রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০১৭

তপনদা'র চিঠি 


স্নেহের অনাদি,

গত পরশু তোমাদের চিঠি পেয়েছি। তোমার শারীরিক উন্নতির খবর শুনে নিশ্চিন্ত হলাম। খুব কঠিন অসুখ সামলে উঠলে। নিজের খেয়াল রেখো। আমরাও কুশলে আছি। মিষ্টি তোমার লেখা চিঠি দেখে থেকে আহল্লাদিত, মামা  বাড়ি যাবে বলে। তাকে ভরসা দিয়েছি, আগামী মাসে তোমাদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবো। শ্বশুরমশাই ও সে কথা লিখেছেন। 

এই সূত্রে বলে রাখি, আমার চাকরিতে পদোন্নতি হয়েছে। এখন আমি আমাদের স্কুলের হিসেব সামলানোর কাজ করি। মাইনে বেড়েছে প্রায় একত্রিশ টাকা। আপাতত অভাবের গ্রাস থেকে খানিকটা স্বস্তি পাওয়া গেল। মিষ্টিও বড় হচ্ছে। তার যত্নের ত্রূটিগুলো সংশোধনের সুযোগ পেলাম একটু। এ'বার স্বরস্বতী পুজোয় তার হাতে খড়ি দিয়েছি। প্রথম ভাগ এখন ভালই আয়ত্ত করেছে; সংখ্যাগুলিও চিনতে শিখেছে। তোমার দিদি ওকে দূর থেকে দেখে, আর আমায় তাগাদা করে, মেয়ের পড়াশুনায় যেন ক্ষতি না হয়। মিষ্টির এই বয়সেই যদি এত চিন্তা করে, ভবিষ্যতে কি করবে ভেবেই হেসে ফেলি আপন মনে।

মিষ্টি আজকাল মাঝে মধ্যে খুব বায়না করে, কান্নাকাটি করে। তোমার দিদি সামলাতে পারেনা, তাই আমাকেই দেখতে হয়। সারা রাত ওকে কোলে নিয়ে ঘুরতে হয় দালান-এ। সারাদিন খাটনির পরে এটুকু অবসর সময় মেয়েকে দেওয়াই যায়, কিন্তু সত্যিগুলি যে বড় নির্মম অনাদি। আমার খুড়তুতো ভাইয়েরা উকিলের চিঠি পাঠিয়েছে বাড়ি ছেড়ে দেবার জন্যে। আগামী শুনানিতে রায় ওদের পক্ষে গেলে বাড়ি ছেড়ে দিতেই হবে। আমি আমার জন্যে চিন্তা করিনা, কিন্তু মিষ্টি তো শিশু। এ'সব বিপাকের মধ্যে ওকে এখন থেকেই ফেলতে চাইনা। তোমাদের কাছে তাই ওর একটা আশ্রয় চাইছি। বাবা মারা যাওয়ার আগে নিজের সব সম্পত্তি তাঁর ভাইয়ের নামে করে দিয়েছিলেন, আমায় বলেননি। এখন নিত্য এক উপদ্রব এই মামলা লড়তে যাওয়া। সব কিছু নিয়ে বড় বিপদে পরে গেছি। একা সব দিক সামলানো যায়না।

কাজের কথায় আসি। আমি জানি তোমায় মিষ্টির দায়িত্ব দিয়ে টাকার প্রসঙ্গ আনা অপমান করা হবে। কিন্তু আমার একটা কথা তোমায় মানতেই হবে। প্রতি মাসে আমি ওর নামে কিছু টাকা পাঠাবো। সেই টাকা তোমার ব্যবহারে না লাগলে মিষ্টির নামে জমিয়ে রেখো। আমার এখন যা পরিস্থিতি টাকা পয়সা জমানোর প্রশ্নই আসেনা। কিন্তু ওর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমার এই অনুরোধ।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ঢুকে দেখি মিষ্টির খুব জ্বর। আমি কি আর অত বুঝি? সারা রাত বসে জলপট্টি দিলাম। তোমার দিদি ও বলে বলে দিল, সেই ভাবে পথ্য দিলাম। গোটা রাত মেয়েটা মা-মা করে কেঁদেছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম মিষ্টি যখন জ্বরের মধ্যে কাঁপছিল। পরদিন সকালে জ্বর কিছু কমলে ডাক্তার খানায় নিয়ে গেলাম। স্কুল কামাই করতেই হল। পড়শী এক জেঠিমার মেয়ে মাঝে মধ্যে এসে মিষ্টিকে দেখে রাখে। উঠতি মেয়ে, এমন ভাবে আসাটাও ভালো দেখায় না। তাই না করে দিতেই হল। পাড়াগাঁয়ে নিন্দে রটে বেশী।

আমার দীর্ঘ চিঠি হয়ত তোমায় বিব্রত করছে। সমস্যা সবার জীবনেই রয়েছে। তার এত উপঢৌকন সহযোগে বর্ণনা বিরক্তিকর। আসলে, অনেক কথা জমে রয়েছে, যা বলতে চাইলেও বলা সম্ভব নয়। তোমার দিদির অনুপস্থিতি আমার জীবনের একাকিত্বকে আরো প্রশ্রয় দেয়। মিষ্টি আজও জানেনা তার মা কেন বাড়িতে থাকেনা। মিষ্টি এখনো খুঁজে বেড়ায় তার মায়ের শাড়িগুলোতে পরিচিত গন্ধকে। রাতে তোমার দিদির একটা শাড়ি বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমোতে যায়। তুলসী তলায় মাঝে মাঝেই ছুটে যায় মা-কে দেখতে পেয়ে। রান্নাঘরে উনুন ধারাই যখন ভোরবেলা, মিষ্টি, ধোয়ার গন্ধে তার মা-এর কথা ভেবে উঠে আসে। মিষ্টির মত করে আমিও তোমার দিদিকে খুঁজি ওর শাড়ির গন্ধে, অথবা তুলসী তলায় সন্ধ্যেবেলা। যাকে ধরে রাখতেই পারলাম না, সে-কি আর সহজে ধরা দেবে?

মামলার কাজে চারদিন পর কলকাতা থেকে ফিরলাম যেদিন, সেদিন রাতে খুব ঝড় উঠেছিল। খোলা জানলার কপাটগুলো এলোপাথাড়ি এসে পড়ছিলো। ঝড়ের জন্যেই পৌঁছতে দেরী হয়েছিল আমার। ঘরে ঢুকে দেখি প্রমীলা জ্বরের ঘোরে প্রায় বেহুশ। বাজ পরার শব্দে ভয় পেয়ে মিষ্টি তখন চিৎকার করে কাঁদছে ওর মায়ের পাশে শুয়ে। কাকে ফেলে কাকে সামলাই। তোমার দিদির জ্ঞান ফেরে যখন আমায় দেখে উঠে বসার চেষ্টা করে। কিন্তু পারেনি। আমার জামাটা খিমচে ধরে কাছে টেনে বলেছিল মিষ্টিকে দেখে রাখার কথা। সুযোগ দিলোনা তোমার দিদি; একটু সুযোগ। চলে গেল নিজের খেয়াল মত। একটু আগে যদি ফিরতাম সেদিন, হয়ত এমন হত না।  

তোমার কাছে একটা শেষ অনুরোধ রেখে উপসংহার আনবো। মিষ্টি বুঝতে না পারে, তাই প্রমীলার কোন ছবি আমি ঘরে রাখিনি। তোমার দিদির একটা ছবি বাধিয়ে রাখবে? আগামী মাসে মিষ্টিকে রাখতে গিয়ে নিয়ে আসবো। কল্পনায় ওকে দেখতে খুব কষ্ট হয় এখন। তবু যদি একটা ছবিতে ওর সঙ্গ পাই।

সাবধানে থেকো। তোমার মা-বাবাকে আমার প্রণাম জানিও।

                                                                                                                   ইতি,
                                                                                                                        তপন দা