শনিবার, ৪ মার্চ, ২০১৭

মধ্যবিত্ত্ব। ....... 


                                                                       //১//
ঘরটা বড় অন্ধকার বলে মনে হয়। ডাক্তারি যন্ত্রপাতির হলুদ-সবুজ আলোগুলো গোটা ঘরের শেষ সম্বল যেন। মুখের ওপর oxygen mask টা খুব বিরক্তিকর। এমন এঁটে বসেছে গালের সাথে খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এমন সময় বুকের ঠিক একপাশ দিয়ে চিন চিন করে একটা ব্যাথা উঠতে শুরু করে। ঘরের AC টাও বোধহয় বড্ড বেশি বাড়ানো আছে। শীতটা এমন জাঁকিয়ে অনুভব কোনদিন করেনি সে। আজ প্রথমবার। বুকের পাঁজরগুলো, যা এতদিন তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর সহকারী ছিল, তারাও যেন বিরতির অপেক্ষায়। কেবল হৃদযন্ত্রের তাড়নায় তাদের সঞ্চালন অব্যাহতি পাচ্ছে না। এক মুহূর্তে ছুটি পাওয়ার জন্যে তারা যেন ওঁৎ পেতে আছে। ঐ দূরে কে যেন তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ঝাপসা, দৃষ্টিটাও ঝাপসা আজ। ক্রমাগত অন্ধকার কে সাথী করে সে যেন নেমে আসছে চোখের চারপাশে। বুকের ব্যাথাটা আরেকধাপ বেড়ে জানান দিলো তাদের কর্মবিরতি declare হতে, আর দেরী নেই। হৃদযন্ত্রের ধুকপুক শব্দটা গলার খুব কাছে উঠে এসেছে। আরেকবার চেষ্টা করে সে oxygen mask এর বদ্ধ ক্ষেত্র থেকে জীবন বায়ুকে প্রশ্বাসে ভরে নিতে। নিজের হাত-পা এর অবস্থানও যেন মালুম হয় না আর। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়াটা এখন অনেক কাছে। শেষ বুঝি এসেই গেল। বন্ধ হয়ে আসা চোখের পাতাদুটো আরেকবার খোলার চেষ্টা করে। যতটুকু আলো আসে, সেই সবটুকু আগ্রাসী ভাবে দেখতে ইচ্ছে করে। অচেনা ছায়ার সামনে নিজেকে বড় অসহায় লাগতে থাকে। সব কিছু থেকে পালিয়ে এসেও এবার আর উপায় নেই। আরেকবার চেষ্টা করে প্রাণ ভরে প্রশ্বাস নিতে। ফুসফুস দুটো নিঙড়ে ইচ্ছে হয় সমস্ত দূষিত বাতাস বের করে দিতে। আরেকবার, শেষ বার। অর্ধোচ্চারিত প্রায় অশ্রুত স্বর কন্ঠনালী বেয়ে একটা শব্দ করে, "মা".

                                                                        //২//
"তুমি চাইলেই আমাদের সাথে এসে থাকতে পারো। কিন্তু না। সুখ তোমার কপালে সইবে কেন? এমন মা-বাবার সাথেই তোমার থাকতে ভালো লাগবে।" এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে আকাশের দিকে তাকায় বনানী। আকাশ যেন নীরবে বনানীর এইরূপ এর তারিফ করছে। এমন উপদেশ সত্যি বিরল। নিজের মা-বাবা কে ছেড়ে প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে থাকাই যায়। এরকম সহজ সরল সমাধানটা এতদিন তার মাথায় আসেনি কেন, সেটাই ভাবছিলো আকাশ।
"কি দেখছ অমন করে?" বনানী আবার প্রশ্ন করে।
"তোমাকে। কি সুন্দর সহজ ভাবে আমায় সত্যিটা বলে দিলে। সত্যিই তোমার জবাব নেই। তোমার বাবা বলেছিলেন বটে, আমাদের দোকান ঘরটা ওনাকে দিলে আমায় একটা গাড়ি বা বাইকের showroom বানিয়ে দিতেন।"
"কিন্তু তুমি রাজি হলে তবে তো।"
"না! সত্যি বড় বোকামি করে ফেলেছি। দোকানটা তোমার বাবার নাম লিখে দিলে আজ আমার জীবন টা তৈরী হয়ে যেত গো!" আকাশ খুব হতাশ ভাবেই বলে কথাগুলো।
"এখনো সময় আছে। বাবা আমার জন্যে পাত্র দেখছে, কিন্তু পছন্দ হয়নি। তুমি যদি রাজি হয়ে যাও showroom, রাজারহাটে নতুন ফ্ল্যাট, আর গাড়ি, সব পাচ্ছ। বিয়ের পরে honeymoon trip টাও দাদাভাই দেবে বলেছে Europe tour. ভাবো আকাশ, একবার ভাবো। আমাদের নতুন সংসার। নতুন জীবন।"
আকাশ একবার হাসে শুধু। তারপর বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসে বনানীদের বাড়ি থেকে। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বনানীর নম্বরটা block list এ add করে দিতে খুব একটা কষ্ট হয়নি এবার। আকাশ যেন একটা বুক ভরা শ্বাস নেয় ফাঁকা রাস্তায় উঠে। এবার নিশ্চিন্তে যাওয়া যেতে পারে।

সম্পর্কের তিক্ততা বাড়ে দুই বাড়ি পরিচিত হবার পর থেকেই। আকাশের বাবা সামান্য সরকারি স্কুলের শিক্ষক, অন্যদিকে বনানীর বাবা দুটো কারখানার মালিক। ব্যবসায়ী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা বনানীর জন্যে সামান্য মাইনে পাওয়া মাস্টারের বাড়িতে বৌ হয়ে আসা একটু সমস্যার। প্রথম দর্শনেই বনানীর বাবা সম্পর্ক ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বনানীর জেদের কারণেই আকাশকে ডেকে পাঠান। নিজের কিছু শর্ত সামনে রাখেন। আকাশ ইচ্ছে করে সব শর্ত নাকচ করে দিয়ে চলে এসেছিল। ভেবেছিল, বনানী এগুলির প্রতিবাদ করবে। তার বদলে, বনানীও নিজের বাবার কথাগুলো চাপিয়ে দেয়া শুরু করে। প্রথম দিকে প্রতিবাদ করলেও, ইদানিম আর ভালো লাগতো না। তবু সম্পর্কের খাতিরে বনানী কে সহ্য করে নিত আকাশ। কিন্তু আজ আর মেনে নেয়া সম্ভব না। একটা নীরবে প্রতিবাদ প্রয়োজন ছিল, যার প্রথম পদক্ষেপ আজ সে নিতে পেরেছে। এবার ভুলে যাওয়াটা সহজ। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে, কিছুই মনে পড়বে না।

                                                                    //৩//
মা-বাবা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারের ছন্দটা বিঘ্ন হয়েছে ভালোরকম। ছেলেবেলায় কত মজাই না ছিল। নিশ্চিন্তে জীবন যাপন। School এর homework করা, রোজ সকালে tuition যাওয়া, বিকেল হলেই মাঠে খেলতে যাওয়া school থেকে ফিরে। কিন্তু কলেজে ওঠার পর থেকেই বাস্তবের আসল রূপরেখা চোখের সামনে আসে আকাশের। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত তফাতের প্রকট ও প্রচ্ছন্ন দিকগুলো উপলব্ধি করার সুযোগ ঘটে। কিন্তু আকাশের মা-বাবা এ'বিষয়ে কোন আঁচ লাগতে দেননি দুই ছেলের গায়ে। সমস্যা হল বাবার stroke হওয়ার পর থেকে। আর্থিক স্বচ্ছলতা কোনকালেই তাদের ছিলনা। কিন্তু দেনায় ডুবে গিয়ে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টা বড় ক্লান্তিকর। একজনের ধার মেটাতে গিয়ে অন্য ধার কাঁধে চাপে। কলেজ শেষ হতেই আর অপেক্ষা করেনা আকাশ।প্রথমে ছোটখাটো চাকরি, তারপর টাকা জমিয়ে ব্যবসায় নামে সে। পাঁচ রকমের ব্যবসা করে বেশ ভালোই রোজগার হচ্ছিলো, কিন্তু দেনায় নিমজ্জিত বলে, সে রোজগারের সিঁকিভাগ ও  দেখা যেত না। তবু পাওনাদারদের তাগাদা থেকে মুক্তি পাওয়া যেত। এই বা কম কি? ক্রমে নিজেকে ও নিজের ব্যবসাকে গুছিয়ে নিয়েছে আকাশ কিন্তু পরিবারের সাথে দূরত্বটা কোথাও যেন বেড়ে যাচ্ছিল। টাকার গন্ধ যে বিষাক্ত সে কথা আকাশ বিশ্বাস করে। কিন্তু নিজের পরিবারের লোক ও যখন দূরে সরে যায়, নিজেকে অসহায় বলে মনে হয়।

হাতে টাকা আসলে বোধহয় প্রভুত্ত্ব করবার একটা প্রবনতা চলে আসে। আকাশের মধ্যেও সেই পরিবর্তন আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু মা-এর কথায় নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারে। অবশ্য সেই বোঝার ফল কোনদিনও সে পায়নি। অনিয়ম বা হিসেবের গরমিল দেখলেই অশান্তি শুরু করে দিত। নিজের পরিশ্রমের দেমাগ দেখিয়ে কতৃত্ত্ব ফলাতো। আর আঘাত প্রাপ্ত মা-বাবার চোখের জলকে তাচ্ছিল্য করে নিজের কাজে বেরিয়ে যেত।  অভাগী মা চোখের জল ফেলে আফসোস করতেন, "বোধহয় ঠিক করে মানুষ করতে পারিনি। গরীব মা-বাবার তাই এই পরিণতি।" একবার তো বাড়ি থেকে বেরিয়েও গিয়েছিল আকাশ রাগ করে। এই পরিবর্তন অবশ্য একদিনের ফলাফল নয়। বহুদিনের অভাব অভিযোগ দূর করে পরিবার কে একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আনতে বেশ মেহনত করতে হয়েছিল আকাশকে। সেই মূল্য অবশ্য কেউ দেবেনা কোনদিন। আকাশ মূল্য চায়ও না। শুধু তার হিসেবের মত করে সংসারটাকে ছকে বাঁধতে চায়। আর এখানেই বোধয় সবার আপত্তি।

                                                               //৪//
"তুমি নিজেকে যতটা smart মনে কর এ'সব কথা বলে, আদপেও তা নয়, সেটা অনুমান করতে পারোনা নিশ্চই।" Metro তে ফেরার সময় আলেয়ার সাথে দেখা হয়েছিল আকাশের। কথায় কথায় কি একটা বলে ফেলেছিল। সম্ভত তার এত সিগারেট খাওয়া নিয়েই প্রসঙ্গের শুরু। সে আলোচনায় হঠাৎ এইরকম উক্তি, বেশ হতচকিত করে দিয়েছিল আকাশ কে। এক মুহূর্তের জন্যে নিজেকে সংযত করে পরের station এ নেমে যেতে ইচ্ছে হয়েছিল। পাল্টা দু'টো কথা শোনাবার ইচ্ছেও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু আলেয়ার কথার আড়ালে চোরা সত্যিটাই বোধয় সব ইচ্ছেগুলো কে আটকে দিয়ে আরো বকা খাওয়ার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দেয়। শিশুর মতোই কৈফিয়ৎ দিতে শুরু করে আকাশ। বিপক্ষের অবশ্য কথা সাজানোই ছিল ঠোঁটে। উত্তরগুলো শুনতে ভালোই লাগছিল। মা-এর পরে এ'ভাবে কেউ বলেনি তাকে। আলেয়া বলে চলে।

"একটা জিনিস তুমি বোধহয় জানো না। নিজের সত্ত্বাকে ভুলে, অন্যের সত্ত্বা adopt করা easy নয়। তুমি যদি সত্যিই অনুভূতি প্রবণ না হতে, বনানীর কথাগুলো মনেও রাখতে না। আর সিগারেট খেয়ে পরিণতির উপর ভয় না পেলে নিজের শারীরিক অবস্থার ওপর চিন্তিত হতে না।"

"কিন্তু আমি তো. ......" বলার মাঝেই বাধা পায় আকাশ।

"এরকম ভাবে চললে আর ক'দিন বাদে personality disorder এ ভুগবে তুমি। আর কে তোমায় কিভাবে চেনে, আমি জানি না। কিন্তু আমায় অন্তত তোমার মুখোশ পড়া রূপটা দেখিও না। খুব হাস্যকর লাগে তোমায়।" আকাশের উত্তর দেবার অবকাশ দেবে বলেই বোধয় আলেয়া একবার বিরতি নিল।

" আমি জানি আমি বোকা। কিন্তু মুখোশটা পড়তে হয় ব্যবসার খাতিরে। বনানী চলে যাওয়ার পর সিগারেট খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু তার সাথে। ......." আবার প্রতিপক্ষ প্রতিবাদ করে ওঠে।

"আর তাই তুমি দেবদাস সেজে সিগারেট ধরে নিলে? বাঃ! কি বীরপুরুষ।" আলেয়া কথাগুলো বলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

শিরিষ কাগজ দিয়ে মুখের ওপর ঘষে দিলেও বোধহয় এরকম যন্ত্রনা হয় না, আলেয়ার শেষ কথাগুলো যেমন ধারালো ছিল। আকাশও চাইলে খারাপ ভাবে বলতে পারত। কিন্তু আলেয়ার তিক্ত অপ্রিয় সত্যিগুলির মধ্যে সহানুভূতির স্বাদ পেয়েই বোধয় আবার কোন একটা বোকা বোকা কথা বলে বসত।

আলেয়াকে আকাশ ভুলভুলাইয়া বলে ডাকে। ভুলভুলাইয়ার মতই জটিল মনস্তত্ব বলে মনে হয়। আলেয়া কে চেনা, আকাশের সাধ্যি নয়, সে কথা আকাশ বরাবর স্বীকার করে এসেছে। এমন চাপা প্রকৃতির মেয়ে সত্যি বিরল। আলেয়া সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য শোনা bank এর বড়বাবু তাপস মল্লিকের কাছ থেকে। Bank এর কাজেই আলেয়ার সাথে আলাপ। যে bank থেকে আকাশ ব্যবসা সংক্রান্ত loan নিয়েছে, আলেয়া সেই bank এর PO. কাজের সূত্রের আলাপ ক্রমে একটা বন্ধুত্বে পরিণতি পায়। অবশ্যি আলেয়া তাকে বন্ধু ভাবে কিনা সে'কথা আকাশ জানে না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই দেখা হলে, হেসে আলাপ করতে দুজনেই সমান আগ্রহী বলে মনে হয়। আকাশের আপাত নির্লিপ্ত, নির্বিকার আভরনের আড়ালে সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলির খবর আলেয়া কিভাবে যেন টের পেয়ে যেত। আকাশ ও বাধ্য ছেলের মত বকা খেত। এই আলাপ পর্বের পরিসর অবশ্য ওই যাতায়াতের পথেই যা কিছু হত।  Leukemia এর মত বিকট রোগ যার নিত্যদিনের সঙ্গী। তিলেতিলে যার শরীরটা ধুকছে অসুখের প্রভাবে। সেই মেয়ে নিজের সমস্ত আবেগ কে কোন অতল সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে নিত্য অফিস আসছে, কাজ করছে। এ'দিকে কেউ জানতেও পারছেনা আলেয়ার খবর।

একবার bank এ খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরে এসেছিল আলেয়া। নির্ভেজাল compliment করেই আকাশ জিজ্ঞেস করেছিল আজ হঠাৎ এমন সাজের কারণ। হেসে বলেছিল, "আজ সকাল থেকে মনটা একটু খারাপ ছিল। তাই সেজে নিলাম।" এমন পরিহাসের আড়ালে লোকানো আবেগের হদিশ আকাশ জানে না। খোঁজার চেষ্টাও করেনা। বনানীর পরে নিজের মনে আর কাউকে প্রশ্রয় দেবেনা বলে সে decide করেছিল। কিন্তু আলেয়ার কাছে এলে নিজের মনই প্রশ্রয় চেয়ে আবদার শুরু করে। যেটুকু দুর্বলতা আকাশের, সেটা আলেয়ার চোখে। প্রায় ফ্যাকাশে মুখের আদলে ঐ দুটো ঘন কালো চোখের গহীন অতলে সব আবেগ লুকিয়ে, সে চোখ যেন হাসির সাজে রঙিন। বনানীর ছাঁচে সব নারীকে বিচার করতে করতে আলেয়ার কাছেই প্রথম হোঁচট খায় আকাশ। নিজের অজ্ঞাতেই তাই অনেক সময় মন কে প্রশ্রয় দিয়ে আলেয়ার কাছে চলে আসে সে। আর আলেয়ার প্রতিটি কথায়, মন্তব্যে নতুন করে চেনার চেষ্টা করে তাকে।



                                                                 //৫//
বনানীর সাথে সম্পর্ক ভেঙে গেছে প্রায় তিন বছর। এতগুলো দিন যে কিভাবে পেরিয়ে গেছে, টের পায়নি আকাশ। অর্থাভাব বোধহয় অন্য সব অভাবের মূল্যকে ফিকে করে দেয়।  যে বনানীর প্রতি এত দুর্বলতা, এত ভালোবাসা আজ তার কোন প্রভাবই নেই তার জীবনে। নিজের অফিসে ঢুকে, desk এর ওপর বনানীর বিয়ের নিমন্ত্রণ পত্র দেখে অতীতের কিছু স্মৃতি ছায়াছবির মতই চোখের পর্দায় ভেসে উঠেছিল। Chair এ বসে তাদের প্রথম আলাপ, পরে প্রেম নিবেদন, সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা রকম স্বপ্ন। আজ সবই মনে পড়ছে। কিন্তু প্রভাব বিস্তারে আজ সেগুলো বড়ই তুচ্ছ।

"দাদা, চা এনেছি।" সহকারীর ডাকে ভাবনা ভাঙে আকাশের।

"এই card টা কে দিয়ে গেল?" খামের মধ্যে বিয়ের card টা চালান করে চায়ের কাপ হাতে তুলে নেয়।

"একজন মেয়েছেলে এসেছিল। তোমার খোঁজ করে না পেয়ে আমায় ওই card দিয়ে চলে গেল। বলল তুমি আসলে তোমায় যেন দিয়ে দি।" নিজের কাপে চা ঢালতে ঢালতে কথাগুলো বলে নেপাল, আকাশের সহকারী।

"তোকে না কতদিন বলেছি, মেয়েছেলে বলবিনা? একটি মেয়ে এসে দিয়ে গেছে বলা যায় না?" চায়ের কাপে চুমুক দেবার আগে ধমকটা দিয়ে নেয় আকাশ। নেপালের বাসস্থান যে এলাকায়, সেখানে মেয়েদের, মেয়েছেলে বা মাগী বলার চলটাই বেশী। নেপালেরও দোষ নেই। নিজের মা-কেও সে ঐভাবেই ডাক শুনে আসতে দেখেছে। আকাশ তবু তালিম দেয় নেপালকে শহুরে আদব কায়দায়। আর যাই হোক, তার মক্কেলদের সামনেও নেপাল নিজের সহজাত ভাষায় কথা বললে, মান সম্মানের ওপর কালিমা পরে যাবে। চা শেষ করে, কাপটা table এ রেখে উঠে পরে আকাশ। বিয়ের card টা ছিড়ে dustbin এ ফেলে বাইরে এসে সিগারেট ধরায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফুসফুসে ভরে নেওয়া ধোঁয়াকে নির্গত করে, স্বগোতক্তি করে বসে। "যাক বাবা। বেঁচে গেলাম।"

"কি বিড়বিড় করছিস অমন অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে?"

পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে চমকে ওঠে আকাশ। তালুকদারের গলা। তার থেকে ৫ হাত দূরে একটা light post এর গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলেছিল তালুকদার, আকাশের বাল্য বন্ধু। প্রায় বছর সাতেক পর আবার দু'জনের দেখা। চাকরি পেয়ে বেড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে, তালুকদারের সাথে আর সেভাবে যোগাযোগ রাখা হয়নি। আজ আবার দেখতে পেয়ে বনানীর বিয়ের প্রসঙ্গটা এক লহমায় যেন মাথা থেকে বেরিয়ে যায়।


সেই পুরোনো কায়দাতেই আড্ডা শুরু করেছিল তারা। পিকলুদার দোকানের চা, আর ছোটুর দোকান থেকে কেনা চারমিনার ধরিয়ে। আকাশ আর ঋক তালুকদার এক স্কুলের ছাত্র। Cricket এর মাধ্যমে বন্ধুত্ব, দু'জনেই ফেলুদার ভক্ত। এছাড়াও অনেক সমান্তরাল চিন্তা ভাবনার কারণে দুজনই খুব ভালো বন্ধু। কলেজে ওঠার পর ফেলুদাকে অনুসরণ করেই চারমিনার দিয়ে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে হাতেখড়ি। তারপর কলেজ শেষে চাকরির চেষ্টা। ঋক Bangalore এ একটি বিদেশী সংস্থায় চাকরি পেয়ে চলে যায়। দু'বছর ওখানে থাকার পর কি করে, কি বৃত্তান্ত আকাশের অজানা। প্রায় সাত বছর পরে, এই আবার দু'জনের দেখা। আকাশ বরাবরই ঘরের প্রতি আসক্ত; অবশ্য উপায়ও ছিলনা। কলেজের তৃতীয় বছরেই আকাশের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরের বছরেই মা। কলেজ শেষ করে টাকার বন্দোবস্তে না বেরোলে সংসারটা অগোছালো হয়ে যেত। এইসব অতীত আকাশের মনে আর স্থান পায়না। কিন্তু মাঝরাতে উঠে হিসেবে নিয়ে বসে আর্থিক পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে মাঝেমধ্যে বন্ধুদের ভাগ্যকে হিংসে হয়। তারপরই নিজের স্বাধীন ব্যবসার কথা মনে করে নিজেই নিজেকে বাহবা দেয় আর স্বান্তনা দেয়।

"আজ দু'বছর হল Germany তে আছি। ওখানেই ভাবছি settled হয়ে যাব। মা চলে গেলো বলে দেশে ফিরলাম। কাজ, অনুষ্টান সব শেষ করে তোর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করি। শুনলাম বড় business man হয়ে গেছিস?" চায়ের প্রথম চুমুক দিয়ে কথাগুলো বলে ঋক।

"তোর মা? কি হয়েছিল?" খবরটা খুবই অস্বস্তির। আকাশ নিজের কাছেই নিজে বিরক্ত হয় উপযুক্ত শব্দ চয়নের অভাবে।

"ঐ যা হয়। Cerebral stroke, coma তে ছিল প্রায় পঁচিশ দিন। আমি দেশে ফেরার দু'দিন পরেই take off করল মা।" খুবই casual ভাবে কথাগুলো বলে ঋক।

"জেঠুকে নিয়ে যাচ্ছিস? এখানে তো ওনার একা থাকা খুবই চাপের।"

"মা তো বাবার কাছেই গেল। আমি আবার বাবাকে নিয়ে কোথায় যাব?" একইরকম সচ্ছন্দভাবে বলে ফেলে ঋক।

"তার মানে? জেঠু! কি বলছিস তুই?" আকাশ নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।

"বাবা মারা যাওয়ার পরেই তো Germany তে চাকরি টা নিয়ে ফেলি। মা এখানে মামা বাড়িতে থাকত। এখন মা-ও রওনা দিয়েছে। কাজেই আমার এখানে ছুটি। একেবারেই চলে যাব বলে school এর বন্ধুদের সাথে একবার দেখা করে নিচ্ছি। তুই তো পুরো বেপাত্তা। অনেক খোঁজ নিয়ে তোর office এর address পেলাম।"

ঋক এর একটা স্বভাব ছিল যে কোন serious বিষয়েও একেবারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারত। নিজের মা-বাবার মৃত্যু সংবাদও কেউ এইভাবে দিতে পারে, আকাশের জানা ছিলনা। ঋক বলত, "কারো করুণা ভিক্ষা পেতে হলে নিজেকে দুর্বল সাজাবি। বিবেকানন্দ পড়ে দেখ। লোকটা ভগবান হয়েও কি নিষ্ঠূর ভাগ্যের পরিহাস সহ্য করেছে। সেই লোক স্বয়ং ভবতারিনীর  করুণা না চেয়ে, মুক্তির পথ চেয়েছিল। সেখানে আমি সামান্য মানুষ, আরেকটা মানুষের কাছে করুণা ভিক্ষে করব? কভি নেহি।" এসব কথা শুনলে আকাশের হাসি পেত। ঋকের ঘিলুতে ধূসর পদার্থের অভাব ভেবে ঋক কে নিয়ে হাসাহাসি করত। কিন্তু ঋক বোধয় সত্যি মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। তাই জীবনের সব থেকে বড় সম্বল হারিয়েও এমন নির্বিকার চিত্তে কথাগুলো বলে চলেছে।

"তোর ব্যবসায় কিছু টাকা দিতে চাই। ভেবেনে, আমি investor. কত percent return দিবি বল?"

কথার মাঝখানে হঠাৎ এমন প্রসঙ্গ পরিবর্তনে আকাশ কিছুটা বেসামাল হয়ে যায়। আমতা আমতা করে আবার জানতে চায় ঋকের ইচ্ছে।

"আমি তোর সব কথাই শুনেছি।" ঋক চায়ের দাম মিটিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরায়। আকাশের অবাক ভাবটা দেখে কারণ বুঝতে পেরে বলে,
"তোর বাড়ি গিয়েছিলাম। কাকিমার সাথে দেখা হয়েছিল। কথায় কথায় সবই শুনলাম। ওখান থেকেই তোর office এর address নিয়ে এলাম।"

"মা তোকে কি বলেছে?" আকাশ আরেকটা সিগারেট ধরায়।

"সুদে ধার নিয়ে কারবার চালাচ্ছিস। পাওনাদাররা মাঝে মধ্যেই বাড়িতে আসে। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। রাতে ঘুম নেই। মাঝে মধ্যে নাকি বাড়িও ফিরিস না। কি চাইছিস কি?" আকাশ যে নিজের মা এর প্রতি বিরক্ত হয়েছে, অনুমান করতে পারে ঋক। তার রেশ ধরেই বলে, "কাকিমার ওপর রাগ করে কি করবি? আমার হাতের চড় যদি ভুলে না গিয়ে থাকিস, বেপারটা আমাদের দু'জনের মধ্যেই রাখ।"

"কিন্তু এই বাজারে কোন ব্যবসায়ি ধার নিয়ে কারবার চালায়না বল? তাই বলে মা-কে জনে জনে বলে বেড়াতে হবে?" আকাশ বিরক্ত হয়ে বলে।

"কাকিমার concern টা কি অহেতুক? আছে বলে যে দম্ভে কথাগুলো বললি, আমার জায়গায় থাকলে সেই কথাগুলো, সেই concern টুকু পাওয়ার জন্যেই ছটফট করতিস।" ঋকের মন্তব্যে সত্যি দুমড়ে যায় আকাশের ফাঁপা দম্ভের গোলক। "আমি কিছু টাকা তোকে দিয়ে যাচ্ছি। তুই ব্যবসায় লাগা। প্রয়োজনে ধার কিছু শোধ করে দে, যাতে মাসে মাসে সুদ গোনাটা বন্ধ হয়। আমায় তো আর সুদ দিতে হবে না। বছর শেষে মুনাফার একটা অংশ আমায় পাঠিয়ে দিবি।"

"তুই না বললি, কারো করুণা ভিক্ষে না করতে?" আকাশ মাথা নিচু করে বলে।

"নেহাত আমরা বড় হয়ে গেছি তাই। স্কুল-এর বারান্দায় কিভাবে ফেলে পিটিয়েছিলাম তোকে, মনে আছে নিশ্চই?"

"তুই আমায় করুণা ভিক্ষে দিচ্ছিস না? আচমকা এমন কি হল, যে তুই আমায় টাকা দিবি?" আকাশ খুব বিরক্ত ভাবেই বলে কথাগুলো।

"তুই না share market এ টাকা লাগাস? তুই এই কথা বললি? ভাব আমি তোর company র বিশ percent share holder. তুই company grow করিয়ে মুনাফা তুলে আমায় ফেরত  দিবি। তাহলেও কি বলবি এটা করুণা?"

"কিন্তু হঠাৎ এইভাবে?"

"এত ভাবিস না। ব্যবসায় সুযোগ একবার আসে, বারবার নয়। আমার আর কি বল? সংসার করিনি, মা-বাবাও স্বর্গে। টাকাগুলো এমনিই পরে থাকার চেয়ে তোর কাজে লাগুক। তুই ভালো করে ব্যবসা কর আর আমায় return দিতে থাক। তারপর বুড়ো বয়সে দু'জনে ফুর্তি করা যাবে। কি বলিস?" ঋক নিজের স্বভাবচিত সেই হাসি দিয়ে আকাশের পিঠ চাপড়ে দেয়।

"যদি ফেরত দিতে না পারি?" আকাশ প্রশ্ন করে।

"তাহলে দিবি না! কি যায় আসে? তুই পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলিস না, সবাই হয়ও না। কিন্তু তুই খুব ভালো মানুষ আকাশ। আর সে জন্যেই বোধহয় তোকে সাহায্য করছি। অবস্থার বিপাকে সবাই পরে। কিন্তু নিজেকে এভাবে বদলে ফেলিস না। বদলে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু এই বদলে যাওয়ার কারণে যাদের হারাবি, তাদের ফিরে পাওয়া অনেক কঠিন।"


পরেরদিনই আকাশের account এ বড় অঙ্কের টাকা এসে যায়। সেই টাকায় দু'জন সুদের দালালের হাত থেকে রেহাই পায় আকাশ। বাকী টাকা ব্যবসাতে লাগায়।  সুযোগ সত্যি একবার আসে, আর এরকম সুযোগ হারালে আকাশ আবার পেত না। এই ক'দিনে, আকাশ নিজের লভ্যাংশকে প্রথমবার চোখে দেখতে পেল। টাকা থাকলে বোধয় মানসিকতা পাল্টে যায়। অনেক পরিশ্রমের পরেও ভাঁড়ার শূন্য দেখলে সবারই মন রুক্ষ হয়ে থাকে। Account balance এর সংখ্যাগুলি এখন আর আফসোসের কারণ হয়না আকাশের।

                                                                 //৬//
ঋক Germany চলে গেছে প্রায় দু'বছর হল। নিয়ম মাফিক প্রত্যেক মাসে আকাশ লভ্যাংশের এক ভাগ ঋক এর account এ পাঠিয়ে দেয়।  আগের তুলনায় আর্থিক অবস্থা এখন অনেকটাই স্বছল। দিন-রাত পরিশ্রমের ধকলটাও অনেক কমেছে। এখন শুধু তদারকি করা ছাড়া আর সেরকম খাটনি নেই। বাড়িতেও একটা ছন্দ ফিরে এসেছে। মা-এর অসুস্থতার সময় নিজেদের সঞ্চয় পুরো শেষ হয়ে গিয়েছিল। আত্মীয়-বন্ধুর দ্বারে, প্রায় একরকম ভিক্ষে করেই হাসপাতালের bill মেটাতে হয়েছিল আকাশদের। সেই ঋণ সোধ করতে নিজেদের বাড়িটাও বিক্রি করে দিতে হয়। একরকম নিঃস্ব অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো সত্যি অনেক সময় নিয়ে নেয়। Office এর ঠিকানা বদল না হলেও আয়তনে অনেকটা বেড়েছে। কর্মচারীর সংখ্যাও বেড়েছে। নিজের ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে আকাশ। এই কাজে অবশ্য আলেয়ার অনেকটাই সাহায্য ছিল। একরকম নিজের মত করেই আলেয়া ঘরের প্রতিটি কোণ সাজিয়েছিল।

সাজানো গোছানো ঘরটায় ঢুকলেই আলেয়ার কথা খুব মনে পরে আকাশের। প্রথমবার দু'জন সিনেমা দেখতে গিয়ে, আলেয়ার ছেলেমানুষিগুলো খেয়াল করে আকাশ। একটু একটু করে নিজেদের পরিচয় বাড়তে থাকে। ভালো বন্ধুত্ব তখন যেন আরেকটু কাছের মানুষ করে দিয়েছিল তাদের।

"এইভাবে কলকাতাকে কোনদিন দেখিনি। Thank you." গঙ্গার পার দিয়ে হাটতে হাটতে বলে আলেয়া।  প্রিন্সেপ ঘাটের কাছে গাড়িটা park করে দু'জনে গঙ্গার পারে এসেছে। পড়ন্ত সূর্যের শেষ আলোটুকু গঙ্গার ওপর প্রতিফলিত হয়ে অন্য আমেজ তৈরী করেছে। আজ রবিবার থাকায় সারাদিন দুজনে ঘুরেছে। প্রথমে সিনেমা দেখতে যাওয়া, পরে lunch সেরে Park street cemetery. সেখান থেকে জাদুঘর হয়ে প্রিন্সেপ ঘাট।

এতটা সময় একসাথে কাটিয়েও যেন বড় অল্প বলে মনে হয়। আলাপের সিঁকিভাগ ও এখনো হয়নি, এদিকে দিন তার সমাপ্তি ঘোষণা করে দিয়েছে। আর্থিক কাঠামো সুসজ্জিত করে আকাশ আবার নিজের ছাত্রজীবনের কিছু অভ্যাস ফিরিয়ে এনেছিল। বই পড়া, গান শোনা, সিনেমা দেখা। কাজের টানাপোড়েনে কোথায় যেন সব হারিয়ে গিয়েছিল। আবার সে অভ্যেস ফিরে আসায় আকাশ আগের মতোই প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে। কলকাতার ইতিহাস সম্পর্কে তার পড়াশোনা বহুদিনের। Park street cemetery র অনেক অজনা ইতিহাস, সেদিন আলেয়া কে বোঝাতে বোঝাতে নিজেও যেন হারিয়ে গিয়েছিল সেই প্রাচীন ইতিহাসে। সারাদিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যখন তারা গঙ্গার পাড়ে এসে দাঁড়ায়, নিজেদের অজান্তেই  দুজনের আঙ্গুল ঠিকানা খুঁজে নেয় একে ওপরের হাতে।


                                                                    //৭//
ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ঘুমটা ভেঙে যায় সকাল সকাল। ঘড়িতে তখন ভোর পাঁচটা। স্বপ্নের উপলব্ধিগুলোকে আরেকবার আমেজ সহ অনুভব করতে ইচ্ছে করে। আলেয়াকে নিয়ে খুব সুন্দর একটা জায়গায় বেড়াতে গেছে আকাশ। পাহাড়ি এলাকা, চারিদিকে নানারকম ফুল ফুটে আছে।


বহুদিনের অপেক্ষা শেষ করে আকাশ নিজের মনের কথা জানায় আলেয়াকে। নীরব পাহাড়ি উপত্যকায় দুজনের উপস্থিতি সেই স্বপ্নের আমেজকে আরো ছদ্ম-উষ্ণতা দেয়। আলেয়ার হাত যেন সত্যি নিজের হাতের মাঝে অনুভব করতে পারে আকাশ। পরিবেশ ও ঘটনার চরম মুহূর্তে স্বপ্নটা ভেঙে যায়। কিন্তু সেটুকুই বা কম কিসে। নিজের কাছে নিজেই যখন হারিয়ে গিয়েছিল আকাশ, আলেয়ার উপস্থিতি তাকে একটু একটু করে বিপথ থেকে সরিয়ে এনেছে। নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছে, বাস্তবের মাটিতে পা রেখেও আবেগ কে সাথী করে চলতে শিখিয়েছে। নিজের জীবনের বাকি সময়টুকু তাই আলেয়াকেই দিতে মন চায় আকাশের।

"তুমি এ'ভাবে আমায় বেঁধে রেখনা। আমার হাতে সময় কম আকাশ।" আলেয়া একরকম জোর করেই দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল আকাশ কে।

"তোমায় বেঁধে রাখার সাধ্য আমার নেই। তবে তোমার সঙ্গ পেতে আমার বড় লোভ হয়। আর ব্যবসা করে এ'টুকু বুঝেছি। সমান ভাবে অংশীদার হয়ে কোন ব্যবসা চালালে, সে ব্যবসার গতি অনেক স্থির ও নিশ্চিত হয়।"

"তোমার-আমার সম্পর্কটা বুঝি ব্যবসার?" অভিমান করে হাত সরিয়ে নিয়েছিল আলেয়া।

"আমার word selection যে কতখানি নিম্নমানের, সে'বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। তবে, এ'টুকু আমি বুঝি। তুমি আমার জীবনের প্রতিটি পরিবর্তনের সাথে যেভাবে সাহায্য করেছ, তোমাকে ভুলে অন্য কাউকে নিজের সময় দেওয়ার কথা আমি অন্তন্ত ভাবতে পারিনা।"

"ডাক্তার বলছে আমার হাতে আর মাত্র পাঁচ বছর সময়। কি হবে এমন সম্পর্কের পরিণতি দিয়ে?"

"তুমি কবে যাবে, তোমার হাতে কতদিন সময়, সে বিষয় আমি বিশ্বাস করি না। এমনও তো হতে পরে, তোমার আগেই আমি, ........."

আকাশের মুখ চেপে ধরেছিল আলেয়া। বাকি কথা নীরব প্রলাপের মতোই কেবল আন্দোলিত করেছিল আকাশের ঠোঁট। সেই প্রথম অন্তরঙ্গ হয়েছিল তারা দু'জন। একে অপরের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে মনের কথা প্রকাশ করেছিল নিকট আলিঙ্গনে। আর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছিল, সেই নতুন প্রেমকে আরো সজীব করে তুলতে।


স্বপ্নের কথাটা ভাবতে ভাবতেই বিছানা থেকে উঠে জানলার কাছে আসে আকাশ। ভোরের আলো তখন সবে পঙক্তি রচনা করেছে পুব আকাশে। নতুন দিনের শুরুটা বেশ উপভোগ্য বলে মনে হয়। বেসিনের কাছে গিয়ে মুখে চোখে জল দেয় আকাশ। তারপর brush paste নিতে গিয়েই সব অন্ধকার।

                                                                       
















                                                                            //৮//
আকাশের জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে পৌঁছে। ডাক্তারদের তদারকি, মা-এর উৎকন্ঠায় ভরা কন্ঠস্বর, আর হাসপাতালের ব্যস্ততা, আবছা আবছা মনে পড়ছে এখন। ICCU room এর এই cabin এ একাকিত্বকে অনুভব করে স্মৃতির পাতাগুলি উল্টেপাল্টে দেখছিল আকাশ। মাস কয়েক আগে একটা ছোট ঘটনার পর অসুস্থ হয়ে পরেছিল সে। ডাক্তারদের মতে Heart এর অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক ছিলনা। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে আকাশ পুরো ব্যাপারটাই গোপন রেখেছিল সবার কাছে। ডাক্তারের নিষেধ সত্ত্বেও, নিয়ম বহির্ভূত জীবনযাত্রা কে বিরতি দেয়নি। সেদিন ভোরের স্বপ্নের সাথে সকাল শুরুর পরে যেটুকু স্মৃতি বেঁচে আছে, তাকেই সম্বল করে নিজের অতীত-এর পথগুলি স্মরণ করতে থাকে। এই একলা ঘর, যন্ত্রের আওয়াজ আর জানলার কাঁচের বাইরে সন্ধ্যার আলোকিত কলকাতা। বুকের পাশ দিয়ে ব্যাথার প্রভাবটা আরেকবার জানান দিয়ে যায় নিজের উপস্থিতি। এই বুঝি শেষ। ............  ঘরটা বড় অন্ধকার বলে মনে হয়। ডাক্তারি যন্ত্রপাতির হলুদ-সবুজ আলোগুলো গোটা ঘরের শেষ সম্বল যেন। মুখের ওপর oxygen mask টা খুব বিরক্তিকর। এমন এঁটে বসেছে গালের সাথে খুলে ফেলতে ইচ্ছে হয়। এমন সময় বুকের ঠিক একপাশ দিয়ে চিন চিন করে তীব্র একটা ব্যাথা উঠতে শুরু করে। ঘরের AC টাও বোধহয় বড্ড বেশি বাড়ানো আছে। শীতটা এমন জাঁকিয়ে অনুভব কোনদিন করেনি সে। আজ প্রথমবার। বুকের পাঁজরগুলো, যা এতদিন তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস এর সহকারী ছিল, তারাও যেন বিরতির অপেক্ষায়। কেবল হৃদযন্ত্রের তাড়নায় তাদের সঞ্চালন অব্যাহতি পাচ্ছে না। এক মুহূর্তে ছুটি পাওয়ার জন্যে তারা যেন ওঁৎ পেতে আছে। ঐ দূরে কে যেন তাকিয়ে আছে তারই দিকে। ঝাপসা, দৃষ্টিটাও ঝাপসা আজ। ক্রমাগত অন্ধকার কে সাথী করে সে যেন নেমে আসছে চোখের চারপাশে। ........................................................................................

হৃদযন্ত্রের শেষ স্পন্দন জানিয়ে monitor এর রেখাগুলি একভাবে সরলরেখায় চলতে শুরু করে। শেষ নিঃশ্বাসের অনুভূতি কে সঙ্গী করে সবার অলক্ষ্যে আকাশ পালিয়ে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। সে দারিদ্রতাকে ভয় পেত,  ভয় পেত ঋণ এর বোঝা কে। সেই সব কিছু থেকে পালাবার জন্যে একটু একটু করে সরে এসেছিল নিজের প্রিয়মানুষদের কাছ থেকে। আজ জীবনের সব অধ্যায়ের উপসংহার রচনা করতে চলেছিল সে, আর তখনই জীবন তাকে ছেড়ে বিদায় নিল কিছু অসমাপ্ত ইচ্ছের ঋণ রেখে দিয়ে।