরে তাকায় দোলা।

একটা ফ্রক জামা পরা ছোট্ট মেয়ে তিরতির করে গোটা ছাদে ছুটে বেড়াচ্ছে। একটা লম্বা লোক, সেই পরিচিত হাসি, সেই পরিচিত পোশাকে, বচ্চা মেয়েটিকে ধরতে চেষ্টা করছেন। ওই ধরে ফেললেন ছোট্ট মেয়েটিকে। তারপর সোজা কাঁধের ওপর নিয়ে বসালেন। খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েটি।

"মা দেখো! আমি বাবার থেকেও লম্বা হয়ে গেছি। হি হি হি!" আবার সেই খিলখিল করে হাসি। একজন মহিলা তাদের পাশে এসে দাঁড়ান। খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছেন তিনি। পশ্চিম আকাশে সূর্যের শেষ রঙটুকু মিশে আছে। সেদিকেই তাকিয়ে তিনজন।

বহুদিন পর নিজের গালের ওপর একটা পরিচিত অনুভূতি টের পায় দোলা।  তার চোখ আজ আবার ভিজে গেছে নিজের অতীতের প্রতিবিম্বে। 








  

কোন মন্তব্য নেই: